• যতো লেখা

  • মাহাবুবুল হাসান নীরুর ই-গ্রন্থ 'সেরা দশ গল্প'। অসাধারণ দশটি গল্পের এক অনবদ্য উপস্থাপন। বইটি পড়তে ক্লিক করুনসেরা দশ গল্প
  • ছবি ফেলে আসা এবং চলমান সময়ের কথা বলে। ধরে রাখে সময়কে স্মৃদির ফ্রেমে। মাহাবুবুল হাসান নীরু অ্যালবামটি দেখতে ক্লিক করুনঅ্যালবাম
  • মাহাবুবুল হাসান নীরুর ই-গ্রন্থ 'হৃদয়ছোঁয়া পঁয়ত্রিশ'। দৃষ্টিনন্দন অলঙ্করণ আর মন-জমিনে দাগ কাটার মতো পঁয়ত্রিশটি ছড়া-কাব্য। বইটি পড়তে ক্লিক করুনকাছের মানুষ
  • মাহাবুবুল হাসান নীরুর খেলাধুলা বিষয়ক লেখা পড়ার জন্য ক্লিক করুনখেলা
  • মাহাবুবুল হাসান নীরুর শিশুতোষ লেখাগুলো পড়তে ক্লিক করুনশিশুতোষ রচনা
  • মাহাবুবুল হাসান নীরুর গল্প পড়তে ক্লিক করুনগল্প
  • মাহাবুবুল হাসান নীরুর ছড়া পড়তে ক্লিক করুনE-BOOK
  • এক মাসের লেখা

কালোদের শক্তির উৎস

একটি বিশেষ নিবন্ধ

ka-13[1]

মা হা বু বু ল  হা সা ন  নী রু

পশ্চিমা মিউজিক ওয়ার্ল্ডে ঝড় তোলা এক কৃষ্ণাঙ্গ পপ গায়কের একটি জনপ্রিয় প্রেমের গানের সুরের মূর্চ্ছনায় উৎফুল্ল মনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে বাস্কেটবল খেলোয়াড় এডামস। মাঝে মাঝে বেশ উঁচু স্বরে ঠোঁট মেলাচ্ছে গানের সাথে এবং সেই তালে আঙ্গুলগুলো স্টিয়ারিং-এর ওপর লাফাচ্ছে। গাড়ির গতির কাটা সত্তুর থেকে পঁচাত্তর ওঠানামা করছে।   গন্তব্য ম্যানচেষ্টার। লিভারপুল থেকে ম্যানচেষ্টার খুব দূরের পথ নয়। মাত্র পঁয়ত্রিশ মাইল। প্রেমিকার উষ্ণ সান্নিধ্য প্রাপ্তির প্রাবল্য থার্মোমিটারের তাপপ্রাপ্ত পারদের মতো লাফিয়ে ওপরে উঠে বসে আছে। ওর প্রেমিকা জেসিকা ম্যানচেষ্টারের একটি শপিং মলে কাজ করে। প্রতি সপ্তাহের সানডে নাইট ওরা এক সঙ্গে স্যাম্পেনের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে উপভোগ করে। একে অপরের শরীরের উত্তাপ বিনিময় করে।

মাত্র কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যা নেমেছে। আবহাওয়াটা চমৎকার অনুকুলে। মে-জুন সময়টাকে ইংল্যান্ডে ‘আর্লি সামার’ ধরা হয়। এ সময় স্বাভাবিক তাপমাত্রা ১৫-২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং আর্দ্রতা থাকে ৫০-৬০%।

হঠাৎ একটা সাদা টয়োটা কারিনা এডামসের গাড়ির গতি রোধ করে সামনে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে নামলো তিনজন শ্বেতাঙ্গ যুবক। ওরা ইশারায় এডামসকে গাড়ি থেকে নামতে ইঙ্গিত করলো। এডামস গাড়ি থেকে নামতেই যুবকরা ওর মুখোমুখি হলো। কথা নেই, বার্তা নেই এক যুবক ধাঁই করে একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো এডামসের চোয়ালে। হতভম্ব এডামস! প্রশ্ন করলো, তোমরা আমাকে মারছো কেন?

উত্তরে এক শ্বেতাঙ্গ যুবক খেঁকিয়ে বললো, ‘তুই কালো, তাই তোকে মারছি’। এরপর এডামসের বাঁ চোখের ওপর আর একটা ঘুষি পড়তেই ওর চোখের সামনে দুনিয়াটা অন্ধকার হয়ে গেলো।

কালোরা এতো শক্তি আর মনোবল পায় কী করে?

কালোরা এতো শক্তি আর মনোবল পায় কী করে?

শ্বেতাঙ্গদের নিপীড়ন আর নির্যাতনে কৃষ্ণাঙ্গদের দুনিয়া সব সময়ই আঁধারে ঢাকা থাকতো। ক্ষেত্রবিশেষে আজও আছে। চামড়া কালো বলে তাদের যেনো অপরাধের অন্ত নেই। নানা অজুহাতে শ্বেতাঙ্গরা তাদের ওপর চালাতো নির্যাতনের স্টিমরোলার। ক্রীড়াঙ্গনও এর বাইরে ছিলোনা। ক্ষেত্রবিশেষে আজও নেই। লাঞ্চনা-বঞ্চনা আর নির্যাতনের সে সব করুণ অধ্যায় কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। কারো কারো জীবনে রাতের ঘুম হারাম করা দুঃস্বপ্ন। তবে দিনে দিনে এ চিত্র অনেকটাই বদলেছে। শুধু বদলেছে বললে ভুল হবে, আসলে ক্রীড়াক্ষেত্রসহ অনেক ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গরা স্বীয় শৌর্য-বীর্যের প্রদীপ্ত মনোবলে পদানত করেছে অনেক প্রতিকুলতা। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, খেলাধুলার ক্ষেত্রেই এসেছে তাদের সবচেয়ে বেশী সাফল্য। বিশ্ব ক্রীড়ায় কৃষ্ণাঙ্গদের বিস্ময়কর সাফল্যে বিস্মিত বিশ্ববাসী। আর যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যায়, কৃষ্ণাঙ্গদের এই সাফল্যের পেছনে আসল রহস্যটা কি। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, খেলার মাঠে কালো ক্রীড়াবিদ আর রাজনৈতিক মঞ্চে নেলসন ম্যান্ডেলা কালোদের আলো ছড়িয়ে চমকে দিয়েছে বিশ্বকে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ম্যান্ডেলা আজ বিশ্বব্যপী একজন ত্যাগী মহান নেতা হিসেবে সর্বজন শ্রদ্ধেয়। কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে একজন অবিসংবাদিত, আপোষহীন নেতা তিনি।। রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, শিক্ষিত, আফ্রিকার উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক কৃষ্ণাঙ্গ ম্যান্ডেলা তাঁর জীবনের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ পঁচিশটি বছর মানবেতরভাবে কাটিয়েছেন আফ্রিকার এক অতি নির্জন দ্বীপের কারাগারে। এক কঠিন সংগ্রামের অব্যাহত ধারায় বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে এবং বর্ণবাদী ধ্যান-ধারণা ও কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের শান্তি ও মৈত্রির বন্ধনে আবদ্ধ করে ম্যান্ডেলা উন্মোচন করেন এক নয়া দিগন্ত। বস্তুত এখানে কালোদেরই বিজয় অর্জিত হয়েছে। এই ঐতিহাসিক বিজয় কালো ক্রীড়াবিদদের জীবনেও আশির্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। অবশ্য অন্যায় অনাচারের কবল থেকে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তি মিললেও পরোক্ষভাবে নানা কায়দায় তাদের আজও হয়রানী হতে হচ্ছে।

ছন্দের যাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর মানব জাতি কবিতায় লিখেছেন,“কালো আর ধল বাহিরে কেবল, ভিতরে সবার সমান রাঙা।” কবির এই উপলব্ধি বাস্তবে অনেকটাই ম্লাণ হয়ে যায় যখন মানব সভ্যতার আয়নায় ভেসে ওঠে বর্ণ-বৈষম্যের প্রকট রূপ। ইতিহাসের সেলুলয়েডে যখন দেখা যায় শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা র্কষ্ণাঙ্গদের নির্যাতনের দৃশ্য। কালোদের ওপর সাদাদের নির্যাতন আর কালোদের বঞ্চনার অব্যাহত ধারায় ধরা পড়ে- আসলে সব মানুষের ভেতোরটা সমান রাঙা নয়। এ প্রসঙ্গে এক ক্যারিবীয় কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার ক্রিস্টোফারের ভাষ্য হচ্ছে, ‘শ্বেতাঙ্গরা বাইরে রাঙা হলেও তাদের ভেতোরটা বড়ই কুৎসিত আর কদাকার। আবার কৃষ্ণাঙ্গদের চামড়া কালো হলেও তাদের ভেতোরটা পরিস্কার। সাদারা সব সময়ই কালোদের অপছন্দ করে, তারা সব সময়ই চায় কালোদের দমিয়ে রাখতে। আসলে কালোদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে তারা এক ধরনের মনস্তাতিক সুখ লাভ করে।’

চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, মানুষের ত্বকের নিচে ‘মেলানোসাইট’ নামে এক ধরনের কোষ পাওয়া যায়, যা থেকে নিঃসৃত হয় ‘মেলানিন’। আর এই মেলানিন যার যতো বেশী নিঃসৃত হবে সে ততো বেশী কালো হবে। ত্বকের নিচের এই মেলানিনই হচ্ছে কালোদের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। এই অভিশাপ তারা প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত। আর এই অভিশাপের প্রায়শ্চিত্য করছে তারা সাদাদের নির্যাতনের শিকার হয়ে। আগেও বলেছি, অন্য সব ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও কালোদের নির্যাতনে ইতিহাস সুদীর্ঘ আর মর্মভেদী। এখানেও রয়েছে সাদা কর্তৃক কালোদের ঠ্যাঙ্গানোর অজস্র ঘটনা। আর এই বর্ণ-বৈষম্যের কারণেই বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা ছিলো অনেকদিন নির্বাসিত।

খেলাধুলায় কালোদের পারদর্শিতা নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গরা খেলাধুলায় কেন এতো পারদর্শী? তারা কি বেশী বুদ্ধিসম্পন্ন? অনেকের মতে, ক্রীড়াঙ্গনে কালোদের সাফল্য তাদের জিদ্দি মনেরই বহিঃপ্রকাশ। আবার কারো মতে, শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করে বঞ্চনার যথাযথ জবাব দিতেই তারা বদ্ধপরিকর। এ সম্পর্কে অলিম্পিকের সোনার মেয়ে, সর্বকালের সেরা কৃষ্ণকলি এ্যাথলেট জ্যাকি জয়নার কার্সি বলেছেন, ‘কৃষ্ণাঙ্গদের খেলাধুলায় পারদর্শিতার কারণ তিনটি,  ১. খেলাধুলার জন্য জীবনকে উৎসর্গীকরণ, ২. দৃঢ় সংকল্প, ৩. উচ্চাকাঙ্খা’। কার্সি আরো বলেন, ‘শুধু কৃষ্ণাঙ্গই নয়, এই তিনটি গুণ যদি যে কোনো ক্ষেত্রের যে কোনো ব্যক্তির মধ্যে থাকে তবে তার জীবনে সাফল্য আসতে বাধ্য’।

আর একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীড়াবিদ আন্দ্রেঁ ডসন বলেন,‘তুমি যদি একজন কৃষ্ণাঙ্গ এ্যাথলেট হও তা হলে তোমার মনের মধ্যে এক ধরণের তাড়না কাজ করবে- যা তোমাকে কখনো দ্বিতীয় হতে দেবে না। অর্থাৎ তোমাকে প্রথম হতেই হবে, আর এ জন্য তোমাকে করতে হবে কঠোর পরিশ্রম।’

কালোদের আলোয় আলোকিত বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন

কালোদের আলোয় আলোকিত বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন

একজন সফল কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়ের অনুশীলন প্রক্রিয়ার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে স্পষ্টত:ই দেখা যায় আসলে তারা কতোটা পরিশ্রমী। কতোটা জিদ্দি। কার্ল লুইস, জেসি ওয়েন্স, মোহাম্মদ আলী কিংবা পেলেদের জীবনের ওপর দৃষ্টিপাত করলেই পরিস্কার হয়ে যায়, তাদের বিশ্ব জয়ের সাফল্য কতোটা জেদ, কতোটা পরিশ্রম আর কতোটা সাধনার ফসল। ফুটবল, ক্রিকেট, বাস্কেট বল, টেনিস, বক্সিং, এ্যাথলেটিক্স কোথায় নেই কালোদের শ্রেষ্ঠত্ব? কোথায় তারা রাখেনি তাদের নয়নাভিরাম নৈপুণ্যের স্বাক্ষর? আর প্রমিলা ক্রীড়াবিদদের কথা? গেইল ডেভার্স, মারিয়ন জোন্স, জ্যাকি জয়নার কার্সি, গ্রিফিত জয়নার, মার্লিন ওটি, উইলিয়ামস ভগ্নিদ্বয়। ওদের মুখগুলো মনে কি করিয়ে দেয়না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত কবিতাটিকে, “কালো? তা সে যতোই কালো হোক, আমি দেখেছি যে তার কালো হরিণ চোখ।” কবিগুরু তাঁর কৃষ্ণকলিকে দেখেছেন মেঘলা দিনে ময়নাপাড়ার মাঠে,“ঘোমটা তার ছিলো না মাথায় মোটে/ মুক্তবেণী পিঠের ’পরে লোটে”। আর কার্সি, গ্রিফিত জয়নার, মার্লিন ওটিদের মতো কৃষ্ণকলিদের বিশ্বের ক্রীড়ানুরাগীরা দেখেছেন খেলার মাঠে। কবিগুরুর কৃষ্ণকলি গ্রামের এক সহজ-সরলা, চপলা নারী। তারঁ ভাষায়,“ঘন মেঘে আঁধার হলো দেখে/ ডাকতেছিলো শ্যামল দুটি গাই/ শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে/ কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই। আকাশ পানে হানি যুগল ভুরু/ শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।” কবিগুরুর কৃষ্ণকলি যুগল ভুরু তুলে ভীত চোখে কালো মেঘের পানে তাকালেও আজন্ম বঞ্চনার শিকার কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েরা খেলার মাঠে অমীয় তেজী আর অপ্রতিরোধ্য। তাদের দৃষ্টি ভীত নয়; বরং প্রজ্জ্বলিত, ঝরে যেনো প্রতিশোধের আগুন। মন পাথরের মতো প্রত্যয়ী, আর তাদের সুদৃঢ় প্রদীপ্ত পদচারণায় কাঁপে ধরণী। চমকিত হয় প্রতিপক্ষ। তবে কবিগুরুর সেই উপলদ্ধির অসাধারণ বর্ণনা,“কালো? তা সে যতই কালো হোক,/ দেখেছি যে তার কালো হরিণ-চোখ॥” বিশ্ব ক্রীড়ার কালো হরিণ-চোখধারী নারীদের মাঝে শুধু জয় করার প্রত্যয়ই নেই, দেহময় ছড়িয়ে আছে অসামান্য সৌন্দর্য। বলা যায়, কালোর মাঝে জগত আলো করা রূপ। একেক জন যেনো একেকটা ব্লাক ডায়মন্ড। মারিয়ন জোন্স, জয়নার বা ওটিদের চোখের দিকে তাকালে ঐ চোখ নিয়ে কার না কবিতা লিখতে ইচ্ছে করবে। বেঁচে থাকলে ওদের মায়াবী চাহনী নিয়ে কিংবা ওদের কালো দেহের আলোকিত রূপ-সৌন্দর্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ-জীবনান্দ দাশ হয়তো আরো সেরা সব কবিতা লিখতেন।

কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীড়াবিদদের স্বর্ণালী সাফল্যের উৎস খুঁজতে সাদা চামড়াওয়ালারা সদাই ব্যস্ত। খেলার মাঠে ওদের শ্রেষ্ঠত্বকে মেনে নিতে তাদের বড় কষ্ট হয়, মনে বড়ই অপমানবোধ জাগ্রত হয়। তারা নানাভাবে কালোদের গতিরোধ করার প্রয়াস চালায়। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এতে গতিরোধ না হয়ে গতি আরো প্রবল হয়। কালোরা হয়ে ওঠে আরো অপ্রতিরোধ্য। আরো বিস্তার লাভ করে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব। একদিন সত্যি সত্যি সাদার বুকে কালোর দাপট সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। খেলার মাঠে আপন নৈপুণ্যের ঝলক দেখিয়ে কালোরা সাদাদের সন্মান আদায় করে ছেড়েছে। উন্নত বিশ্বের সাদা চামড়ার দেশগুলো আজ কালোদের ওপর নির্ভরশীলই শুধু নয় , আজ আন্তর্জাতিক ক্রীড়াক্ষেত্রে তারা কালোদের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত। তারপরও কি আর মনের নোংরা এতো সহজে মুছে যায়? একটা প্রবাদ আছে, “কয়লা ধু’লে কি আর ময়লা যায়?” এতোসব সত্বেও একটু সুযোগ পেলে কিংবা সুযোগ করে নিতে পারলে সাদারা এখনো কালোদের ল্যাং মারে। এ ক্ষেত্রে কালো চামড়ার সেলিব্রিটিরাও রেহাই পান না।

১৯৯৩ সালের ৮ মে। অলিম্পিকের স্বর্ণকন্যা জয়নার গাড়ি চালিয়ে ফিরছিলেন। এক সময় সিটি পুলিশ কোনো কারণ ছাড়াই তার গাড়ির গতিরোধ করে এবং তাকে গাড়ি থেকে নামায়। এখানেই শেষ নয়, এরপর সাদা চামড়ার সিটি পুলিশ হাতে হাতকড়া পরিয়ে অস্ত্রের মুখে হাঁটু গেড়ে তাকে মাফ চাইতে বাধ্য করে। এ ঘটনার পর জয়নার তার  অভিযোগে বলেন,“আমার বড় অপরাধ, আমার শরীরের চামড়া কালো। আমি কৃষ্ণঙ্গ বলেই পুলিশ আমার প্রতি এমন নির্মম আচরণ করেছে।”

25আসলে এই বৈষম্যমূলক আচরণ আর নির্যাতনই কালোদের মানসিকতাকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লক্ষ্যে অদম্য করে তুলেছে। ফলশ্র“তিতে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীড়াবিদরা এতোটাই প্রতিশ্র“তিশীল ও দৃঢ়চেতা যে, তারা যেনো খেলার মাঠে পরাজয়কে বরণ করে নিতে জানে না। এখানে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতেই তারা বদ্ধপরিকর।

অনেকের মতে, কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীড়াবিদরা জেনেটিক আশির্বাদপুষ্ঠ। তারা জন্মগতভাবে খেলোয়াড়। তাদের জিনে বংশানুক্রমিক খেলোয়াড়ী ধারা বহমান। তবে যে যতো কথাই বলুক আর যেভাবেই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিক না কেন, কিংবা যতো জেনেটিক ব্যাপার-স্যাপারই থাকনা কেনো, সব থেকে বড় কথা হচ্ছে, বঞ্চনার ঘটনাবলী থেকে জন্ম নেয়া মনের জেদই কৃষ্ণাঙ্গদের প্রধান প্রেরণা। একই সাথে কৃষ্ণাঙ্গরা খেলাধুলাকে তাদের দারিদ্র দূরিকরণ এবং সমাজে প্রতিষ্ঠা প্রাপ্তির প্রধান অবলম্বন মনে করে থাকে। তাদের মনে সব সময় একটা ধারণা কাজ করে থাকে আর তা হচ্ছে, ‘তুমি কৃষ্ণাঙ্গ, তাই তুমি কিছুই না, একেবারে মূল্যহীন। আর তুমি যদি কৃষ্ণাঙ্গ ধনী হও তবে তুমি কিছুটা র্সাথক, আর যদি তুমি হতে পারো একজন বড় ক্রীড়াবিদ তবে তো কোনো কথাই নেই, কারণ- ‘স্পোর্টস ইজ বিগ মানি।’

বিশ্ব টেনিসের সোনালী অতীতের বরেণ্য তারকা, পরে এইডস-এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী ব্লাক ডায়মন্ড আর্থার এ্যাশ তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এ হার্ড রোড টু গ্লোরী’-তে কালোদের সাফল্যের উৎস সম্পর্কে বলেছেন,“কঠোর সংগ্রামই হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গদের সাফল্যের উৎস। কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য নিরলস সাধনা ও সংগ্রাম করে থাকে।”

এ প্রসঙ্গে সাবেক এ্যাথলেটিক ডিরেক্টর ও জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান ফুটবল কোচ ভিন্স ডলের ভাষ্য হচ্ছে, “শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্যের কারণেই ক্রীড়াঙ্গনে কৃষ্ণাঙ্গরা এগিয়ে।” তিনি বলেছেন,‘ আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কৃষ্ণাঙ্গরা ক্রীড়ার সব ক্ষেত্রেই বিস্ময়করভাবে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। প্রকৃতির আশির্বাদ ছাড়া যা একেবারেই অসম্ভব।’ অবশ্য এর বেশী কিছু আর বলেননি তিনি।

তবে সুপ্রতিষ্ঠিত লেখক ও পত্রিকা সম্পাদক ফ্রেডেরিক ডগলাস কিন্তু বলেছেন ঠিক তার উল্টো কথা। তার মতে, ‘শুধু শারিরীক শক্তি দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনা যায় না, জয়ের জন্য দরকার হয় তীব্র বাসনা আর কঠোর সংগ্রাম।’ উল্লেখ্য, ডগলাস নিজেও এক সময় দাস ছিলেন।

কেউ বলেন, আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটেই  ক্রীড়াক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গরা হয়ে ওঠে পারঙ্গম। এ ছাড়া একটি প্রগাঢ় বিশ্বাস তাদের মধ্যে কাজ করে, তা হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তা মূলত: তাদের জন্যই খেলাধুলা সৃষ্টি করেছেন। কৃষ্ণাঙ্গদের বিস্ময়কর ক্রীড়াশক্তির ভূয়শী প্রসংসা করেছেন খোদ দুনিয়া কাঁপানো হিটলার। তবে সেটাতে তার মনোভাব পজেটিভ ছিলো না। কালোদের সাফল্যকে তিনি স্বীকার করেছেন বন্য প্রানীর সাথে তুলনা করে। ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীড়াবিদ জেসি ওয়েন্সের নৈপুণ্য দেখে হিটলার বলেছেন, ‘কালোরা মানুষ হলেও খেলাধুলায় এরা অন্যান্য প্রানীর মতো শক্তিশালী।’

শরীরবিদদের মতে, কালোদের দৈহিক কাঠামো খেলাধুলার উপযোগী করেই গঠিত। এদের শরীর সুঠাম এবং উরু দীর্ঘÑ সাফল্য অর্জনের জন্য একজন ক্রীড়াবিদের যা থাকতেই হবে। আর মনোবিজ্ঞানীরা তো বরাবরই বলে আসছেন, শ্বেতাঙ্গদের চাইতে মনের দিক থেকে কৃষ্ণাঙ্গরা অনেক বেশী বলিয়ান। দিনের পর দিন লাঞ্চনা-গঞ্জনার মধ্য দিয়েই তাদের মাঝে গড়ে উঠেছে এই দৃঢ় মানসিকতা।

খেলার মাঠে কৃষ্ণাঙ্গদের বঞ্চনার ইতিহাস দীর্ঘতরোÑ বর্ণ-বিদ্বেষ নীতির অবসান ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে লড়ার জন্য কৃষ্ণাঙ্গদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। শ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়-কর্মকর্তারা কখনোই নিজেদের পাশে কৃষ্ণাঙ্গদের দাঁড়ানোর সুযোগ দিতো না, এমনকি তাদের প্রতি সুবিচার পর্যন্ত করতো না; কিন্তু সেই কৃষ্ণাঙ্গরা যখন নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে একের পর এক শ্রেষ্ঠ আসনের অধিকারী হতে থাকলো তখন তাদের মর্যাদা এবং অর্থ দুই-ই বেড়ে যেতে লাগলো, সেই সাথে দ্রুত অবস্থানের পরিবর্তন সূচিত হলো। কৃষ্ণাঙ্গ বীর ক্রীড়াবিদরা দাস থেকে দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত হলো। যেমন ব্যক্তিগত, তেমনি দলীয়ভাবে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে কালোদের সাফল্য আকাশছোঁয়া। আবার অপর পিঠে তাদের নির্যাতনের ইতিহাসও দীর্ঘ। এই ক্ষুদ্র পরিসরে যেমন বলা যাবেনা তাদের সব সাফল্যের কথা তেমনি তুলে ধরা যাবে না বুকের সব ব্যাথা। তারপরও অন্যদিনের পাতায় কয়েকটি খেলা আর বেশ কিছু বিশ্ববরেণ্য কালো ক্রীড়াবিদের আলো ছড়িয়ে দেয়া হলো।

ব ক্সিং

আলী স্বীয় আলোকে আলোকিত করেছেন বিশ্ব

আলী স্বীয় আলোকে আলোকিত করেছেন বিশ্ব

বক্সিংয়ের সাথে কৃষ্ণাঙ্গদের জড়িয়ে পড়ার পেছনে একটা নির্মম হৃদয়বিদারক ইতিহাস আছে। যুগে যুগে দাসত্ব বা দাসপ্রথা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘিত এই প্রথা বিলোপের কথা তোলা হযেছে অনেক যুগ আগে থেকেই। দাসপ্রথা বহু প্রাচীন প্রথা। উপনিবেশ আমলে কৃষ্ণাঙ্গরা দাস হিশেবে পরিচিত ছিলো। শ্বেতাঙ্গ মালিকরা এই সব দাসদের দ্বারা তাদের বিকৃত মানসিকতা চরিতার্থ করতো। মালিকরা তাদের সব চাইতে শক্তিশালী দাসদের মোরগ যুদ্ধের মতো মুখোমুখি লড়াইয়ে নামিয়ে দিয়ে তা উপভোগ করতো। এই লড়াই দিনে দিনে মুষ্ঠিযুদ্ধে রূপান্তরিত হলো আর কৃষ্ণাঙ্গরা বাধ্যবাধকতায়, নেশায়-পেশায় জড়িয়ে গেলো এর সাথে। শুরুতে এ লড়াই ছিলো এক নির্মম লোমহর্ষক লড়াই। ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত হয়ে যেতো খেলোয়াড়রা। যদিও পরবর্তীতে এর নানা সংস্কার হয়েছে কিন্তু সভ্য সমাজে আজও এই খেলা প্রবলভাবে সমালোচিত। এই বর্বোরোচিত খেলা নিষিদ্ধ করার দাবী আজও অব্যাহত রয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৮৮৪ সালে মার্কুইস অব কুইন্সবেরী অ্যাক্টের আওতায় বক্সিং প্রচলিত হবার পর থেকে আজ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক বক্সার খেলা চলাকালীন সময়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেকের জীবনে পঙ্গুত্বের অভিশাপ তো আছেই। বক্সিং এমন একটি খেলা যেখানে মৃত্যু হচ্ছে নিত্যসাথী। আর শ্বেতাঙ্গ সাহেবরা তাদের কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের এই খেলায় লেলিয়ে দিয়ে মজা পেতো। তারা তাদের কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের এই বলে উত্তেজিত করতো, ‘হয় মারো, নয়তো মরো’। তবে সার্বক্ষণিক উত্তেজনার কারণে দিনে দিনে খেলাটি বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় খেলায় পরিনত হয়। এবং এর সাথে বিপুর অর্থ-বিত্ত আর সন্মানের সংযোগ ঘটে।

বক্সিংয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাস স্বাভাবিকভাবেই গৌরবোজ্জ্বল। আর এ গৌরবকে ম্লাণ করে দেয়া এবং অর্থ-বিত্ত-সন্মান কুক্ষিগত করার লক্ষ্য এবং অঙ্গীকার নিয়ে একদিন  ইর্ষান্বিত শ্বেতাঙ্গরাও রিংয়ে অবতীর্ন হলো। তারা শুধু কৃষ্ণাঙ্গদের রিংয়ের শ্রেষ্ঠত্বই কেড়ে নেয়ার চেষ্টা চালাতে লাগলো না, সেই সাথে নানাভাবে কৃষ্ণাঙ্গদের হেয় করার প্রচেষ্টাও চালাতে লাগলো। একবার একটি ঘটনা ঘটলো, প্রথম আমেরিকান হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন জর্জ গডফ্রে ছিলেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ। এ খেতাব পড়ে চলে যায় শ্বেতাঙ্গদের দখলে। এবং সে সময়ের শ্বেতাঙ্গ চ্যাম্পিয়ন জন সুলিভান এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না করে প্রথম চ্যাম্পিয়ন জর্জ গডফ্রেকে অপমান করেন। এতে কৃষ্ণাঙ্গরা দারুণ মর্মাহত হয়। তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ  জন্ম নেয়। তারা প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে। ১৯০৮ সালে কৃষ্ণাঙ্গ বক্সার জ্যাক জনসন শ্বেতাঙ্গ টমি বার্ণস-এর কাছ থেকে শিরোপা ছিনিয়ে নিলে কৃষ্ণাঙ্গদের মনের জ্বালা মেটে। তবে শ্বেতাঙ্গরা এ লজ্জা ঢাকতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা প্রতিশোধ নিতে অবসরপ্রাপ্ত একজন সাবেক হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নকে রিংয়ে ফিরিয়ে আনে এবং শিরোপাধারী কৃষ্ণাঙ্গ জ্যাক জনসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামায়। কিন্তু এবারও হেরে যায় শ্বেতাঙ্গরা। অটুট থাকে কালোদের শ্রেষ্ঠত্ব।

বক্সিংয়ে শ্বেতাঙ্গরা দু’এক পশলা সাফল্য দেখালেও কখনোই বক্সিংয়ে কালো আধিপত্য খর্ব হয়নি। আর এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় রিংয়ে আবির্ভূত হয়েছেন মোহাম্মদ আলী, জো ফ্রাজিয়ার, জারসি জো ওয়ালকোট, জো লুইস, লে লিওনার্ড, ল্যারি হোমস, হলিফিল্ড,  মাইক টাইসনের মতো বিশ্বসেরা কৃষ্ণাঙ্গ বক্সাররা।

এদের মধ্যে মোহাম্মদ আলী শুধু বক্সিং জগতেই নয়, গোটা ক্রীড়াবিশ্বে আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বিশ্ব ক্রীড়ার এই জীবন্ত কিংবদন্তী আপন নৈপুণ্য দিয়ে যেমন তাবৎ বিশ্বকে বিমোহিত করেছেন, তেমনি বর্বরোচিত খেলা বক্সিংকে শিল্পময় করে তুলেছেন এবং যুগান্তকারী পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এর আকর্ষণ বাড়িয়েছেন। খেলাটির প্রতি মানুষকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছেন। সেই সাথে নিজে পরিণত হয়েছেন আমজনতার ভালোবাসার মানুষে। আমাদের দেশে মোহাম্মদ আলীর পরিচয় মেলে যেনো ঘরের মানুষ হিসেবে। গেলো শতকের সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে যে এগারো জনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে তার এক নম্বরেই আছেন মোহাম্মদ আলী। আলী বিশ্ব হেভিওয়েট বক্সিংয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তিনবার। শিরোপা জিতেছেন সতেরোটি। লড়াই জিতেছেন ছাপ্পান্নটি। প্রপিক্ষকে নক আউট করেছেন সাঁইত্রিশবার। ১৯৬০ সালে তিনি অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হন। বিবিসিও তাঁকে শতবর্ষের সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে পুরস্কৃত করে।

কালো চামড়ার অধিকারী হলেও আলী নিজের যোগ্যতা আর দক্ষতা দিয়ে সাদা চামড়াওয়ালাদের সমীহই শুধু আদায় করে নেননি, সেই সাথে যেনো প্রভুত্বও বিস্তার করেছেন। মোহাম্মদ আলী যখন তৃতীয়বারের মতো বিশ্ব হেভিওয়েট খেতাব জয় করলেন তখন আমেরিকার জনগণ তাঁর মাঝে তাদের ভবিষ্যত প্রেসিডেন্টের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আলী পারকিনসন্স ডিজিজে আক্রান্ত হলে সে স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়। আজ আলী যেনো পঙ্গুত্বের কারাগারে আবদ্ধ এক চঞ্চল প্রজাপতি। অথচ একদিন এই মানুষটিই মুখ, হাত ও পায়ের অবিশ্বাস্য গতির কারণে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আমেরিকার ৪২তম প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম জেফারসন ক্লিনটন আলীকে ‘চিরদিনের জন্য বিশ্বশ্রেষ্ঠ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই কালো আলীর আলোতেই আমেরিকার সাদারা আজ বিশ্বব্যাপী আলোকিত। তবে কালো বলে আলীকেও সহজে ছেড়ে দেয়নি শ্বেতাঙ্গরা। তারা একটা বড়সড় আলী বিরোধী গ্র“পও বানিয়ে রেখেছে। আর এই গ্র“পের অন্যতম একজন নেতা হচ্ছেন মার্কিন সাংবাদিক মার্ক ক্র্যাম। ক্র্যাম ২০০২ সালে প্রকাশিত তার  ’ঘোস্টস অফ ম্যানিলা’ গ্রন্থে আলী সম্পর্কে এমন কোনো বাজে শব্দ নেই যা ব্যবহার করেননি। বইয়ের উপসংহারে মার্ক ক্র্যাম লিখেছেন,‘‘আলী সেইন্ট ফ্রান্সিস অফ আসিসি নন। বরঞ্চ তিনি একজন দ্বৈত মনোভাবাপন্ন, সুবিধাবাদী, অন্যের হাতের পুতুল, নারী লোলুপ, সন্তানদের সম্পর্কে উদাসীন, কাপুরুষ, লোভী, বুদ্ধিহীন এক ব্যাক্তি। তারপরও মিডিয়া এমন একটি মুখসর্বস্ব লোককে নিয়ে মাতামাতি করছে। তাকে যে সব বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে এ সবের আড়ালে তার আসল চরিত্র ঢাকা পড়ে গেছে।” ক্র্যামের এই বক্তব্যে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই প্রবল নিন্দার ঝড় উঠেছিলো। অনেকে বলেছেনÑ আলী জবাব দিতে পারবেন না জেনেই ক্র্যাম তার বইয়ে এ সব কথা লিখেছে। আলী মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করায় ক্র্যামদের আক্রোশ আরো বেড়ে গেছে।

আলী লুইভিল শহরের ওহাইও নদীর তীরে ‘মোহাম্মদ আলী সেন্টার’ গড়ে তুলছেন। বছরে চার লাখ লোক এটা পরিদর্শন করবে। এটা নির্মানে খরচ পড়বে ৬ কোটি ডলার। এ ছাড়া লুইভিল বিশ্ববিদ্যালয়ে আলী ইন্সটিটিউট ফর পিস এন্ড কনফ্লিক্ট রেজুলেশনকে পরিচালনা করবেন। এখানে দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের জন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও স্থাপিত হবে। সবকিছু ঠিকমতো চললে বক্সিংয়ের বাইরে এসব হবে আলীর বড় কীর্তি।

মাইক টাইসন

মাইক টাইসন

বক্সিং জগতে আর একটি জগত কাঁপানো নাম হচ্ছে মাইক টাইসন। যদিও নারী কেলেঙ্কারীর কালিমায় নামটির ওপর কলঙ্কের আঁচড় পড়েছে, তবে শুধু এ কারণে তার বক্সিং নৈপুণ্যকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না।  একেবারে বস্তিঘরে জন্ম এই প্রতিভাধর বক্সারের। শৈশব কেটেছে নিউইয়র্কের রাস্তায় রাস্তায় একে ওকে মারধর করে । আর এই দুরন্তপনার কারণে মাত্র ১৩ বছর বয়সে পুলিশ তাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে নিউইয়র্কের এক সংশোধনী কেন্দ্রে পাঠায়। সেখানেই তার বক্সিং-এ হাতে খড়ি এবং সেখানেই ঘটে তার বক্সিং প্রতিভার বিকাশ। তার এই প্রতিভার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম নামী বক্সিং প্রশিক্ষক কাস ডি অ্যামেটো নিজের তত্বাবধানে নেন টাইসনকে। ব্র“কলিনের বস্তি জীবন থেকে টাইসন উঠে আসে ডি অ্যামেটোর বাসগৃহে। এ গৃহে অ্যামেটো তার বান্ধবী ক্যামিল ইওয়ারের সঙ্গে লিভ টুগেদার জীবন যাপন করতেন। এদের দু’জনের ভালোবাসা আর প্রশিক্ষনে গড়ে উঠতে থাকে টাইসন। অ্যামেটোকে বাবা এবং ক্যামিলকে মা বলে ডাকতো সে।অ্যামোটোর ক্ষুরধার প্রশিক্ষনে টাইসন একজন পরিপূর্ণ মুষ্ঠিযোদ্ধায় পরিণত হয়ে মাত্র ২৫ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালে সে সময়ের হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন ট্রেভর বারবিককে নকআউট করে বিশ্বেরর সর্বকনিষ্ঠ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌবর অর্জন করেন। তারপর রিংয়ের ভেতোরে-বাইরে শুরু হয় তার সাফল্যের ইতিহাস। একে একে টাইসনের কাছে ধরাশায়ী হতে থাকে বিশ্বের সেরা সব বক্সার। একদিন টাইসন হয়ে ওঠেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আকাশ ছোঁয়া খ্যাতি, অর্থ, যশ তাকে রাতারাতি তুলে আনে বিশ্ব-শিরোনামে। অত্যন্ত ঝলমলে ক্যারিয়ারের অধিকারী হয়েও নারী কেরেঙ্কারীর কারণে টাইসন অনেকের কাছেই আজ অপ্রিয়।

লায়লা আলী

লায়লা আলী

বক্সিং মানেই পৌরুষের উদ্যাম প্রকাশ আর শক্তিমত্তা ফুটিয়ে তোলার অপূর্ব এক শিল্প, এতোদিন তেমনটিই মনে করা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সে ধারণা মিথ্যে প্রমানিত করেছেন কৃষ্ণকন্যা লায়লা আলী। নারীরাও যে এই খেলার শিল্পময় রূপকে আরো সৌন্দর্যময় করে তুলতে পারে, এর আকর্ষণ বাড়াতে পারে, একটা বলিষ্ঠ নতুন ধারা সৃষ্টি করতে পারে, কিংবদন্তী বক্সার মোহাম্মদ আলী তনয়া লায়লা তা প্রমান করেছেন। আজ বক্সিং রিং-এ নারীর ছন্দময় উদ্দামমুখর উপস্থিতি বক্সিংকে এনে দিযেছে নতুন মাত্রা। এখন দর্শকের ঢল নামে প্রমিলা বক্সিংয়ের লড়াইয়ে। মুগ্ধ চোখে দর্শকরা উপভোগ করে রঙ্গিন প্রজাপতিদের চোখ ধাঁধানো লড়াই। অথচ মেয়েদের পেশাদারী বক্সিংয়ের ব্যাপারটা চার-পাঁচ বছর আগেও সেভাবে কেউ ভাবেনি। ছোটবেলা থেকেই বক্সিং পরিমন্ডলে মানুষ লায়লা আলী বিজনেস ম্যানেজম্যান্টের ওপর উচ্চতর ডিগ্রী নিলেও সব সময় মনে লালন করে আসছিলেন পেশাধারী বক্সার হওয়ার স্বপ্ন। ১৯৯৯ সালের ৮ অক্টোবর ভেরোনার টার্নিং স্টোন ক্যাসিনোতে এপ্রিল ফাউলারের বিরুদ্ধে বক্সার হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। এরপর টানা পনের ম্যাচে অপরাজিত থেকে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বোদ্ধাদের মতে, তার ম্যাচগুলো যে কোনো পুরুষ বক্সারের ম্যাচের তুলনায় অনেক বেশী উত্তেজক ও উপভোগ্য। তার পারফরমেন্স নারী-পুরুষ উভয় দর্শকদেরই আলোড়িত করে এবং আনন্দ দেয়। রিংয়ে তার উত্তাল আগ্রাসি মনোভাব এবং দ্রুত ফুটওয়ার্ক প্রমিলা বক্সিংয়ে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। লায়লা এখন বিশ্ব ক্রীড়ায় অন্যতম সফল এক ক্রীড়াবিদের নাম। তার প্রতিটি লড়াইয়ে টিকিটের দামও আকাশ ছোঁয়া। সেরেনা, ভেনাস ও অন্যান্য প্রমিলা ক্রীড়াবিদদের হারিয়ে আমেরিকায় বিআইটি’র ২০০২ সালের সেরা মহিলা ক্রীড়াবিদের সন্মান জয় করেছেন তিনি। অর্জন করেছেন দি ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্ল্ড বক্সিং ফেডারেশন সুপার মিডলওয়েট চ্যাম্পিয়ন ট্রফি, দি ইন্টারন্যাশনাল এসেসিযেশন বক্সিং ফেডারেশন সুপার মিডলওয়েট চ্যাম্পিয়ন ট্রফি, দি উইমেন্স ইন্টারন্যাশনাল বক্সিং এসোসিয়েশন সুপার মিডলওয়েট চ্যাম্পিয়ন ট্রফি। লায়লা আলীর শিল্পসুষমাময় প্রদর্শনী আলীর মতোই বাড়িয়েছে বক্সিংয়ের আকর্ষন। সেই সাথে নির্মিত হয়েছে কালোদের আর একটি সুউচ্চ মিনার।

ফু ট ব ল

29ফুটবলেও কৃষ্ণাঙ্গদের আধিপত্য ও যাদুকরী নৈপুণ্য বিস্ময়কর। ব্রাজিলিয়ান কৃষ্ণাঙ্গ, হত-দরিদ্র ঘরের সন্তান পেলের চামড়া কালো হলেও তার আলোকে আলোকিত হয়েছে বিশ্ব। কালো চামড়ার কারণে একদিকে যেমন তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের প্রেরণা হয়ে দেখা দিয়েছেন, অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গদের বুকে ধরিয়েছেন জ্বালা । পেলে তাঁর যাদুকরী ফুটবল নৈপুণ্য দিয়ে শুধু বিশ্ব ফুটবলের রাজার আসনটিই দখল করে নেননি সেই সাথে তাবৎ বিশ্বের ভালোবাসার মানুষে পরিনত হয়েছেন। পেলের চামড়া কালো তাই তার আর এক নাম ‘কালো মানিক’। বিশ্ব ফুটবলে পেলের নাম লেখা রয়েছে স্বর্ণাক্ষরে। প্রতিটি দেশের মানুষের কাছে পেলে যেনো একেবারে ঘরের মানুষ। গেলো শতকের সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে যে এগারো জনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে তার দু’নম্বরেই আছেন এই কালো মানিক। তিনি তিনবার বিশ্বকাপ জয় করেছেন ব্রাজিল দলের হয়ে। ফুটবলে তাঁর শৈল্পিক নৈপুণ্য রূপকথার মতো আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ১৯৫৮ সালে তিনি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার লাভ করেন। অবসর নেবার আগ পর্যন্ত তিনি ১৩৬৩টি আন্তর্জাতিক খেলায় গোল করেছেন ১২৮১টি। এটি একটি অুুলনীয় রেকর্ড।

বিশ্ব ফুটবলে কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাস সমৃদ্ধ হলেও তাদের বঞ্চনার ইতিহাসও কম পীড়াদায়ক নয়। সাদারা তো সে সময় কালোদের মাঠের কাছেই ঘেঁষতে দিতো না। বর্ণ-বৈষম্যের শিকার কৃষ্ণাঙ্গদের এক  ‘ব্লাক পার্ল’ হচ্ছেন লেয়ানেদ্রা আন্দ্রাস। দারিদ্রক্লিষ্ট, অবহেলিত এই কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার নিজের লাঞ্চনা-বঞ্চনাভরা ছেলেবেলার কথা ভোলেননি কখনো। ১৯০৭ সালে ছয় বছরের রোগা লিকলিকে এ বালক দূর থেকে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে সাহেবদের খেলা দেখতো। সে সময় কালোদের ফুটবল মাঠে ঢোকা তো দূরের কথা, মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখার অধিকারটুকুও ছিলোনা। আর এই বঞ্চনাই আন্দ্রাসের মনে জন্ম দেয় নিজেকে গড়ে তোলার জিঘাংসা। দিনে দিনে তিনি পরিনত হন এক শিল্পময় ফুটবলারে। আন্দ্রাস ১৯২৪ ও ১৯২৮ সালে অলিম্পিক জয়ী এবং প্রথম বিশ্বকাপ জয়ী উরুগুয়ে দলের সদস্য ছিলেন। বিশ্লেষকদের মতে, ফুটবল খেলাকে তিনি শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেন। যে সব ক্রীড়াবিদ স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ক্রীড়াক্ষেত্র থেকে অবসর নিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে কিংবা প্রতিশোধ নিতে হাজির হয়েছেন রাজনীতির মঞ্চে, আন্দ্রাস তাদেরই একজন। ফুটবল থেকে অবসর নেবার পর ১৯৪২ সালে তিনি উরুগুয়ের সিনেটর নির্বাচিত হন। কালোদের পক্ষে দিনে দিনে তার ভূমিকা প্রবলতরো হয়ে উঠলে ১৯৫৬ সালে তাকে মেরে ফেলা হয়। কালো মানিক পেলেও ব্রাজিলের রাজনীতিতে পা রাখেন এবং সে দেশের ক্রীড়ামন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন। পরবর্তীতে ধারাভাষ্যের স্বার্থে পদটি ছেড়ে দেন।

15ফুটবলে দিনে দিনে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রভাব-প্রতিপত্তি দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। আফ্রিকান ফুটবলের কালো মানিকরা এখন ইউরোপের প্রধান টার্গেটে পরিনত হয়েছেন। বিশ্বের সেরা দলগুলো প্রতিভাবান কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারদের প্রয়োজনে নাগরিকত্ব দিয়ে দলে রাখছে। আজকের বিশ্বফুটবলের শীর্ষ সাড়িতে সম্ভবত হাতে গোনা কয়েকটি দেশ আছে যাদের দলে কালো ফুটবলার  নেই। ফুটবলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের জন্য অফুরন্ত দম, দৈহিক শক্তি এবং দুরন্ত গতি দরকার আর এর সব কিছুই রয়েছে আফ্রিকান ফুটবলারদের মাঝে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব গুণাবলী আফ্রিকান ফুটবলাররা জন্মসূত্রেই পেয়ে থাকে। আর এই গুণাবলীকে কাজে লাগিয়ে আফ্রিকায় তৈরী হচ্ছে অনেক স্টার-সুপারস্টার ফুটবলার।

আফ্রিকানদের দক্ষ ফুটবলার হয়ে গড়ে ওঠার ইতিহাস খুব বেশীদিনের নয়, ’৫৮, ’৬২ এবং ’৭০-এর বিশ্বকাপে কালো চামড়ার পেলের অভূতপূর্ব নৈপুণ্য আর আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা অর্জন করে বিশ্ব তারকায় পরিনত হওয়াটা আফ্রিকান ব্ল্যাকম্যান বা কালো মানুষগুলোকে বেশ প্রভাবিত করে । আর পেলের অনুকরণের ফলে ল্যাটিন আমেরিকার শিল্পময় ফুটবল ঢুকে পড়ে আফ্রিকায়। এর পাশাপাশি চলে ইউরোপিয়ান স্টাইলও। বর্তমানে আফ্রিকান ফুটবলের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে ইউরোপিয়ান প্রভাবে। তবে ল্যাটিন আমেরিকার প্রভাব যে একেবারে নেই তা কিন্তু নয়। অপরদিকে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বকাপ ফুটবলে আফ্রিকান দলগুলোর আশাতিত সাফল্য আফ্রিকার ফুটবলের উত্তরণকে দ্রুততর করছে। ১৯৩৪ সালের দ্বিতীয় বিশ্বকাপে আফ্রিকার প্রথম দল হিসেবে মিশর অংশগ্রহণ করে। এরপর এক এক করে খেলে মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনেশিয়া, ক্যামেরুন, জায়ার, নাইজেরিয়া, সেনেগালের মতো দলগুলো। মনে করুন তো নব্বই সালের বিশ্বকাপের ক্যামেরুনকে, আর ক্যামেরুনের সেই রজার মিলাকে। যার ছন্দময় ফুটবল এখনো চোখ বন্ধ করলে দেখতে পায় ফুটবল প্রেমিকরা। সেবার ক্যামেরুনের কালোরা কী তান্ডবই না চালিয়েছিলো বিশ্বকাপের আসরে! চমকপ্রদ পারফরসেন্স দেখিয়ে তারা কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছিলো।

কালোরা বিশ্ব ফুটবলকে অনেকটাই আলোকিত করে রেখেছে

কালোরা বিশ্ব ফুটবলকে অনেকটাই আলোকিত করে রেখেছে

আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলাররা আজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে সারাবিশ্বে। ঢাকা, কোলকাতার লীগেও প্রতি বছর অনেক কালো ফুটবলার আসছেন এবং খেলে যাচ্ছেন। ঢাকার মাঠে এ যাবৎ যে সব কালোরা খেলে গেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, এমেকা ইউজি, চিমা ওকেরী, ক্রিষ্টোফার, লাডিবাবা, ওদিয়াম্বো প্রমূখ। আশির দশকের শুরু থেকে আফ্রিকান ফুটবলারদের দেশ ত্যাগের প্রবনতা লক্ষ্য করা গেলেও ১৯৩৮ সালে এর সূচনাকারী খেলোয়াড় হলেন লার্বী ব্যান বারেক নামের এক আফ্রিকান স্টার ফুটবলার। লার্বীর ফুটবল নৈপুণ্য এতোটাই প্রশংসিত ছিলো যে, চল্লিশের দশকে তাকে ব্রাজিলের লিউনিডাসের সাথে তুলনা করা হতো। ফুটবলে যাদুকরী নৈপুণ্যের কারণে তাকে ‘ব্লাক পার্ল’ বলে ডাকা হতো। মাত্র একুশ বছর বয়সে ফ্রান্সের বিখ্যাত ক্লাব অলিম্পিক মার্সেইলীতে যোগ দিয়ে এই কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার ফুটবল বিশ্বে ঝড় তোলেন। অবশ্য এর আগে ও পরে অনেক আফ্রিকান ফুটবলার খেলেছেন অলিম্পিক মার্সেইলীতে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন গোলরক্ষক অ্যালকাজার, রাহিব জার্মেনী, কার্বিট, আবেদী পেলে প্রমূখ। ঘানা তথা আফ্রিকার বিস্ময়কর প্রতিভা আবেদী পেলে, কলম্বিয়ার অ্যাসপ্রিলা, জর্জ ওয়াহ, এ্যান্থোনী ইয়াবো, থিয়োরে অঁরি প্রমুখ সুপার স্টাররা কালোদের মর্যাদাকে তুলেছেন সুউচ্চ আসনে।

অনেক আফ্রিকান ফুটবলার অতীতে তাদের নৈপুণ্য ঝরিযে জগত আলো করে গেছেন। এদেরই একজন হচ্ছেন পর্তুগালের উপনিবেশ মোজাম্বিকের কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার ইউসেবিও। যাকে বলা হতো পর্তুগালের গোলমেশিন। কারণ তাঁর পায়ের কাজ এবং সঠিক নিশানায় গোল করার দক্ষতা ছিলো মেশিনের মতোই নিখুঁত। অনেকে তাঁকে ‘আফ্রিকান সিংহ’ বলেও সম্বোধন করে থাকে। কেউ কেউ বলে ‘ব্লাক প্যান্থার।’ ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে একটি খেলার চিত্র এখানে তুলে ধরা যাকÑ খেলা হচ্ছিলো পর্তুগালের সাথে উত্তর কোরিয়ার। সে আসরে উত্তর কোরিয়ার ফুটবল যেনো ফুলে-ফেঁপে উঠেছিলো। তারা গ্র“প লীগের খেলায় হারিয়ে দিয়েছিলো দু’বারের বিশ্বকাপ বিজয়ী ইটালীকে, ড্র করেছিলো চিলির সাথে এবং হেরেছিলো রাশিয়ার সাথে। গ্র“পে রানার্সআপ হয়ে তারা কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালের মুখোমুখি হয়েছিলো। ইউসিবিও সমৃদ্ধ পর্তুগালকে শুরুতেই কোনঠাসা করে ফেললো উত্তর কোরিয়া। তিন তিনটি গোল তারা জড়িয়ে দিলো পর্তুগালের জালে। তিন গোল হজম করার পর খেলার আর কি কিছু বাকি থাকে? কিন্তু যে দলে ইউসিবিও রয়েছেন সে দলের শেষ তো রেফারীর শেষ বাঁশি না বাজা পর্যন্ত নির্ধারিত হতেই পারেনা। বিদ্যূতের ঝলকানিতে যেনো উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেন ইফসিবিও। একের পর এক একাই চারটি গোল জড়িয়ে দিলেন কোরিয়ার জালে। এ খেলায় পর্তুগাল জয়লাভ করলো ৫-৩ গোলে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে একে একটি বিস্ময়কর লড়াই হিসেবে চিহিৃত করে থাকেন বোদ্ধারা। এমনি আরো অনেক যাদুকরী নৈপুণ্য দেখিয়েছেন ইউসিবিও তাঁর খেলোয়াড়ী জীবনে। ব্রাজিলের গারিঞ্চা, ডিডিদের অবিস্মরনীয় খেলা ইতিহাসে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।

বিশ্ব ফুটবলে কালোদের দাপট সেই গোড়া থেকেই

বিশ্ব ফুটবলে কালোদের দাপট সেই গোড়া থেকেই

ওদিকে আমেরিকান ফুটবলে কৃষ্ণাঙ্গরা ছিলো বরাবরই উপেক্ষিত এবং বঞ্চিত। বর্ণবাদ সেখানে এতোটাই তীব্র ছিলো যে, সাদারা কালোদের মাঠের কাছেই আসতে দিতোনা। ১৯৪২ সালে ডিউ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ফুটবল খেলা দেখার জন্য কৃষ্ণাঙ্গরা টিকিট কেনার অনুমতি পর্যন্ত পায়নি। অথচ এখন সাদাদের রীতিমতো নির্ভর করতে হচ্ছে আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারদেরই ওপর। আফ্রিকান ফুটবলারদের নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে অনেক সময় দ্বন্ধ-যুদ্ধও হয়ে থাকে। বলা যায় আফ্রিকান ফুটবলাররা এখন পরিণত হয়েছে রপ্তানীযোগ্য সম্পদ হিসেবে। আর বিশ্বের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ে আজ তারা কালো চামড়াকে বিশ্বের দরবারে শুধু মর্যাদাশীল করে তুলছে না, সেই সাথে বিশ্ব ফুটবলকেও করছে পুষ্ট।  বোদ্ধাদের ধারণা, আগামীতে বিশ্ব ফুটবলে খবরদারীকারী ইউরোপের সমস্ত অহঙ্কারকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে পারে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গরা।

তাকানো যাক ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলে চমক সৃষ্টিকারী সেনেগালের দিকে। এ আসরে তারা তাদের সাফল্য দিয়ে বিশ্ব মাতিয়েছিলো। ফুটবলানুরাগীরা বিস্মিত চোখে দেখেছে তাদের অসাধারণ ফুটবল নৈপুণ্য। ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে তখন তাদের অবস্থান ছিলো ৪২-এর ঘরে। ২০০২ বিশ্বকাপের আসরের প্রথম রাউন্ডের প্রথম ম্যাচেই সেনেগালের কালো মানিকরা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে ১-০ গোলে পরাজিত করে তাবৎ বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিলো। শুধু কি তাই, গ্র“পে শক্তিশালী ডেনমার্কের সাথে ১-১ গোলে এবং উরুগুয়ের সাথে ৩-৩ গোলে ড্র করে ৫পয়েন্ট অর্জন করে দ্বিতীয় রাউন্ডে উন্নীত হয়। দ্বিতীয় রাউন্ডে গোল্ডেন গোলের মাধ্যমে সুইডেনকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে। এরপর কোয়ার্টার ফাইনালে তারা গোল্ডেন গোলে তুরস্কের কাছে পরাজিত হয়। অনেকের মতে, এ খেলায় যদি তারা গোল্ডেন গোলে পরাজিত না হতো তবে হয়তো পরর্তীতে সেমিফাইনালে বিশ্বকাপ ফুটবলে ঘটিযে দিতো এক প্রলয়ঙ্কারী ঘটনা। সেনেগালের সালিব দিয়াওয়ের, অঁরি কামরা, এল হাজি দিউফ, বুবা দিউপ, সুলেমান চামারা, হেনরি নামারা, পেপসার প্রমূখ খেলোয়াড়রা বিশ্বকাপে তাদের নৈপুণ্য দিয়ে গোটা বিশ্বকে চমকৃত করেন

ক্রি কে ট

ক্রিকেটেও কালোদের আধিপত্য

ক্রিকেটেও কালোদের আধিপত্য

ক্রিকেটে কৃষ্ণাঙ্গদের বঞ্চনার ইতিহাস আরো বেশী পীড়াদায়ক। ইংল্যান্ডের নাক উঁচু সাহেবরা তো মাঠের আশেপাশে কালো চামড়ার কাউকে দেখলে কুকুরের মতো দুর দুর করে তাড়িয়ে দিতেন। একবার এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে তারা বেধড়ক পিটিয়েছে তাদের খেলা চলাকালীন সময়ে মাঠে প্রবেশ করার জন্য। এমন আরো কতো যে নির্যাতনের কাহিনী রয়েছে ক্রিকেটের ইতিহাস জুড়ে তা কে বলতে পারে।

কালোরা ক্রিকেট বল বা ব্যাট স্পর্শ করলেই তা যেনো নোংরা হয়ে যাবেÑ এই ছিলো সাদা চামড়ার সাহেবদের অভিব্যক্তি। আর মাঠে কালোদের সাথে খেলতে নামা তো জাত-ধর্ম যাওয়ার মতো। নানা বঞ্চনার শিকার হয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের মনে জিঘাংসা প্রজ্জ্বলিত হয়। তারা একাগ্র সাধনা আর কঠোর প্রত্যয়ে সাদাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। সাদাদের অবহেলা আর বঞ্চনার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে হয় বদ্ধপরিকর। ফলশ্র“তিতে দিনে দিনে তারা নিজেদের তিলে তিলে গড়ে তুলে এমন একটা অবস্থানে পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়, যাকে ক্রিকেট বিশ্লেষকরা ‘সাদার বুকে কালোর দাপট’ বলে চিহিৃত করে থাকেন। একদিন এ দাপট রীতিমতো রাজত্বে পরিনত হয়। কালোদের অদম্য ইচ্ছার বলি হয় সাদারা। ক্রিকেটের সূতিকাগার ইংল্যান্ডের মতো শ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্রে কালোরা আজ বীরদর্পে চলমান। কালো চামড়ার আলোতে ক্রিকেট যখন আলোকিত তখন সাদারা ক্রমেই ফুরিয়ে যাচ্ছিলো, আর এই বোধদোয় থেকেই একদিন তারা লাজ-লজ্জা ঝেরে ফেলে শরনাপন্ন হয় কালোদের। নিজেদের ক্রিকেটকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে তারা কালোদের ব্যবহার করতে উদ্যোগী হয়। এবং এই কালোদের ওপর ভর করেই সাদাদের দেশ ইংল্যান্ড বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে বহুবার ঝড় তুলেছে। ফলে ইংল্যান্ডের ক্রীড়াঙ্গনে কালোদের গুরুত্ব দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। ইংল্যান্ড ক্রিকেট টীমের হয়ে এ যাবৎ বেশ কিছু সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার মাঠে নেমেছেন। কাউন্টি লীগে তো এদের কদরই আলাদা। ইংল্যান্ডের হয়ে মাঠে নামা প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় হলেন রোনাল্ড ওয়ালান্ডো বুচার। ১৯৮০-৮১ মৌসুমে এই কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার ইয়ান বোথামের নেতৃত্বে নিজ দেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর করেন। তিনটি টেস্ট ও তিনটি ওয়ানডে ম্যাচে অংশ নিয়ে তিনি ১৪.২০ গড়ে ৭১ রান করেছিলেন। কাউন্টি ক্রিকেটে তিনি ছিলেন মিডল সেক্সের খেলোয়াড়। এরপর একে একে জর্জ কাওরানস, উইফ্রেড বোরিস স্লাক, গ্লাডষ্টোন স্মল, ডিফ্রেটাস, মন্টি এ্যালান লিক্স, ডেভিড ম্যালকম, ক্রিস লুইস, ফিটজেরাল্ড উইলিয়াম প্রমূখ কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়রা ইংল্যান্ড দলের হয়ে খেলে দুর্দান্ত নৈপুণ্য উপহার দেন।

বিশ্ব ক্রিকেটে ক্যারিবীয় কালোদের রাজত্বের কথা তো সকলেরই জানা। কে না জানে গ্যারী সোবার্স, ভিভ রিচার্ডস, ক্লাইভ লয়েড, ডেসমন্ড হেইন্স, কার্টনি ওয়ালশ, ম্যালকম মার্শাল, রিচার্ডসন, লারা, চন্দরপলদের নাম? দলীয় পারফরমেন্সে সাফল্যের ধারাবাহিকতা আজ কিছুটা ম্লান হলেও একদিন এই ক্যারিবীয়দের নামে কেঁপে উঠতো ক্রিকেট বিশ্ব। টেস্ট ও ওয়ানডে দু’ক্ষেত্রেই তাদের ছিলো সমান আধিপত্য। ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বকাপ বিজয়ী এই দলটি টেষ্ট ক্রিকেটের আঙ্গিনায় পা রাখে ১৯২৮ সালে। এর পরপরই তারা অভিষেক টেস্ট খেলে ইংল্যান্ডের সাথে। সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর করে ইংল্যান্ড। অবাক লাগলেও সত্যি যে, ঐ সময় নির্বাচকরা অভিষেক টেস্ট দলের অধিনায়ক হিসেবে ৫১ বছর বয়স্ক শ্বেতাঙ্গ স্যার হেরাল্ড ব্র“স গার্ডেনার অস্টিনের নাম ঘোষনা করেন। কিন্তু অভিজ্ঞ অস্টিন নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন। পরে রবার্ট নুনেজের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইংল্যান্ডে যায় এবং তিন টেস্ট সিরিজের প্রতিটিতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে সিরিজ হারে।  ১৯২৯-৩০ সালে ইংল্যান্ডে খেলতে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজে। ৪ টেস্টের সিরিজ হারলেও তারা জর্জ টাউন টেস্টে জয় পায়। ক্যারিবীয়দের টেস্ট ইতিহাসে সেটাই হচ্ছে প্রথম জয়। ঐ টেস্টে তারা ইংল্যান্ডকে ৯৯ রানে পরাজিত করে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সিরিজ জয করতে খুব বেশী অপেক্ষা করতে হয়নি ক্যারিবীয়দের। ১৯৩৪-৩৫ সালে ইংল্যান্ড ৩ টেস্টের সিরিজ খেলতে আবার ওযেস্ট ইন্ডিজ সফরে আসে। সিরিজের প্রথম টেস্টে হেরে গেলেও পরবর্তী দুই টেস্টে জ্যামাইকা ও ত্রিনিদাদে জয়লাভ করে প্রমবারের মতো সিরিজ জয়ের স্বাদ পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত ক্যারিবিয়ানের কিছু দ্বীপের শ্বেতাঙ্গ খেরোয়াড় নিয়েই মূলত দল গড়া হতো। মাঝে মাঝে কিছু এশিয়ানকেও দলে নেয়া হতো। তবে এ অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে জর্জ হ্যাডলির অধিনায়কত্ব লাভের পর। সে সময় থেকেই স্থানীয় লীগগুলোতে কৃষ্ণাঙ্গরা খেলার সুযোগ পেতে থাকে। তবে এ সময়টাতে কালোদের নানাভাবে বঞ্চিত করা হয়। ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হলো ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কন্ট্রোলিং অব ক্রিকেট (ডব্লিউআইসিবিসি)। ১৯৫৯ সালে বোর্ড চালু করলো গোটা ওয়েস্ট ইন্ডিজ জুড়ে ‘ক্যারিবীয় ক্রিকেট লীগ’। ১৯৬০ সালে বার্বাডোজের সন্তান ফ্রাঙ্কওরেল ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়কত্ব লাভ করলে তিনি দলে ১০জন কৃষ্ণাঙ্গকে স্থান দেন। সাদা চামড়ার খেলোয়াড় ২জন এবং এশিয়ান ছিলেন ৫জন। বিশেষ করে ওয়েস হল, চার্লি গ্রিফিত ও রয় গিলক্রাইস্টকে নিয়ে গঠিত ফাস্ট বোলিং ডিপার্টমেন্টটি ছিলো পুরো কৃষ্ণাঙ্গদের দখলে ফলে শ্বেতাঙ্গদের দীর্ঘ কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। এখানে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করা যায আর তা হচ্ছে, সবচেযে বঞ্চিত ও উপেক্ষিত বার্বাডোজ ও জ্যামাইকা থেকে দলে স্থান পেলো একঝাঁক তারুণ্য প্রদীপ্ত ক্রিকেটার।এদের মধ্যে ছিলেন ওরেল, ওয়ালকট, উইকস, বুচার, হল, গ্রিফিত, গিলক্রাইস্ট, সোবার্স, ভ্যালেন্টাইন।

6১৯৬৫ সালে অধিনায়কত্ব লাভ করলেন ত্রিনিদাদের কৃতি সন্তান গ্যারী সোবার্স। এই সোবার্সই ঘটালেন এক বিপ্লব। তিনি দলে একজনও শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটারকে স্থান দিলেন না।  এরপর ক্লাইভ লযেড এলেন, তিনিও সোবার্সের পথ অনুসরণ করলেন। তিনি কালোদের শেখালেন বিজয়ের মন্ত্র। আর এই মন্ত্রই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের নিয়ে গেলো সাফল্যের স্বর্ণশিখরে। তাদের মাথায় শোভা পেলো একই সাথে বিশ্বকাপ ও অপরাজিত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব। ওরা হয়ে উঠলো অপ্রতিরোধ্য। যদিও লয়েড দলে সান্ত্বনাসূচক দু’জন শ্বেতাঙ্গ (জেফ দুজো ও ল্যারীগোমেজ) রেখেছিলেন তবে তার ব্লাক পাওয়ার পলিসিই কালোদের তুলে নিয়ে গেছে সুউচ্চ শিখরে।

অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে সাদা চামড়ার ক্রিকেট কুলিনদের বিরুদ্ধে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কালোদের ছিলো আকাশ সমান ক্ষোভ আর ঘৃনা। কালো বলে বর্ণবিদ্বেষী ব্রিটিশরা তাদের নানাভাবে বঞ্চিত ও নির্যাতিত করতো। মনের ভেতোর প্রজ্জ্বলিত প্রতিহিংসা দিনে দিনে ক্যারিবীয় ক্রিকেটকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। সাদাদের বঞ্চনা আর নির্যাতনের জবাব দিতেই ক্যারিবীয় ক্রিকেটাররা অদম্য মনেবলে নিজেদের গড়ে তুলতে থাকে। এবং ১৯৭৫ সালে তারা সাদাদের মাটিতেই ক্রিকেটের তীর্থভূমি লর্ডসে বিশ্বের সেরা সব শক্তিকে পরাভূত করে জয় করে প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেটের শিরোপা। ফাইনালে আর এক কুলিন, প্রচন্ড বর্ণবিদ্বেষী জাতি অস্ট্রেলিয়া কালো লয়েড বাহিনীর ব্যাটিং ও বোলিংয়ের ঝড়ো তান্ডবে ধরাশায়ী হলে শ্বেতাঙ্গ প্রভূদের একেবারে বুকের ওপর পতপত করে উড়তে থাকে এক সময়ের ভৃত্য বিবেচ্য কৃষ্ণাঙ্গদের বিজয় নিশান। ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোর ছিলো ৮ উইকেট হারিয়ে ৬০ ওভারে ২৯১, আর অষ্ট্রেলিয়ার স্কোর ছিলো সবক’টি উইকেট হারিয়ে ৫৮.৪ ওভারে ২৭৪। ১৭ রানে বিজয়ী হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ব্যক্তিগত ১০২ রানের সুবাদে ফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন ক্যারিবীয় অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড। অষ্ট্রেলিয়া দলের নেতৃত্ব দেন ইয়ান চ্যাপেল। যিনি সব সময়ই কালোদের খাটো করে দেখে থাকেন। এর পরের বিশ্বকাপটিও অনুষ্ঠিত হয় ইংল্যান্ডে ১৯৭৯ সালে। এ আসরেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের নেতৃত্ব দেন ক্লাইভ লয়েড এবং দলটি দ্বিতীবারের মতো জয় করে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। এ আসরে তারা ফাইনালে পায় এক সময়ের প্রভু খোদ ইংরেজদের।  রক্তে যেনো নাচন জাগে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের। চূড়ান্ত লড়াইয়ে ৯২ রানের বড় ব্যাবধানে তারা সাহেবদের নাক কেটে কালোদের বিজয় পতাকা গেঁথে দেয় সাদাদের বুকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোর ছিলো ৬০ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে ২৮৬ আর ইংল্যান্ডের ৫১ ওভারে সব ক’টি উইকেট হারিয়ে ২৯৪। কৃষ্ণকুমার জুয়েল গার্নার ৩৮ রানে ৫ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডের ড্রেসিং রূমকে শবাগারে পরিনত করেন। ইংল্যান্ড দলের নেতৃত্ব দেন মাইক ব্রিয়ারলি। প্রকৃতির কি বিচিত্র লীলা, পরপর দুটো আসরে দুই কুলিন বিধ্বস্ত!

ক্রিকেটের বরপুত্র ব্রায়ান লারা

ক্রিকেটের বরপুত্র ব্রায়ান লারা

শুধু কি তাই, বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা সব রেকর্ডগুলো গেঁথে আছে এই সব নামের পেছনে। অতি সম্প্রতি টেস্ট ক্রিকেটে লারার ৪০০ রানের বিশ্ব রেকর্ড হতবাক করেছে তাবৎ বিশ্বকে।  রেকর্ডে-নৈপুণ্যে এই কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার আজ এতোটাই সমৃদ্ধ যে, তাকে বলা হয়ে থাকে ‘ক্রিকেটের কৃষ্ণ রাজকুমার’। আর এই রাজকুমারের ঝলমালে সব ইনিংস ফ্রেমে বেঁধে রাখার মতোই। কখনো কালো মেঘ তার ক্যারিযারে ভর করলেও এখনো তিনি বিশ্ব ক্রিকেটকে শাসন করে চলেছেন রাজকীয় চালেই।

সব থেকে বড় কথা হচ্ছে, যে শ্বেতাঙ্গরা একদিন এই খেলাকে নিজেদের সম্পত্তি মনে করতো, যারা কৃষ্ণাঙ্গদের মাঠের ত্রিসীমানায় আসতে দিতো না সেই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেই লারা করেছে এই বিশ্ব রেকর্ড। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে এর আগে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ৩৭৫ রানের ইনিংটি ৯৩-৯৪ মৌসুমে লারা খেলেছিলেন এই নাকউঁচু ইংলিশদের বিরুদ্ধেই। এরপর ২০০৩-০৪ মৌমুমে ৩৮০ রান করে সে রেকর্ড ছিনিয়ে নেন অষ্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান ম্যাথু হেইডেন। কিন্তু ২০০৪ মৌসুমেই মাত্র ছ’মাসের ব্যবধানে ৪০০ রানের ইনিংস হাঁকিয়ে এমন দাপটের সাথে পুনরায় সেই মুকুট লারা ছিনিয়ে নিলেন যে, তার খুনে ব্যাট যেনো কঠিন ভাষায় হেইডেনকে বললোÑ‘এ মুকুট কেবল আমার মাথাতেই শোভা পায়।’ হেইডেন হচ্ছেন অষ্ট্রেলিয়ান শ্বেতাঙ্গ। অষ্ট্রেলিয়ানরা সব সময়ই অহঙ্কারী জাতি। বড় বেশী বর্ণ-বিদ্বেষী এরা। খেলার পাশাপাশি কালো চামড়াধারীদের নানাভাবে হেয়, অপদস্ত করাটাও যেনো তাদের দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পিছিয়ে নেই। এই তো ২০০৪ সালেই শ্রীলঙ্কান কৃষ্ণাঙ্গ সুপার স্টার ক্রিকেটার মুত্তিয়া মুরালিধরনকে ‘চাকার’ বলে বাজে রকম মন্তব্য করেছেন তিনি আর এর কারণে অষ্ট্রেলিয়া সফরে দল গেলেও মুরালী নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন। উল্লেখ্য, এই কালো চামড়ার মুরালী এখন বিশ্বের সেরা বোলার। আর এই ব্লাক প্যান্থারের প্রধান প্রতিপক্ষ হচ্ছেন শ্বেতাঙ্গ অষ্ট্রেলিয়ান শ্যেন ওয়ার্ণ।  শুধু কি বাজে রকম সমালোচনা-, মুরালীকে নানাভাবে হেনস্থা করতেও ছাড়ছেনা শ্বেতাঙ্গরা। এমনকি তারা তার ক্যারিয়ার ধ্বংসের প্রচেষ্টাও কম করছে না। তার বোলিং এ্যাকশনকে একাধিকবার পরীক্ষার সামনে দাঁড় করানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অষ্ট্রেলিয়ার শ্বেতাঙ্গদের ভুমিকাই বেশী। কেননা, কালো মুরালীকে সরাতে পারলে সাদা শ্যেন ওয়ার্ণের পথ পরিস্কার হয়ে যায়। মুরালী এখন বিশ্বের এক নম্বর বোলারÑ এই সত্যটাকে মেনে নিতেই সাদাদের যেনো বড় কষ্ট।

এদিকে চলতি বছরের ৭ সেপ্টেম্বর আইসিসি একটি বিশ্ব একাদশ ঘোষণা করে যেখানে বিশ্বের এক নম্বর বোলার হওয়া সত্ত্বে মুরালী নেই! এক নম্বরকে বাদ দিয়ে আইসিসি’র বিশ্ব একাদশ হয় কি করে? প্র্রশ্ন তুলেছে ক্রিকেট বিশ্ব। অপরদিকে সাজাভুক্ত এবং সারা বছর মাঠের বাইরে থাকা শ্যেন ওয়ার্ন ঠিকই স্থান পেয়েছেন ঐ দলটিতে। সচেতন মহল একে সাদা চামড়া প্রীতির আর এক দৃষ্টান্ত বলে মনে করছে। এ সম্পর্কে মুরালী তার ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় বলেছেনÑ‘এটা একটা পক্ষপাতিত্বের নিন্দনীয় নজির। অবশ্য হাস্যকরও বটে। আমাকে বর্ষসেরা চার খেলোয়াড়ের তালিকায় রাখা হয়েছে অথচ দলে রাখা হয়নি!’ বিবেচ্য সময়টাতে ৮টি টেস্টে ১৭.৪৭ গড়ে ৬৮ উইকেট নিয়েছেন মুরালীÑএমন কৃতিত্ব আর কারো নেই। অপরদিকে ওয়ার্ণ ছিলেন নিষিদ্ধ, তার ওপর বছরের অর্ধেক সময়ই খেলেননি। মুরালীকে এভাবে বঞ্চিত করার কারণ হিসেবে কেউ যদি তার বিতর্কিত বোলিং এ্যাকশনকে উল্লেখ করেন তবে তা গ্রহণযোগ্য নয়, কেননা তার বোলিং এ্যাকশন তো একাধিকবার পরীক্ষার পর ছাড়পত্র প্রাপ্ত। তবে যে যাই বলুক, মুরালীর গাযের চামড়াটা যদি কালো না হতো তবে তাকে এমন বিদ্ধেষের আগুনে পুড়তে হতোনা, বা এভাবে বঞ্চিত হতে হতো না।

ক্রিকেটে কালোরা যেনো রেকর্ডের বরপুত্র। আর কালোদের প্রতিনিধি হয়ে দু’দশকেরর বেশী সময় ধরে যে দেশটি বিশ্ব ক্রিকেটকে শাসন করেছে সে দেশের নাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আর এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের স্বর্ণ যুগের  সবচেয়ে সফল অধিনায়ক হচ্ছেন ক্লাইভ লয়েড। এ ছাড়া তিনি বিশ্বকাপ ক্রিকেটেরও অন্যতম সফল অধিনায়ক। তার নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৯৭৫ সালে প্রথম ও ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করে। বিশ্বকাপে তিনি ১৭টি ম্যাচে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ১৫টি ম্যাচেই জয় পেয়েছিলেন। পরাজিত হয়েছিলেন ২টি ম্যাচে। প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালে তিনি অস্ট্রেলিয়ানদের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরী করেছিলেন। সাফল্যের হার ৮৮.২৩। প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারও তিনি লাভ করেন। ক্লাইভ লয়েড ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান সফরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অধিনায়ক মনোনিত হন। তিনি ১৮টি টেস্ট সিরিজে দলের নেতৃত্ব দেন এর মধ্যে ১৪টিতে জয় পান, পরাজিত হন ২টিতে এবং ড্র করেন ২টি। তিনি ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকার অন্যতম সেরা ।      নিজের অসমান্য নৈপুণ্য দিয়ে বিশ্ব জয়কারী আর এক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার হচ্ছেন ভিভিয়ান রিচার্ডস। যাকে ক্রিকেট বিশ্ব এক নামে ‘ভিভ’  বলেই চেনে। সত্তুরের দশকে ক্যারিবিয়ানদের বিজয় পতাকা ওড়ানোর পেছনে সবচেয়ে বেশী অবদান ছিলো এই অসামান্য প্রতিভাধর ক্রিকেটারটির। ঐ সময় তাঁকে আউট করতে পারলে যে কোনো বোলারের গর্বে বুক ভরে যেতো। বিশ্বকাপে তিনি মোট ম্যাচ খেলেছেন ২৩টি। ২১ ইনিংসে ৫ বার অপরাজিত থেকে রান করেছেন ১০১৩। যার গড় ৬৩.৩১। বিশ্বকাপে রয়েছে তাঁর তিনটি সেঞ্চুরীÑ১৩৮*, ১১৯, ১৮১। চতুর্থ বিশ্বকাপে করাচিতে অনুষ্ঠিত ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে দলনায়ক হিসেবে আবার ব্যক্তিগতভাবে দুটি অনন্য নজির স্থাপন করেন। ব্যাটসম্যান ভিভ তাঁর অসাধারণ ব্যাটিং নৈপুণ্য প্রদর্শন করে ১২৫ বল খেলে ১৬টি চার ও ৬টি ছক্কার সাহায্যে গড়েন ১৮১ রানের পাহাড় সমান এক বিশ্বরেকর্ড। যদিও পরবর্তীতে তার এই রেকর্ডটি ভেঙ্গেছেন ভারতের লিটল মাস্টার শচীন টেহুুলকর। এ খেলায় ওযেস্ট ইন্ডিজের দলীয় সংগ্রহ ছিলো মাত্র চার উইকেট হারিয়ে ৩৬০। এটি ছিলো বিশ্বকাপে দলীয় রানের বিশ্বরেকর্ড। ১৯৭৯-এর বিশ্বকাপ ফাইনালে তিনি অসাধারণ নৈপুণ্য উপহার দিযে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার জয় করেন। তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় সফল অধিনায়কও বটে। তার নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১২টি সিরিজ খেলে। এর মধ্যে ৮টিতে জয় পান এবং ৪টি ড্র করেন। পরাজিত হননি একটিতেও। ক্যারিবীয় ক্রিকেটের ব্লাক ডায়মন্ড ভিভ রিচার্ড ছিলেন প্রকাশ্যভাবে শ্বেতাঙ্গবিরোধী একজন ক্রিকেটার। তার অধিনায়কত্বের সময়কালে তিনি অ্যান্টিগুয়া ও ত্রিনিদাদের বঞ্চিত কালো ক্রিকেটারদের বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন। বর্ণ-বৈষম্যকে মনে-প্রানে ঘৃণা করেন ভিভ। ১৯৯২ সালের কথা, দক্ষিণ আফ্রিকার পশ্চিম প্রদেশের কারিকাপে খেলার জন্য বিরাট অঙ্কের অর্থের প্রস্তাব দেয়া হলো ভিভকে, কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভিভ সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। কারণ হিসেবে তিনি জানালেন, দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে ফিরে এলেও সেখানকার সাদা-কালো বৈষম্য দূর হয়নি, তাই তিনি সেখানে যাবেন না।

ক্রিকেট বিশ্বের আর এক কৃষ্ণাঙ্গ কিংবদন্তী স্যার গ্যারী সোবার্স। পরিসংখ্যানের আলোকে তাঁকেই বলতে হবে বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার। ৯৩ টেস্টে ১৬০ ইনিংসে ৫৭.৭৮ গড়ে ৮০৩২ রান করার পাশাপাশি ৩৪.০৩ গড়ে ২৩৫টি উইকেট দখল করে এই কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার শীর্ষে অবস্থান নিয়েছেন। সফল অধিনায়ক হিসেবে ক্যারিবীয় ক্রিকেটে তার অবস্থান তৃতীয়, অর্থাৎ ক্লাইভ লয়েড ও ভিভ রিচার্ডস-এর পরেই তার অবস্থান। সোবার্স ৩৯টি ম্যাচে দলকে নেতৃত্ব দেন। এর মধ্যে ৯টিতে জয়, ১০টিতে পরাজয় এবং ২০টি ম্যাচ ড্র করেন। তিনি ১৩টি টেস্টে দল পরিচালনা করেন। ১৯৫৭-৫৮ মৌসুমে তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৩৬৫ রান করে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। যে রেকর্ডটি পরবর্তীতে স্বদেশী ব্রায়ান লারা ভাঙ্গেন। ২০০০-এ উইজডেনের বিচারে ‘ক্রিকেটার অব দ্য সেঞ্চুরী’ নির্বাচিত হন এই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান। অতি সম্প্রতি এই বরেণ্য ক্রিকেটারের কল্যাণে কালোদের মুকুটে যুক্ত হয়েছে আর একটি সাফল্যের পালক। খোদ আইসিসি এতোদিন ক্রিকেটের শ্বেতাঙ্গ কিংবদন্তী স্যার ডন ব্রাডম্যানকে নানা কায়দায়, নানাভাবে সন্মানিত করে এসেছে। দেরীতে হলেও অবশেষ তাদের বোধোদয় হয়েছে। এবার তারা সন্মানিত করেছে ক্রিকেটের আর এক জীবন্ত কিংবদন্তী স্যার গ্যারী সোবার্সকে। স্যার ডন ব্রাডম্যানের পরই  তাঁকে ধরা হয় সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার। আইসিসি চালু করেছে স্যার গ্যারী সোবার্স ট্রফি। অনেকে একে বলছেন ক্রিকেটের ‘অস্কার’। পুরস্কারের নামকরনের দায়িত্বটি ছিলো সাবেক ক্রিকেটার সুনীল গাভাস্কার, রিচি বেনো ও মাইকেল হোল্ডিং-এর ওপর। এ কমিটিতে ইংরেজরা থাকলে হয়তো এখানেও সোবার্স বঞ্চিত হতেন। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে ইংল্যান্ড একদিন কালোদেরকে ক্রিকেটের ধারেকাছে ঘেঁষতে দিতো না, সেই ইংল্যান্ডের মাটিতেই স্যার গ্যারী সোবার্স ট্রফির প্রথম আয়োজনটি জমজমাটভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছে ৯ সেপ্টেম্বও ২০০৪। আর প্রথম গ্যারী সোবার্স ট্রফি জয় করেছের ভারতের কুল হেডেট ব্যাটসম্যান রাহুল দ্রাবিড়। ক্রিকেটে তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষও সাদা চামড়াদের দ্বারা কম লাঞ্চিত-বঞ্চিত হয়নি। ইংল্যান্ড-অষ্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়-কর্মকর্তারা তো এখনো ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়দের নিুবর্ণ বলে বিবেচনা করে। এ ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের মাটিতে স্যার গ্যারী সোবার্স ট্রফির আয়োজন আর ভরতীয় ক্রিকেটার রাহুল দ্রাবিড়ের প্রথম ট্রফিটি জয় সাদাদের নাকটাকে বলতে গেলে মাটিতে ঘষে দিয়েছে। এখানে আরো একটি ব্যাপার লক্ষ্যনীয় আর তা হচ্ছে, আলেকজান্দ্রা প্যালেস নামের পলেস্তারা খসে পড়া যে প্রাচীন ভবনে এই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় অতীতে তা ছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অফিস। ইতিহাসের কি বিচিত্র গতি! একদিন এই অফিসেই হয়তো বসতো ভারতীয়দের বিরুদ্ধে নীল নক্সা তৈরীর বৈঠক। কোনো সময় হয়তো এই অফিসেই তিরস্কৃত কিংবা নির্যাতিত হতে হয়েছে কোনো ভারতীয়কে। আজ সেখানেই পুরস্কৃত করা হলো একাধিক ভারতীয় কৃতি সন্তানকে । উল্লেখ্য, রাহুল দ্রাবিড়ের বর্ষসেরা ও সেরা টেস্ট ক্রিকেটারের ট্রফি জয়ের পাশাপাশি সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের ট্রফি অর্জন করেন আর এক ভারতীয় বাঁহাতি পেসার ইরফান পাঠান। অবশ্য কালো গ্যারী সোবর্সের আলোর স্বাদ ইংরেজরাও পেয়েছে। ইংল্যান্ডের প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ লাভ করেছেন বছরের সেরা ওয়ানডে ক্রিকেটারের ট্রফিটি।

বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ডেসমন্ড হাইন্স ও গর্ডন গ্রিনিজের রেকর্ড ঈর্ষনীয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন দলের কোচ ছিলেন গর্ডন গ্রিনিজ। বলা যায়, তার হাত ধরেই বাংলাদেশ বিশ্বকাপে প্রবেশ করে।

ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটে আর এক ব্লাক ডায়মন্ড কোর্টনি ওয়ালশ। তাকে বলা হয় ক্রিকেটের মহান যোদ্ধা। ১৩২টি টেস্টে ৫১৯টি উইকেট নিয়ে তিনি গড়েছিলেন অনন্য এক বিশ্বরেকর্ড। যদিও সেই রেকর্ডটি এখন আর তার দখলে নেই। ২০০৪ সালের মে মাসে শ্রীলঙ্কান বোলার মুত্তিয়া মুরালীধরণ তার এই রেকর্ডটি ভেঙ্গে ফেলেন। ওয়ালশ ২২টি টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বোলিং মার্কে ঘাতক বোলার হিসেবে তার পরিচিতি থাকলেও একটি ঘটনা এই কালো ক্রিকেটারকে বিশ্ব ক্রিকেটে এক মহান ক্রিকেটারের মর্যাদা এনে দিযেছে। সেই সাথে ক্রিকেটকে করেছে মহিমান্বিত। চতুর্থ বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডের খেলা চলছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তানের মধ্যে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ২১৬ রানের টার্গেটকে তাড়া করতে গিয়ে পাকিস্তান ২০৩ রানে ৯ উইকেট হারায। তখন ক্রিজে ছিলেন আব্দুল কাদের এবং ননস্ট্রাইকিং এন্ডে ছিলেন সেলিম জাফর। শেষ ওভারে পাকিস্তানের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিলো ১৪ রানের। শেষ ওভার বোলিং করেন ওয়ালশ। ওয়ালশ তার বোলিং মার্ক থেকে দৌড় শুরু করে আম্পায়ারকে অতিক্রম করার সময় লক্ষ্য করেন জাফর ক্রিজের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। ওয়ালশ তাকে রান আউট করলেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতে যায, কিন্তু খেলোয়াড়ী মনোভাবের সর্বোচ্চ নজির স্থাপন করে ওয়ালশ জাফরকে রান আউট না করে সতর্ক করে দেন। এরপর আব্দুল কাদির অসাধারণ ব্যাটিং করে ১৪ রান সংগ্রহের মাধ্যমে দলকে জয়ী করান। এ ম্যাচে পাকিস্তান বিজয়ী হলেও ওয়ালশ হয়ে ওঠেন প্রকৃত বীর। কারো কারো মতে, ওয়ালশ কালো বলেই এমন একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছেন। তার জায়গায় একজন ইংরেজ হলে এমন সুযোগ কখনোই হাত ছাড়া করতেন না।

ক্যারিবীয় ক্রিকেটের দুরন্ত গতি এক সময় শ্বেতাঙ্গদের দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলেছিলো।  তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই গতিতে বেশ ভাটা পড়েছে। কেউ কেউ একে পর্দার অন্তরালের কারসাজি হিসেবে চিহিৃত করে থাকেন। কারো মতে, ক্রিকেট খেলাটি ইংল্যান্ডের উচ্চবিত্তের খেলা হিসেবেই পরিচিত ছিলো। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটি প্রথম গঠিত হয় ১৮০০’র শেষ দিকে। স্বাধীনতার পর ঐ দলের খেলোয়াড়রা সব সময় ভালো খেলার চেষ্টা করতো। তাদের লক্ষ্য ছিলো একটাই, আর তা হচ্ছে, ক্রিকেট কুলীণদের একটা শিক্ষা দেয়া। যারা সব সময তাদেরকে অস্পৃশ্য মনে করে। নিজেদের যোগ্যতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে ক্যারিবীয়রা মরিয়া হয়ে লড়তো। লয়েড, সোবার্স, ভিভরা যে আদর্শ ও মানসিকতা নিয়ে ক্রিকেট খেলেছেন, এ খেলাকে তারা যেভাবে কালোদের উত্তরণ এবং প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেছেন, আজকের ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটারদের মাঝে সেই মানসিকতা অনুপস্থিত। এর কারণ হিসেবে অনেকে বলছেন, দারিদ্র এবং অভাব থেকে উঠে আসা এই সব ক্রিকেটার আজ খুব সহজেই বিবেক বিসর্জন দিয়ে অর্থের কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের অধ:গতির এটা একটা বড় কারণ। সোনালী অতীতের সেরা কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার ক্লাইভ লয়েডও বলছেন, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের তরুণরা দিন দিন ক্রিকেট থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যদিও এখানে আজও ক্রিকেটই হচ্ছে প্রধান জনপ্রিয় খেলা।’ তরুণদের এই ক্রিকেট বিমুখতার কারণ হিসেবে লয়েড বলেছেন, ‘আমাদের দেশ আমেরিকার নিকটবর্তী বলে আমাদের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে সারাদিন বেসবল আর বাস্কেটবল খেলা দেখানো হয়। ক্রিকেট তেমন একটা দেখানো হয়না। ফলশ্র“তিতে তরুণদের কাছে ঐ খেলাগুলো দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।’ অবশ্য লয়েড ঐ খেলাগুলোর উচ্চ পারিশ্রমিকের বিষয়টি উল্লেখ করেননি। ওয়েস্ট ইন্ডিজে এ্যাথলেটিক্স, বেসবল ও বাস্কেট বল খেলা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠার আর একটি বড় কারণ হচ্ছে, উচ্চ অঙ্কের পারিশ্রমিক। ঐ সব খেলার তুলনায় ক্রিকেটের পারিশ্রমিক কমে যাওয়ায় ক্রিকেটের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই কমে যাচ্ছে তরুণদের আগ্রহ। একজন ক্যারিবীয় প্রতিভাবান তরুণ এটা ভালো করেই জানে যে, আমেরিকার যে কোনো পেশাদার খেলায় ঢুকতে পারলেই মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক পাওয়া যায়, যা রাতারাতি ভাগ্য বদলে দেয়। এ ছাড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সব চাইতে বড় সমস্যা হচ্ছে, কতগুলো দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দলটির খেলোয়াড় আসে অ্যান্টিগুয়া, ত্রিনিদাদ, বারবাডোস, জ্যামাইকা ইত্যাদি দ্বীপরাষ্ট্র থেকে। আর এই দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীন কোন্দলও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটকে বেশ ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। কোনো কোনো দ্বীপ তো মাঝে মাঝে আলাদা হয়ে যাবার হুমকি পর্যন্ত দিয়ে বসে। দ্বীপগুলোর প্রসঙ্গ যখন এসেই গেলো তখন একটু ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখা যাকÑ কালোদের দেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজÑ এ তো সকলেরই জানা। তবে বিশ্বকাপ ফুটবল কিংবা অলিম্পিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নামটি পর্যন্ত শোনা যায় না কেনো? বিস্ময়কর তো বটেই, মজার ব্যাপারও হচ্ছে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামের দেশটি শুধু ক্রিকেটের গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ। অন্যান্য খেলায় ওয়েস্ট ইন্ডিজভুক্ত দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর নিজ নিজ দ্বীপের নামে অংশ নেয়। সে প্রসঙ্গে আরো একটু পরে আসছি, তার আগে দেখা যাক ওযেস্ট ইন্ডিজের অদিবাসীদের ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বা ক্যারিবীয় বলা হয় কেনো। প্রাচীন উপজাতি ক্যারিবদের নামানুসারেই এখানকার অধিবাসীদের ক্যারিবীয়ান বা ক্যারিবীয় বলা হয়। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার সংযোগ পানামা খালের পূর্বদিকে এবং ক্যারিবিয়ান সাগরের বুকে ভাসমান দ্বীপপুঞ্জের নাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ভারতের কাছাকাছি না হয়েও দেশটির এই নামকরনের কারণ খুঁজতে গেলে পনের শতাব্দীতে কলম্বাসের কাছে যেতে হবে। সমুদ্র পথে ভারত আবিস্কার করতে এসে দুঃসাহসী কলম্বাস ১৪৯৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেন্ট ক্রিস্টোফার এন্ড নেভিস-এ (বর্তমানে সেন্ট ক্রিটস) এসে পৌছান। এখানে এসে কলম্বাস ধারণা করলেন, তিনি ভারতের পশ্চিমের কোনো অংশে এসে পৌছেছেন। তার এই দুঃসাহসী অভিযানকে স্মরনীয় করে রাখতেই ভুল সত্বেও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। যদিও শাসক ইংরেজদের হাত ধরেই উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে প্রবেশ করে। তবে এখানকারও ক্রিকেটের ইতিহাসে কালোদের রয়েছে নানাবিধ লাঞ্চনা-বঞ্চনা আর নির্যাতনের ইতিহাস। আর এর ফলে দিনে দিনে শাসক সাদা চামড়ার বিরুদ্ধে তাদের মনে জমে উঠেছে ক্ষোভ, ঘৃনা আর প্রতিহিংসার বারুদ। আর এই ক্রিকেট দিয়েই তারা বৃটিশ শাসকদের সমুচিত জবাব দেয়ার জন্য কঠোর সাধনায় তিলে তিলে নিজেদের গড়ে তুলতে থাকে। দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীরা সমন্বিত হয়ে ১৯২৭ সালে যে ক্রিকেট বোর্ড গড়ে তোলে তারই তত্বাবধানে এক সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ হয়ে ওঠে যেনো ক্রিকেটার তৈরীর মেশিন। এক সময় প্রতিটি ক্রিকেটার মাঠে পা রাখতো সাদা চামড়ার শাসক আর ক্রিকেটের  কুলিনদের শক্ত জবাব দেবার তীব্র প্রত্যয় নিয়ে; আর এই প্রত্যয়ের কারণেই মেশিনের মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে যেমন বিখ্যাত সব ক্রিকেটাররা বেরিয়ে আসতে থাকে তেমনি অপ্রতিরোধ্য গতি পায় ক্যারিবীয় ক্রিকেট। এক সময় তারা নিজেরা বিশ্ব ক্রিকেটের দখল নিয়ে নেয়। কালোদের ক্রিকেটের আলোতে আলোকিত হয়ে ওঠে বিশ্ব ক্রিকেট। এই দ্বীপপুঞ্জে ক্রিকেটার জন্ম দিতে কোনো দ্বীপের চাইতে কোনো দ্বীপ কম পিছিয়ে নেই। এবার আসুন না পৃথক পৃথকভাবে দ্বীপগুলোর প্রতিভাধর ক্রিকেটারদের দিকে তাকানো যাক ঃ ছোট দ্বীপ বার্বাডোজ। স্বাধীনতা লাভ করেছে ১৯৬৬ সালে। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এই দ্বীপটি যে সব ক্রিকেটার উপহার দিয়েছে তাদের মধ্যে আছেন, বিখ্যাত ‘থ্রি ডব্লিউ’ ওরেল-উইকস-ওয়ালকট। এঁদের পুরো নাম হচ্ছে,  ফ্ল্যাঙ্ক ওরেল,এভার্টন উইকস ও ক্লাইভ ওয়ালকট। এ ছাড়া সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার স্যার গ্যারী সোবার্স, দুরন্ত পেসার হল-গ্রিফিথ জুটি, গতির রাজা মার্শাল, একুরেট গার্নার, বিখ্যাত ওপেনিং জুটি গ্রীনিজ-হায়ান্স, কনরাড হান্ট, সিলভাস্টার ক্লার্ট, কলিন্স কিং প্রমূখ।

৪২৩২ বর্গমাইলের দ্বীপ জ্যামাইকা। দ্বীপটি স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৬২ সালে। বিশ্ব ক্রিকেটে জ্যামাইকার কালো মানিকরা দখল করে আছে অনেকটা অংশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে এই দ্বীপটির অবদান বিশাল। জ্যামাইকা উপহার দিযেছে কোর্টনি ওয়ালশ, প্যাট্রিক প্যাটারসন, মাইকেল হোল্ডিং, ডুজন, ব্ল্যাক ব্রাডম্যানখ্যাত হেডলি, গ্যারী আলেকজান্ডার, লরেন্স রো, অ্যালফÑএর মতো বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটারদের।

ত্রিনিদাদ ও টোবাগো প্রজাতন্ত্র দুটো দ্বীপ নিয়ে গঠিত। আয়তন ১৯৮১ বর্গমাইল। এই দ্বীপটি স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৬২ সালে। এই দ্বীপে জন্ম  নিয়েছেন বিশ্ব ক্রিকেটের রাজপুত্র ব্রায়ান লারা, লিয়েরী কনস্ট্যান্ট, কিল সিমন্স, ল্যারী গোমস, রফিক জুমাদিন, স্টলমেয়ার, ডেরক মারে, বার্নাড জুলিয়েন, গাসলোগি, ইয়ান বিশপের মতো নামকরা সব ক্রিকেটাররা।

দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের সাথে সরাসরি সংযুক্ত গায়ানা। ৮৩,০০০ বর্গমাইলের দ্বীপটি স্বাধীনতা পায় ১৯৬৬ সালে। গায়ানা বিশ্ব ক্রিকেটে উপহার দিয়েছে দু’বার বিশ্বকাপজয়ী বিশ্ব কাঁপানো অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড, রয় ফ্রেডরিকস, স্টিভ কামাচো, কালীচরন, রোহান চানহাই, ল্যান্স গিবস, জো সলোমন, ফুয়াদ বাক্কাস, কলিন ক্রফর্ড, কার্ল হুপার, চন্দরপল প্রমূখ ক্রিকেটার।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাকি দুটো অংশ হচ্ছে লিওয়ার্ড দ্বীপপুঞ্জ ও উইন্ডওয়ার্ড দ্বীপপুঞ্জ। লিওয়ার্ড দ্বীপপুঞ্জটি এন্টিগা, বার্মুডা, মন্টমেরাট, অ্যানগুইলা, সেন্টক্রিস্টোফার ও নেভিস (সেন্ট স্কীটস) দ্বীপগুলো নিয়ে গঠিত। এই দ্বীপগুলোর মধ্যে ক্রিকেটার জন্ম দেয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষে আছে এন্টিগা। এখান থেকে বিশ্ব পেয়েছে বহু স্বনামধন্য ক্রিকেটার। এদের মধ্যে আছেন কিং রিচার্ড বা ভিভিয়ান রিচার্ড, রিচার্ডসন, রবার্টস, এ্যামব্রোস, কেনেথ বেঞ্জামিন প্রমূখ। উইন্ডওয়ার্ড দ্বীপপুঞ্জটি গ্রেনাডা, জেমিনিকা, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রেনাডিনেস দ্বীপগুলোর সমন্বয়ে গঠিত। এখান থেকে কোনো বড় মাপের ক্রিকেটার না বেরুলেও ভালো মানের অনেক ক্রিকেটার বেরিয়েছে।

যুগে যুগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটাররা ক্রিকেটকে নব আলোকে উদ্ভাসিত করে তুলেেেছন। এর একদিকে যেমন রয়েছে শিল্পময়তা, অন্যদিকে ভয়ঙ্কর রূপ। বোলিং মার্কে কোনো কোনো বোলারের প্রান সংহারী ঘাতক-রূপ প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের কলজে শুকিয়ে ফেলতো। আবার কোনো কোনো ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং তান্ডবে একেবারে ভূ-লুন্ঠিত হতো প্রপিক্ষের বোলাররা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের তিন পেসার হল, গ্রিফিত ও গিলক্রাইস্ট এক সময় ব্যাটসম্যাদের পৃথিবীর স্বর্গীয় পরিবেশে বাস করার কথা ভুলিয়ে দিতেন। এই তিন বোলার এতোই দ্রুতগতিতে বল করতেন যে, ব্যাটসম্যানরা যখন তাদের বল খেলতেন তখন শুধু মৃত্যুর কথাই চিন্তা করতেন, এবং তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতো। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাইকেল হোল্ডিংকে কেউ কেউ টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে দ্রুততম ফাস্ট বোলার হিসেবে গণ্য করে থাকেন। অবশ্য বোদ্ধাদের অনেকেই এ দাবীকে সমর্থন করেন না। হোল্ডিং-এর বলের গতির সাথে শয়তানের গতির তুলনা করা হতো। ১৯৭৬ সালে ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার ওভাল টেস্টের কথাই ধরা যাক ঃ একটি নি¯প্রান উইকেট। যে উইকেটে উভয় দলের বোলাররাই উইকেট না পেয়ে হতাশ, যে উইকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাদের প্রথম ইনিংসে রান করেছিলো ৬৮৭। সেই উইকেটেই কিনা হোল্ডিং নিজের ঝুলিতে পুরেছেন একে একে ১৪টি উইকেট! এদের মধ্যে তিনি ৮ জনকে করেছেন বোল্ড আউট আর ৬ জনকে এলবিডব্লিউ। সাদা চামড়ার ক্রিটোরদের মুখে কালোদের প্রসংশা শোনা যায় কদাচিৎ।  যে সত্যটাকে কোনোভাবেই আাড়াল করা যায়না সেটাই শুধু তারা স্বীকার করেন। হোল্ডিং সম্পর্কে জিওফ বয়কট বলেছেন,‘আামি যতো ফাস্ট বোলারদের মোকাবিলা করেছি তাদের মধ্যে হোল্ডিংই সেরা।’

আশির দশকে যতো দ্রুতগতি সম্পন্ন বোলারের আবির্ভাব ঘটেছে তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ গতি সম্পন্ন বোলার হিসেবে যে দু’জনকে ধরা হয় এদের একজন হলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যালকম মার্শাল, অপরজন পাকিস্তানের ইমরান খান। এক কথায় মার্শাল হচ্ছেন সেই বোলার যার হাতে বল উঠলে ব্যাটসম্যানদের বুক কেঁপে উঠতো। তার বোলিং ছিলো নানা কারুকাজে সমৃদ্ধ। বোলিং করতে তিনি নয় প্রকারের কৌশল ব্যবহার করতেন। আর এ কারণেই কেউ কেউ তাকে ‘মার্শাল দ্য নিনজা’ নামে সম্বোধন করতো। ১৯৮৩ সালে কলকাতা টেস্টে মার্শালের প্রথম বলটি খেলে গাভাস্কার বলেছিলেন,‘এই বলটিই আমার জীবনে খেলা সব চাইতে দ্রুততম বল।’ ক্রিকেট ইতিহাসের এই ভয়ঙ্কর দ্রুততম বোলারটি আশির দশকে হারাম করে দিয়েছিলেন ব্যাটসম্যাদের ঘুম।

জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে সাদা-কালো সমস্যা অনেকদিনের। সে দেশের কালোরা ক্রিকেটে এতোটাই বঞ্চিত ছিলো যে, মাঠের কাছাকাছি দেখলেই সাদারা কালোদের তাািড়য়ে দিতো। স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে জিম্বাবুযে যখন রোডেশিয়া ছিলো তখন ক্রিকেট ছিলো পুরোপুরি শ্বেতাঙ্গদের দখলে। এ সময়টাতে শ্বেতাঙ্গরা কালোদের নানাভাবে নির্যাতিত ও বঞ্চিত করেছে। দেশটির টেস্ট স্ট্যাটার্স প্রাপ্তির পর কালোদের অবস্থার একটু একটু করে উন্নতি শুরু হয়। জাতীয় দলে তখন কালোদের আগমন ঘটতে শুরু করে। শ্বেতাঙ্গরা ব্যাপারটিকে ভালো চোখে না দেখলেও কিংবা বিদ্বেষী মনোভাবে কালোদের ছেঁটে ফেলার চেষ্টা করলেও কালোরা তাদের যোগ্যতা দিয়ে, নৈপুণ্য প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান সু-দৃঢ় করতে থাকে। হেনরি ওলোঙ্গা, হ্যামিল্টন মাসাকাদজা, টাটেন্ডা টাইবুরা যখন নিজেদের তুলে আনতে সচেষ্ট তখনই জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট ইউনিয়নের দায়িত্বে এলেন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যবসায়ী পিটার চিঙ্গোকা। আর চিঙ্গোকা দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই সোচ্চার হয়ে ওঠেন জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে কালোদের অধিকার প্রতিষ্টায়। তিনি কোটাভিত্তিক পদ্ধতি চালুর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আর এ সম্পর্কে কালোদের বক্তব্য হচ্ছে, দীর্ঘ আধিপত্যের কারণে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট শ্বেতাঙ্গদের এতোটাই দখলে চলে গিয়েছিলো যে, কোটা ছাড়া কালোদের আর কোনো বিকল্প নেই। আর পিটার চিঙ্গোকার এই কোটা পদ্ধতি চালুর উদ্যোগের কারণে শ্বেতাঙ্গদের মনে বিদ্বেষের আগুন জ্বলে ওঠে। চিঙ্গোকার এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কনে বসেন দলনায়ক হিথস্ট্রিকসহ ১৫ জন শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটার। উল্লেখ্য, এই বর্ণ-বিদ্বেষের কোপানলে পড়ে আগেই দেশ ছেড়েছেন সে দেশের বিখ্যাত ক্রিকেটার এন্ডি ফ্লাওয়ার ও উদীয়মান ক্রিকেটার হেনরী ওলোঙ্গা। কালোরা আগেই বয়স এবং অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ এড়িয়ে দলের সর্বকনিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় টাটেন্ডা টাইবুকে সহকারী অধিনায়ক করে রেখেছিলো। হিথস্ট্রিক তার শ্বেতাঙ্গ বাহিনী নিয়ে সরে দাঁড়ালে কালোরা টাইবুকে অধিনায়ক করে শ্বেতাঙ্গদের ছাড়াই দল গঠন করে এবং ৬ মে ২০০৪ তারিখে শুরু হওয়া টেস্টে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ও আর এক কালোর দেশ শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে লড়ায়ে অবতীর্ন হয়। এ টেস্টের মধ্য দিয়ে সোয়াশ’ বছরের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্ব কনিষ্ঠ অধিনায়ক হিেিসবে অভিষেক ঘটে কৃষ্ণাঙ্গ বালকবীর টাইবুর। বলা যায়, কালোদের আধিপত্য নিয়ে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট নতুন করে যাত্রা শুরু করে। বলাইবাহল্য বর্ণভিত্তিক এ লড়াইয়ে দেশটির ক্রিকেটের অসামান্য ক্ষতি সাধিত হয়েছে তবে সেই সাথে কালোদের সুদীর্ঘ বঞ্চনা ও নির্যাতনের অবসানও ঘটেছে। কালোরা দলে থাকলে সাদারা খেলবে না কিংবা কালোদের সমঅধিকারকে স্বীকার করবেনাথÑ সভ্য সমাজে নিশ্চয় এ বর্ণবাদ কারো কাম্য নয়। যদিও হিথস্ট্রিক বাহিনী বলেছেÑ ‘ইস্যুটাকে বর্ণভিত্তিক লড়াই হিসেবে প্রচার করা হলেও তা আসলে ঠিক নয়।’ আমাদের মতো নিরপেক্ষ ক্রিকেটামোদীরাও কখনো কামনা করেনা যে, বর্ণ-বৈষম্য, জাতিগত বিদ্বেষ, রাজতৈতিক প্রতিহিংসা বা অন্য কোনো অপশক্তির কাছে মহান ক্রিকেট কখনো মাথা নত করুক।

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণ-বিদ্বেষের লেলিহান শিখায় সে দেশের ক্রীড়াঙ্গন যে কী পরিমান ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সেটা কমবেশী সকলেরই জানা। এই বর্ণবৈষম্যের কারণে দেশটি আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গন থেকে দীর্ঘ সময় বহিস্কৃত ছিলো। এ সম্পর্কে বর্ণবাদের অবসানের পর সে দেশের জাতীয় দলের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার মাখায়া এনটিনি একবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন,‘বর্ণবাদ দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রীড়াঙ্গনকে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত করেছে। ক্রিকেটও হয়েছে অনেক ক্ষতিগ্রস্থ। আজ সে সমস্যার সমাধান ঘটিয়ে আমরা মিলেমিশে খেলছি। এখন আমাদের এগিয়ে যাবার পালা। জাতীয় দলে আমার স্থান পাওয়া এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় উদীয়মান কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়রা অধিক উঃসাহিত হয়ে উঠেছে। আর সে কারণে আমার দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। আমাকে যেমন আমার অবস্থান ধরে রাখতে হবে তেমনি স্বগোত্রীয় সবাইকে অনুপ্রানীত করতে হবে। অপরদিকে আমার সাফল্য তাদের মাঝে আমার একটা অবস্থান তৈরী করেছে।’ এনটিনি সাংবাদিকদের সামনে যতোই বলুক ‘আমরা এখন মিলেমিশে খেলছি’ আসলে এই ‘মিলেমিশে’ শব্দটা উচ্চারণ করা যতোটা সহজ কার্যক্ষেত্রে বাস্তবায়ন অধিক কঠিন।

দক্ষিণ আফ্রিকা দলে মাখায়া এনটিনি আজ অপরিহার্য্য এক বোলার। ১৯৯৭-৯৮ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার অভিষেক ঘটে। প্রতিপক্ষ দল ছিলো শ্রীলঙ্কা। অভিষেক টেস্টে নিউল্যান্ডসে ১৫০০০ দর্শকের সামনে বিশ্বের অন্যতম আর এক কৃষ্ণবর্ণের ব্যাটসম্যান অরবিন্দ ডি সিলভার উইকেটটি নিয়ে তার ক্যারিয়ারের যাত্রা শুরু হয়েছিলো; আজও এগিয়ে চলছেন সমান তালে। কালোদের এই প্রতিনিধি শ্বেতাঙ্গ ডোনাল্ড ও শনপোলকদের মাঝে নিজেকে মেলে ধরেছেন সার্থকভাবে। দক্ষিণ আফ্রিকার ইস্ট লন্ডনের বর্ডার প্রদেশের এই কৃষ্ণ ক্রিকেটারের আদর্শ ক্রিকেটার হচ্ছেন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান গ্রেট ম্যালকম মার্শাল। সাদাদের ডিঙ্গিয়ে আপন কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০১ সালে তিনি লাভ করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ‘ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার এবং ২০০৩ সালে ‘প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ (সিলভার)। উল্লেখ্য, ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য দু’টি আলাদা ক্রিকেট বোর্ড ছিলো। ১৯৯০ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করার পর আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছিলো, এরপর  ’৯১ সালে বোর্ড দুটি ঐক্যবদ্ধ হয়। পরবর্তীতে তারা প্রতিটি সম্প্রদায়ের তরুণ ক্রিকেটারদের নিয়ে বিশাল কর্মসূচি গ্রহণ করে। আরো উল্লেখ্য যে, বর্ণবাদের অবসান ঘটার আগে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ছিলো সম্পূর্ন শ্বেতাঙ্গদের দখলে। সে সময় জাতীয় দলে একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার হিসেবে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন ডাঃ আলী বাখার। বর্ণবাদের অবসান ঘটার পর ইফসিবিএসএ বর্ণবাদী আমলে নিগৃহিত সম্প্রদায় গুলোর জন্য ক্রিকেটের দ্বার উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই নীতি অনুয়ায়ী ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রতিটি আসরে কমপক্ষে তিনজন, জুনিয়র ক্রিকেটে কমপক্ষে দু’জন এবং জাতীয় ক্রিকেটে কমপক্ষে একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারকে নেয়া হবে। আর এমন নীতির ফলে সে দেশের ক্রিকেটে চলছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। সাদারা এখনো মনের দিক থেকে কালোদের মেনে নিতে পারছেনা। সে দেশের সাদা চামড়াধারী প্রক্তন ক্রিকেটার ক্লাইভ রাইস, রে জেনিংস, প্যাট সিমকস্ক, অ্যাড্রিয়ান কুইপার, ফ্যানি ডি ভিলিয়াস বর্ণবাদ অবসান পরবর্তী সব সিদ্ধান্তের জোর প্রতিবাদ করেছেন, আর সে প্রতিবাদের ধারা আজও অব্যাহত আছে। বর্তমানে ইংল্যান্ডে বসবাসকারী ক্লাইভ রাইস তো শ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়দের বিদ্রোহ করার আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন এই বলে,‘এই মুহূর্তে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনীতিবিদরা। ক্রিকেটারদের ঐক্যবদ্ধভাবে এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা উচিত।’ আর এই বক্তব্যের জবাবে কৃষ্ণাঙ্গ কর্মকর্তা গ্রাহাম আব্রাহাম বলেছিলেন, ‘শ্বেতাঙ্গরা এখনো ক্রিকেটকে তাদের দখলে রাখতে চায়। এরা এখনো বর্ণবাদেরই সন্তান।’ তাহলে কি দক্ষিণ আফ্রিকাও সাদা-কালোর জের ধরে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জিম্বাবুয়ের পথে ধাবিত হচ্ছে? সময়ই দেবে সে প্রশ্নের উত্তর।

আমরা আবারো ফিরে আসি বিশ্ব ক্রিকেটে কালোদের দাপটের প্রসঙ্গে, বিশ্ব ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কার কালোদের দাপট সব সময়ই ঈর্ষনীয়। লঙ্কার ব্ল্যাক টাইগাররা ১৯৯৬ সালে ৬ষ্ঠ বিশ্বকাপ জয় করে বিশ্বকে চমকে দেয়। ক্রিকেটের এই কালো মানিকরা ক্রিকেটের আর এক কুলিন বর্ণবাদদুষ্ট অস্ট্রেলিয়াকে ৭ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করে কাপ ঘরে তোলে। ফাইনালে অরবিন্দ ডি সিলভা, দলনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা ও গুরুসিনহের ব্যাটিং তান্ডবে অস্ট্রেলিয়ান বোলাররা চোখে-মুখে সর্ষে ফুল দেখেছিলো আর ফিল্ডারদের তো বল কুড়ো কুড়োতে প্যান্টই ঢিলে হয়ে গিয়েছিলো। আর এই পরাজয়টাকে কুলিনরা সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। জন্মলগ্ন থেকেই প্রবল প্রতিহিংসা পরায়ন ও বর্ণবিদ্বেষী জাতি হিসেবে পরিচিত অস্ট্রেলিয়ানরা কালো চামড়ার প্রতি অশালীন আচরণ করে আসছিলো এই পরাজয যেনো তাদের সেই বিদ্বেষকে আরো প্রবল করে তোলে। এরপর তারা রীতিমতো বেপড়োয়াভাবেই শালীনতা বিবর্জিত আচরণ শুরু করে দেয় ।

ওদিকে ইংরেজরা তো সব সময়ই নাক উচু স্বভাবের। এই উপমহাদেশে তারা পেশী শক্তিবলে দুশ’ বছর রাজত্ব করেছে, সেই সাথে চালিয়েছে নির্যাতনের স্টীমরোলার। একে একে নিপীড়িত জাতিগুলো সংগ্রাম মুখর হয়ে উঠেছে, ফিরিয়ে নিয়েছে আপন স্বাধীনতা আর লেজগুটিয়ে নিজেদের ভূ-খন্ডে ফিরতে বাধ্য হয়েছে ইংরেজরা। তবে অবস্থান বদলালেও এদের-চরিত্র পাল্টায়নি। প্রখ্যাত ভারতীয় লেখক বিনয় মুখোপাধ্যায় ‘যাযাবর’ ছদ্মনামে লিখিত তাঁর ‘দৃষ্টিপাত’ বইয়ে ইংরেজদের কু-রুচিপূর্ণ উচ্ছৃঙ্খল মানসিকতার কঠোর সমালোচনা করেছেন। তাদো অমানবিক আচার¬Ñআচরণ, মনুষ্যত্ব বিবর্জিত কার্যকলাপের বিবরণ এমনিভাবে আরো বহু লেখক-সাহিত্যিক তাদের লেখনিতে তুলে ধওেছেন। আসলেই ইংরেজদের রুচি যে কতোটা বিকৃত হতে পারে তা ইংল্যান্ড দলের সাবেক ক্যাপ্টেন অ্যালেক স্টুয়ার্ট লিখিত ‘এ ক্যাপ্টেন্স ডায়েরী’ গ্রন্থটিতে পাওয়া যায়। অ্যালেক তার বইয়ের এক স্থানে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বেশ অহঙ্কার করে লিখেছেন,‘আমি একবার শ্রীলঙ্কার একজন ক্রিকেটারকে ‘নিতম্বের ছিদ’্র বলে গালি দিয়েছি।’- এ কেমন ভাষা? ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেট আর সেই ক্রিকেটের সূতিকাগার ইংল্যান্ডের এক ভদ্র(!) অধিনায়ক স্টুয়ার্ট,Ñ এ কোন্ ধরণের ভাষা তার কন্ঠে! আর শ্রীলঙ্কান ক্যাপ্টেন রানাতুঙ্গা এর জবাবটা দিয়েছেন এভাবে, ‘আদব-কায়দা কি জিনিস তা স্টুয়ার্ট জানেন না।’ একই বছর অস্ট্রেলিয়ান বোলার শ্যেন ওয়ার্ণও আক্রমন করেন রানাতুঙ্গাকে। তিনি রানাতুঙ্গা সম্পর্কে টাইমসের একটি কলামে ‘রানাতুঙ্গা ফুরিয়ে গেছে, সে অসংযত’-ইত্যাদী বাজে মন্তব্য করেন। তার এ অশালীন মন্তব্য সম্পর্কে বেশ ঠান্ডা ভাষায় রানাতুঙ্গা জবাব দেন,‘শ্যেন যা পারে আমি তো আর তা পারি না। আসলে ওয়ার্ণের বক্তব্যের মধ্যেই  অস্ট্রেলীয় সংস্কৃতির আসল চেহারা বেরিয়ে এসেছে। আর এ কথা তো সকলেরই জানা যে, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হচ্ছে আড়াই হাজার বছরের পুরনো আর ওদেরটা তো জন্ম নিয়েছে সেদিন।’ ’৯৯-তে এই শ্যেন ওয়ার্ণ স্কটল্যান্ডে গ্যালারীর দর্শকদের দেখিয়েছিলেন হাতের মাঝের আঙ্গুলটিÑ যার অর্থ খুবই খারাপ। ক্রিকেট মাঠে এমন অসভ্যতা কার কাম্য? অবশ্য এজন্য আইসিসি তার পঞ্চাশ শতাংশ ম্যাচ ফি কেটে নিয়েছিলো এবং দু’ম্যাচ তাকে বহিস্কার করেছিলো। এমনিতেই গায়ের চামড়া সাদা বলে তাদের অহঙ্কারের শেষ নেই তার ওপর ’৯৬-এর বিশ্বকাপের ফাইনালে কলজের ওপর ছুরি চালিয়েছে লঙ্কানরা,Ñ সে যন্ত্রণা ভুলতে পারছেনা অস্ট্রেলিয়ানরা। অন্যদিকে তিন তিনবার ফাইনালে উঠেও কাপ জয়ের স্বাদ পায়নি ইংল্যান্ড, আর প্রাক্তন এ উপনিবেশ-এর কালোরা কিনা তাদের আগেই কাপ জয় করলো! এ যন্ত্রণার কথা কি আর সহজে ভোলা যায়? আর তাইতো ডেইলি টেলিগ্রাফ, গার্ডিয়ান-এর মতো বিখ্যাত ইংরেজী পত্রিকাগুলোও কালোদের পিছু ছাড়ছে না। সুযোগ পেলেই এক হাত চালানোর চেষ্টা করে। মুরালীকে তো এরা শান্তিতেই থাকতে দিচ্ছেনা।

নিজস্ব ক্রিকেটের আলোকমালায় দিলিপ মেন্ডিস, অর্জুনা রানাতুঙ্গা, অরবিন্দ ডি সিলভা, সনাৎ জয়সুরিয়া, রুমেশ কালুভিথারানা, রোশন মহানামা, মারভান আতাপাত্তু, হাসান তিলকারতেœ, চামিন্ডা ভাস, মাহেলা জয়াবর্ধনে, এরিক উপাশান্তা, প্রমোদ্য ক্রিমাসিংহে, চন্ডিকা হাথুরুসিংহে, রুয়ান কালপাগে, উপুল চন্দনা প্রমূখ অনেক প্রতিভাধর ক্রিকেটার শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটকে আলোকিত করেছেন।

ধীরে ধীরে বিশ্ব ক্রিকেটে উঠে আসছে কালোদের আর এক দেশ কেনিয়া। বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেও কেনিয়ার রয়েছে আর এক পরিচিতি। এই কেনিয়াকে ফাইনালে পরাজিত করইে ’৯৭ সালে বাংলাদেশে আসিসি শিরোপা ঘরে তোলে। বাংলাদেশের পরে আসিসি ট্রফিতে আবির্ভাব ঘটলেও কেনিয়া ক্রিকেটকে নব্বই দশকের গোড়ার দিক থেকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে। বিশেষ করে ’৯২ সালে জিম্বাবুয়ে টেস্ট স্ট্যাটার্স পাবার ফলে কেনিয়ার ক্রিকেটে আরো উৎসাহ বেড়ে যায়। ৯৬’-এর বিশ্বকাপে প্রথমবার খেলতে নেমেই তারা শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে চমক সৃস্টি করে। এরপর থেকে তারা সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। কেনিয়ার ক্রিকেটকে যেসব ক্রিকেটার আলোকিত করেছেন তারা হচ্ছেন, আসিফ করিম, স্টিভ টিকোলো, মরিস ওদুম্বে, রবীন্দু শাহ, হিতেশ মোদী, টমাস ওডোয়ো, কেনেডি ওটিয়েনো, মার্টিন সুজি, টনি সুজি, সন্দীপ গুপ্তা, মোহাম্মদ শেখ, জোসেফ আঙ্গারা প্রমূখ। এরা সকলেই ইতিমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছেন ক্রিকেটানুরাগীদের মনে।

এ্যা থ লে টি ক্স

ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের রাজা কার্ল লুইস

ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের রাজা কার্ল লুইস

বিশ্ব এ্যাথলেটিক্সে কৃষ্ণাঙ্গদের আধিপত্য একচ্ছত্র। জেসি ওয়েন্স, কার্ল লুইস, বেন জনসন, মাইক পওয়েল, মাইকেল জনসন, গেইল ডেভার্স,  ফ্লোরেন্স গ্রিফিত জয়নার, মালিন ওটি, জ্যাকি জয়নার কার্সিদের নাম কার না জানা। এই সব কালো চামড়ার দাপট বিশ্বকে শুধুই চমকৃত করেনি, সেই সাথে বিশ্ব এ্যাথলেটিক্সকে করেছে সমৃদ্ধ । বিশ্ব এ্যালেটিক্সের সব রেকর্ড আজ তাদেরই দখলে। তবে এই সাফল্যের পথে উঠে আসতে তাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। অনেক বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে কালোদের বঞ্চনার ইতিহাস আরো গভীরতরো। কিন্তু দিনে দিনে কালোরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ অবস্থান তৈরী করে সাদাদের সমীহই শুধু আদায় করেনি, তাদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের নির্ভরশীল হতে বাধ্য করেছে। কালোদের কারণেই আজ আমেরিকার মতো দেশের ক্রীড়া তাবৎ বিশ্বে প্রশংসিত। কিন্তু এক সময় সাদারা কালোদের এতোটাই অপছন্দ করতো যে, ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকে কৃষ্ণাঙ্গ এ্যাথলেট জেসি ওয়েন্স ৪টি স্বর্ণ পদক জয় করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলেও কর্মকর্তারা কেউ তাকে তাৎক্ষনিক অভিনন্দন পর্যন্ত জানাননি। একজন পশ্চিমা ঐতিহাসিকের মতে, ‘সময়টা ছিলো সম্পূর্ন কালোদের প্রতিকুলে। আর এ সময়টাতে ওয়েন্স অসাধ্য সাধন করে সাদাদের শ্রদ্ধা আদায়ে বাধ্য করেছিলেন। মাঠে উপস্থিত এক লাখ দর্শককে বিমোহিত করে ওয়েন্স ১০০মিটার দৌড় শেষ করলেন । তার বিস্ময়কর সাফল্য অনেকটা জোর করেই যেনো আদায় করে নিলো সেই এক লাখ দর্শকের করতালি।’ আমেরিকার ব্লাক প্যান্থার কার্ল লুইস তো অলিম্পিকসহ বিশ্ব এ্যাথলেটিক্সে সুবিশাল এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় তৈরী করে রেখেছেন। গেলো শতকের সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে যে এগারো জনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে তার ছয় নম্বরে আছেন কার্ল লুইস। বিশ্ব অলিম্পিকে এই কৃষ্ণাঙ্গ ৯টি স্বর্ণ জয় করেন। এর মধ্যে ৬টি জিতেছেন লং জাম্পে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপে ৮বার জয় করেছেন শিরোপা। ১০০ মিটার ¯িপ্রন্টে ১৯৯১ সালে ৯.৮৬ সেকেন্ড সময় নিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন তিনি।

ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের রাজপুত্র মাইকেল জনসন

ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের রাজপুত্র মাইকেল জনসন

বিশ্ব এ্যাথলেটিক্সের আর এক কৃষ্ণ রাজকুমার হচ্ছেন মাইকেল জনসন। যাকে ৮০০ মিটার ও ২০০ মিটারের সর্বকালে সেরা হিসেবে চিহিৃত করা হয়। বোদ্ধাদের মতে, ট্র্যাকে সব চাইতে কঠিন দৌড় হচ্ছে ৪০০ মিটার। এতে প্রয়োজন গতি, শারীরিক সামর্থ্য ও অফুরন্ত ধৈর্যের। আর মাইকেল জনসন এমন একজন দৌড়বিদ ছিলেন যিনি সবাইকে পেছনে ফেলে যখন সামনে ছুটে চলতেন তখন তার শরীরের উধ্বাংশ, পা ও বাহু রেল ইঞ্জেনের পিষ্টনের মতো ওঠানামা করতো। এ এক অপূর্ব শৈল্পিক দৃশ্য। যারা তার দৌড় দেখতেন তারা ব্যাপারটি বেশ উপভোগ করতেন। ট্র্যাকের দৌড়কে জনসন দিয়েছেন শিল্পের আদল। উনিশ শতকের প্রথম নয় দশকে কোনো দৌড়বিদই একই সঙ্গে ২০০ ও ৪০০ মিটাওে সোনা জয় করতে সক্ষম হননি। মাইকেল জনসনই প্রথম ’৯৬-এর অলিম্পিক আসরে এই দুই ইভেন্টে সোনা জয করেন। তিনি একাধারে রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়েছেন, অলিম্পিকপদকসহ নানা পদক জয় করেছেন, এমনকি টানা ৫৮ রেস জয়ের নজিরও স্থাপন করেছেন। ৪০০ মিটারে তার গড়া ৪৩.১৮ সেকেন্ড এবং ২০০ মিটারে ১৯.৩২ সেকেন্ড বিশ্বরেকর্ড দুটো আজও কারো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। উল্লেখ্য, এথেন্স অলিম্পিকে ২০০ মিটারে ১৯.৭৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে স্বর্ণ জয় করেছেন শন ক্রফোর্ড। ১৯৯৬-এর অলিম্পিকে ২০০ ও ৪০০ মিটারে স্বর্ণ, ২০০০-এর অলিম্পিকে ৪০০ ও ৪ী৪০০ মিটার রিলেতে স্বর্ণ, ’৯২-এর অলিম্পিকে ৪ী৪০০ মিটার রিলেতে স্বর্ন, ৪০০ মিটারে চারবার, ২০০ মিটারে দু’বার, ৪ী৪০০ মিটার রিলেতে তিনবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, ৯বার ইউএস আউটডোর চ্যাম্পিয়ন, আউটডোরে ২০০, ৪০০ ও ৪ী৪০০ মিটার রিলেতে ও ইনডোরে ৪০০ মিটারে বিশ্ব রেকর্ডধারী মাইকেল জনসন পেয়েছেন একবার সুলিভান এ্যাওয়ার্ড ও তিনবার জেসি ওয়েন্স এ্যাওয়ার্ড। ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড নিউজ পত্রিকা জনসনকে ৪০০ মিটারে ১০বার এবং ২০০ মিটারে ৫বার বিশ্বের এক নম্বর নির্বাচিত করেছে। জনসন বলেন, ‘সব কিছুরই একটা ধারা আছে। যদি আপনি ২০০মিটার দৌড়ান তবে আপনি ১০০মিটারও পারবেন। আর যদি আপনি ৪০০মিটার দৌড়ান তবে আপনি সবগুলোতেই পারবেন।’

ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের রাজকন্যা গ্রিফিত জয়নার

ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের রাজকন্যা গ্রিফিত জয়নার

আমেরিকার কালোকন্যা, জগত আলো করা নাম ফ্লোরেন্স গ্রিফিত জয়নার। ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে জয়নার ছিলেন আকর্ষনীয় এক চরিত্র। ১৯৮৮ সালে সিউল অলিম্পিকে ১০০মিটার স্প্রিন্টে ১০.৪৯ সেকেন্ড নিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েন। আজো যে রেকর্ড অক্ষুন্ন। এছাড়া সিউল অলিম্পিকে একই দিনে দু’টি বিশ্ব রেকর্ড গড়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন। ২০০মিটারের সেমিফাইনালে ২১.৫৬ সেকেন্ড এবং ফাইনালে ২১.৩৪ সেকেন্ড সময় নিয়ে তিনি এ বিশ্ব রেকর্ড দু’টি করেন। সিউলে জয়নার জয় করেন ৩টি স্বর্ণ ও একটি রৌপ্য পদক। হরিণের গতি সম্পন্ন এই কৃষ্ণকন্যাকে বলা হয় সিউল অলিম্পিকের কুইন। তবে কালো চামড়া বলে এই কুইনকে নিয়েও কম ষড়যন্ত্র হয়নি। অযথা হেনস্থা করা হয়েছে তাকে অনেকবার। ১১বার তার ডোপ টেস্ট করা হয়েছে, কিন্তু একবারো পজেটিভ হয়নি। আর ডোপ সংক্রান্ত হেনস্থা-হয়রানী ও অভিযোগের প্রেক্ষিতে ১৯৮৮ সালে সেরা মার্কিন এ্যাথলেট হিসেবে সুলিভান পুরস্কার পাওয়া সত্ত্বেও অভিমান করে ১৯৮৯ সালে এই ট্র্যাকের রানী ট্র্যাক থেকে বিদায় নেন । এর নয় বছর পর লস এ্যাঞ্জেলসের শহরতলীতে নিজ বাসভবনে হৃদ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে জীবনের ট্র্যাক থেকেও বিদায় নেন এই ভুবনজয়ী কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীড়াবিদ।

অপ্রতিরোধ্য গেইল ডেভার্স

অপ্রতিরোধ্য গেইল ডেভার্স

মহিলাদের ১০০মিটার  স্প্রিন্টে এক অবিস্মরনীয় রেকর্ডের অধিকারী হচ্ছেন আর এক কৃষ্ণকন্যা গেইল ডেভার্স। আজীবন কঠিন সংগ্রামী এই কালো মেয়েটি ১৯৯২ সালে বার্সেলোনা অলিম্পিক গেমস এবং ১৯৯৬ সালে আটলান্টা অলিম্পক গেমসে উপর্যুপরি দু’বার সোনা জিতে গোটা দুনিয়াকে চমকে দেন এবং অবিস্মরনীয় এক রেকর্ডের অধিকারী হন। এ ছাড়া ১৯৯৩ সালে জার্মানীর স্টুটগার্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্ব এ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশীপের ১০০ মিটার  স্প্রিন্ট ও ১০০ মিটার হার্ডলসে তিনি সোনা জয় করেন। আটলান্টা অলিম্পিকে ৪০০ মিটার রিলেতে সোনা জয়ী দলের সদস্যও ছিলেন তিনি । যদিও ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিক ও ২০০৪ সালের এথেন্স অলিম্পিকে অংশ নিযে তেমন সফল হতে পারেননি, তবে ৩৭ বছর বয়সেও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতা কররা সামর্থ্য ক’জন নারীর থাকে। উল্লেখ্য, ১৯৯২ সালে এ্যাথলেটিক্স ট্র্যাকে সাফল্য প্রদর্শনের আগে দু’বছর ডেভার্সকে লড়তে হয়েছে কঠিন ব্যাধির সাথে। ১৯৯০-৯১-এ জীবন আর মৃত্যুর মাঝামাঝি পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। এ সময়টাতে তাকে হুইল চেয়ার পর্যন্ত ব্যবহার করতে হয়েছিলো। কিন্তু প্রবল ইচ্ছা শক্তির বলে রোগ-ব্যাধিকে জয় করে তিনি ট্র্যাকে ফিরে আসেন এবং রানীর আসন দখল করেন পরপর দু’টি অলিম্পিকে।

এবার আসা যাক হেপ্টাথেলনের ব্লাক কুইনের কথায়। এই রানীর নাম জ্যাকি জয়নার কার্সি। হেপ্টাথেলন হচ্ছে একটি অলরাউন্ডিং ইভেন্ট। এ ইভেন্টের মধ্যে আছে ১০০ মিটার হার্ডলস, ২০০ মিটার ও ৮০০ মিটার দৌড়, হাই জাম্প, লংজাম্প, জ্যাভলিন ও শটপুট। আর এই অলরাউন্ডিং ইভেন্টে বিস্ময়কর কৃতিত্ব প্রদর্শন করে রানীর আসনটি দখল করে নিয়েছেন। এখনো তার নামেই যেনো ধ্বনিত হয় সাহস আর সংকল্প। ময়দানে লড়াইয়ের সাথে সাথে তিনি লড়েছেন দুরারোগ্য ব্যাধি হাঁপানী আর বহু ইনজুরির সাথে। কিন্তু রোগকে পরাস্ত করে, ইনজুরিকে পরাভূত করে প্রতিদ্বন্দ্বীদের ধরাশায়ী করে এই ব্লাক ডায়মন্ড রচনা করেছেন এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।

এই অসামান্য প্রতিভাধর এ্যাথলেট হেপ্টাথেলনে ’৮৪-এর অলিম্পিকে  জয় করেন রৌপ্য। এরপর ’৮৮ ও ’৯২-এর অলিম্পিকে জয় করেন সোনা। ’৯৩ ও ৯৭-এর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন শীপেও তিনি সোনা জয় করেন। ইউএস খেতাব জয় করেছেন ’৮২,’৮৭,’৯১,’৯৩ ও ’৯৫ সালে। ’৮৬ থেকে ’৮৮ পর্যন্ত চারবার গড়েছেন বিশ্বরেকর্ড। ৭২৯১ পয়েন্ট নিয়ে আজও তিনি অম্লান এক রেকর্ডের অধিকারী হয়ে আছেন। এই কৃষ্ণকন্যা লংজাম্পেও ছিলেন সমান পারদর্শী। ’৮৮-এর অলিম্পিকে এই ইভেন্টে তিনি জয় করেছেন স্বর্ণ। ’৯২ ও ’৯৬-এর অলিম্পিকে জয় করেছেন ব্রোঞ্জ। ’৮৭ ও ’৯১-এর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপে জয় করেছেন স্বর্ণ। ’৮৭,’৯০ ও ’৯৬ সালে জয় করেছেন ইউএস  খেতাব। ক্রীড়াক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখার জন্য তিনি নানাভাবে সন্মানিত হয়েছেন। ১৯৮৬ সালে লাভ করেছেন ‘সুলিভান এ্যাওয়ার্ড’, ১৯৮৮ সালে ‘জেসি ওয়েন্স এ্যাওয়ার্ড’। এ ছাড়া ১৯৯৯ সালে নির্বাচিত হয়েছেন ‘শতাব্দীর সেরা মহিলা এ্যাথলেট।’ কার্সি ছিলেন একজন আদর্শ ও বিনয়ী এ্যাথলেট। এই কৃষ্ণবর্ণ নারী যে শুধু সোনার মেডেল আর রেকর্ডগুলোর জন্যই স্মরণীয় হয়ে আছেন তা নয়। হাঁপানী ও ইনজুরির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার বলিষ্ঠ অধ্যায়টি আজও তাবৎ বিশ্বের ক্রীড়াবিদদের মনে টনিকের কাজ করে। কার্সি বলতেনÑ‘আসলে মানুষের অসাধ্য কিছু নেই, শুধু থাকতে হবে প্রবল ইচ্ছে শক্তি, কঠোর সাধনা, আর অতীতকে মনে করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা।’ তার ভাষায়,‘আমি কখনো ভুলে যাইনি যে, কোথা থেকে আমি এসেছি। একটা ছোট্র মেয়ে হিসেবে আমি আমার চারপাশটাকে দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। অনেক লাঞ্চনা-বঞ্চনাই আমার মনে উচ্চ স্বপ্নের জন্ম দিয়েছে আর আমি পরবর্তীতে প্রানান্ত চেষ্টা করেছি সেই স্বপ্ন পূরণের। এবং একদিন একের পর এক বাধা অতিক্রম করে আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।’ এই কথাগুলোতে কালো নারী কার্সির বর্ণÑবৈষম্যের যাতাকলে পড়ার দীর্ঘশ্বাসও কি পাওয়া যায়না? কার্সি আরো বলতেন,‘আমি সব সময় মানুষের মনে সাহস যোগাতে চাই যেনো তারা নিজের জীবনটাকে আমূল বদলে ফেলতে পারে। তবে আমি তাদের এ কথাটাও বলি যে, আমার পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন না, নিজের পথেই চলুন।’

জ্যামাইকার মার্লিন ওটিকে বলা হয় বলা হয় অ্যাথলেটিক্স ট্র্যাকের ‘কৃষ্ণ সুন্দরী’। সাজ-সজ্জার বাতিকের কারণে আকর্ষনীয় ফ্যাশন গার্ল হিসেবেও তার একটা পরিচিতি ওয়েছে। কালো হলেও তার অপরূপ সৌান্দর্য মুগ্ধ কওে সকলকে। ওটি সব সময়ই সৌন্দর্য সচেতন। ট্র্যাকে নামার আগেও দীর্ঘক্ষণ তিনি তার সাজ-সজ্জা নিযে ব্যস্ত থাকেন তারপর মাঠে নামেন। ট্র্যাকে এই কৃষ্ন সুন্দরী বিস্ময়কর কিছু না করতে পারলেও সব মিলিয়ে সফল বটে।

সিউল অলিম্পিক গেমস ১৯৮৮। আসরের সেরা ইভেন্ট একশ’ মিটার দৌড়ে সকল প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে স্বর্ণপদক জয় করলেন কানাডার কালো চিতা বেন জনসন। তবে এই স্বর্ণপদক বেন জনসনের গলায় ঝুলতে না ঝুলতেই অলিম্পিক কর্তৃপক্ষ তা কেড়ে নিলো ও ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সকল প্রতিযোগিতা থেকে তাকে বহিস্কার করা হলো। বেনের অপরাধ হচ্ছে সে নিষিদ্ধ ড্রাগ গ্রহণ করে দৌড়ে অংশ নিয়েছিলো। তার মূত্রের সঙ্গে পাওয়া যায় স্টেরয়েড। ক্রীড়া আইনে প্রতিযোগিতায় এ জাতীয় ড্রাগ গ্রহণ একটি শাস্তিযোগ্য জঘন্য অপরাধ। সে আসরে বেনের স্বর্ণ পদকটি কেড়ে নিয়ে আর এক কালো মানিক এবং দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী কার্ল লুইসের গলায় ঝুলিয়ে দেন অলিম্পিক কর্তৃপক্ষ। বহিস্কারের খড়গ এ্যাথলেট বেনের জীবনাবসান ঘটালেও সে যে বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী ছিলো এ কথা বোদ্ধামহল একবাক্যে স্বীকার করে থাকে।

অলিম্পিক গেমসে একশ’ মিটার ¯িপ্রন্টকে বলা হয় ইভেন্টের রাজা।  আবার অন্যভাবে বলা যায়, একশ’ মিটার হচ্ছে অলিম্পিকের সবচেয়ে হিট, হট, গ্ল্যামারার্স এন্ড ইমপটেন্ট ইভেন্ট। আবার কেউ কেউ একে হার্টথ্রুব ইভেন্টও বলে থাকেন। অনেক ক্রীড়ানুরাগী বলে থাকেন, একশ’ মিটার ¯িপ্রন্ট শেষ হয়ে যাবার পর অলিম্পিকের আকর্ষণ তেমন আর থাকেনা। কাজেই এই ইভেন্টটিকে ঘিরেই থাকে যতো উত্তাপ আর উত্তেজনা। আসলে এ হচ্ছে ট্র্যাকে মাত্র দশ এগারো সেকেন্ডের এক প্রলয়ঙ্কারী তান্ডব। দীর্ঘ উত্তেজনা, আবেগ, উচ্ছ্বাস মুহুর্তের মধ্যে শেষ হয়ে আনন্দ-বেদনার ঢেউ আছড়ে পড়ে স্টেডিয়ামে।  আর এই আনন্দটা সব সময় করে আসছে কালোরা। ইভেন্ট রাজের মুকুটটি সব সময়ই শোভা পেয়ে আসছে তাদের মাথায়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মরণপণ লড়ায়ের এই ইভেন্টে কালো সন্তানদের কল্যানেই যুক্তরাষ্ট্র অলিম্পিকে একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করে আসছে যুগের পর যুগ।

এথেন্স অলিম্পিক ২০০৪-এও এ ধারা রয়েছে অক্ষুন্ন। ইতিহাসের সেরা ¯িপ্রন্ট জিতে গোটা দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন যে ব্লাক প্যান্থার তিনি হচ্ছেন মার্কিনীদের নতুন কালো মানিক জাস্টিন গ্যাটলিন। এথন্সে একশ’ মিটার দূরত্ব পার হতে সময় নিয়েছেন ৯.৮৫ সেকেন্ড। তবে ইতিহাসের সব চাইতে তীব্র এ লড়াইয়ে আর যারা গ্যাটলিনের পেছনে ছিলেন তারা সকলেই কালো চামড়ার অধিকারী। ৯.৮৬ সেকেন্ড সময় নিয়ে রূপা জয় করেন পর্তুগালের ওবিকওয়েলু, ৯.৮৭ সেকেন্ড সময় নিয়ে ব্রোঞ্জ বিজয়ী আমেরিকার মরিস গ্রিন ছাড়াও জ্যামাইকার আসাফা পাওয়েল, আমেরিকার ক্রুফোর্ড, কলিন পাওয়েল, বার্বাডোজের ওবাডেলে টমসনÑ, মোট কথা একশ’ মিটার ¯িপ্রন্টের চূড়ান্ত রাউন্ডে অংশ নেয়া সকলেই কালো।  আবার ২০০ মিটার ¯িপ্রন্টে  প্রথম থেকে তৃতীয় সব ক’টি পদক উঠেছে আমেরিকানদের ঘরে তাদের কালো সন্তানদের কৃতিত্বে। ১৯.৭৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে সোনা জিতেচেন শন ক্রফোর্ড, ২০.০১ সেকেন্ড সময় নিয়ে রূপা জিতেছেন বার্নাড উইলিয়ামস, আর ২০.০৩ সেকেন্ড সময় নিয়ে ব্রোঞ্জ জিতেছেন জাস্টিন গ্যাটলিন। ৪০০ মিটারেও আমেরিকার কালোদের ছিলো একচ্ছত্র আধিপত্য। যদিও মেয়েদের একশ’ মিটার ¯িপ্রন্টে আমেরিকার কালো মেয়েদের টানা বিশ বছরের আধিপত্য খর্ব করেছেন বেলারুশের সাদা মেয়ে ইউলিয়া নেস্টেরেঙ্কো তবে এবারের অলিম্পিকেও কালো মেয়েদের সাফল্য কম ছিলো না। আসলে অ্যাথলেটিক্স মানেই কালোদের জয়জয়কার। অলিম্পিক গেমস মানেই কালোদের সাফল্যে উদ্ভাসিত ক্রীড়া উৎসব। অলিম্পিকের মতো বিশাল আসরের এই সব সফল ক্রীড়াবিদদের নাম এই স্বল্প পরিসরে তুলে আনা অসম্ভব। তবে একটি কথা বরাবরের মতোই বলা যায়, প্রতিটি অলিম্পিকের মতো এথেন্স অলিম্পিকও ছিলো কালোদের আলোয় আলোকিত। সফল সাদাদেও আমেরিকা এবারের আসরেও যে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে তার বেশীরভাগ এসেছে কালো ক্রীড়াবিদদের কল্যানে।

বা স্কে ট ব ল

ম্যাজিক জনসন

ম্যাজিক জনসন

ঐতিহাসিকদের মতে, কৃষ্ণাঙ্গ এবং বাস্কেট বল- যেনো একে অপরের জন্য তৈরী হয়েছে। একে অপরকে করেছে আলোকিত। বাস্কেট বল কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো যে, ১৯১১ সালের দিকে সব হাই স্কুলেই বাস্কেট বল টিম গঠন করা হয়েছিলো। এবং এ সব দলের মধ্যে জমজমাট প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। ১৯৫১ সালে কৃষ্ণাঙ্গরাই প্রথম জাতীয়ভিত্তিক দল গঠন করে। কৃষ্ণাঙ্গ আবদুল করিম জব্বার, ইরাভিন জনসন, মাইকেল জর্ডানের মতো বাস্কেট বল তারকারা আপন নৈপুণ্যে বিশ্বকে শুধু বিমোহিতই করেননি, এ খেলার মাধ্যমে তারা অর্থ বিত্ত জনপ্রিয়তা সবই করায়ত্ত করেছেন। অবাক করা ব্যাপার ফুটবলার, ক্রিকেটারর সবাইকে পেছনে ফেলে পৃথিবীর সব চাইতে দামী তারকাতে পরিনত হয়েছেন এদের অনেকেই । ধরা যাক মাইকেল জর্ডানের কথাই, বিশ্লেষকদের মতে, জর্ডানের কারণেই এনবিএ বাস্কেট বল লীগের জনপ্রিয়তা আমেরিকার সীমানা ছাড়িয়ে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিলো। জর্ডানের অদম্য মনোভাব, মনের জোর, চারিত্রিক দৃঢ়তা সব কিছুই তাকে শীর্ষ তারকা বানিয়েছে। পরিনত করেছে জীবন্ত কিংবদন্তীতে। জর্ডান ছিলেন পৃথিবীর সব চাইতে দামী খেলোয়াড়। যার আয়ের পরিমান ছিলো ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রয়েছে ক্লাব প্রদত্ত পারিশ্রমিক, স্পন্সর, টিভি সত্বের অর্থ  ইত্যাদি। ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা এই কৃষ্ণাঙ্গ সুপার স্টার তার ১৪ বছরের ক্যারিয়ারে ৯৩০টি ম্যাচে স্কোর করেছেন ২৯,২৭৭ পয়েন্ট। এই জগতজয়ী তারকা ১৯৯৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাস্কেট বল থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পৃথিবীর অন্য সকল খেলোয়াড়কে টপকে জর্ডান তিনটি ক্ষেত্রে ছিলেন শীর্ষস্থানে, ১. খেলোয়ড়ী জীবনে সব সময়ই ছিলেন স্পট লাইটে, ২. নামের যশের ক্ষেত্রে সব সময়ই ছিলেন শীর্ষে, ৩. সব চাইতে বিত্তবান খেরোয়াড়। বিশ শতকের সেরা ক্রীড়াবিদ হিেেসবে যে এগারো জনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে তার পাঁচ নম্বরে আছেন জর্ডান।

মাইকেল জর্ডন

মাইকেল জর্ডন

বিশ্ব বাস্কেটবলের আর এক নামী-দামী কৃষ্ণাঙ্গ সুপারস্টার হচ্ছেন ম্যাজিক জনসন। ছ’ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতার এই বাস্কেটবল তারকা ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের অহঙ্কার। তার ‘ম্যাজিক’ সমৃদ্ধ নৈপুণ্যর কারণেই আমেরিকানদের ঘরে উঠেছে বিশ্ব শিরোপাসহ অনেক সাফল্য। আপন নৈপুণ্যের কারণে খুব অল্প সময়েই এই সুপারস্টার পরিনত হন বিশ্বের অন্যতম দামী খেলোয়াড়ে। অর্জন করেন বিস্ময়কর জনপ্রিয়তা। বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়ে যান তিনি। কিন্তু সাফল্যের শিখরে উঠে অত্যাধিক নারী সঙ্গের কারণে এই বরেণ্য ক্রীড়াবিদ এইডসে আক্রান্ত হন এবং অশালে তার ক্যারিয়ারে ধ্বস নামে।

আজও বিশ্ব বাস্কেট বলে সেরা অলঙ্কার হিসেবে শোভাবদ্ধন করছেন কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়রা। বলা যায় বাস্কেটবল খেলাটি তাদের দখলেই।

বে স ব ল

জ্যাকি রবিনসন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ যিনি ব্র“কলিন ডারস ক্লাবে যোগদানের মাধ্যমে প্রথম বিভাগ বেসবল খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তবে কালোদের বেসবল খেলার ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৯০৫ সালে নিউইয়র্কের অ্যারগাইল হোটেলের প্রধান পরিচারিকা ফ্রাঙ্ক ম্পসন তার ক’জন সহযোগী পরিচারিকাকে নিয়ে প্রথম নিগ্রো বেসবল টিম গঠন করেছিলেন। শ্বেতাঙ্গদের রক্তচোখের মুখে সে সময় এ ধরণের দল গঠন করা নিগ্রোদের জন্য ছিলো বিরাট চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। তাই তারা নিগ্রো পরিচয় আড়াল করে নিজেদের কিউবান বলে পরিচয় দিতো। এ কারণে তারা আফ্রিকী ভাষার বদলে স্প্যানিশ ভাষা রপ্ত করতো। ১৯২০ সালে চার্লিগ্রান্ট নামের একজন কৃষ্ণাঙ্গ বেসবল খেলোয়াড়  নিগ্রো পরিচয় ঢেকে নিজেকে ইন্ডিয়ান পরিচয় দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে খুব বেশীদিন কৃষ্ণাঙ্গদের বঞ্চিত থাকতে হয়নি। ১৯৬২ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিনিধি জ্যাকি রবিনসন বেসবল হল অব ফেম নির্বাচনে জয়ী হলে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিকুল পরিস্থিতি অনেকটা কেটে যায়। কৃষ্ণাঙ্গরা ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বেসবলে একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করেছিলো। তারা ন্যাশনাল লীগে ১১ বারের মধ্যে ৭ বার চ্যাম্পিয়ন হয়।

ঘো ড় দৌ ড়

ঘোড়দৌড় খেলাটি যেনো কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য সংরক্ষিতই ছিলো। এ খেলায় কালোদের যেনো কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো না। ১৮৭৫ সালে যখন প্রথম ক্যানটাকি ডারবি দৌড় অনুষ্টিত হয় তখন যে ১৪/১৫ জন খেলোয়াড় এতে অংশ নিয়েছিলো তাদের সকলেই ছিলো কৃষ্ণ। অবশ্য এর কারণও ছিলো, সে সময় কালোদের ব্যাপকভাবে আস্তাবলের কাজ-কর্মে নিয়োগ করা হতো। উনিশ শতকের প্রথম দিকে অবশ্য এদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ১৯১১ সালের ক্যানটাকি ডারবি দৌড়ে  জেস কনলে ছিলেন একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়। উপনিবেশ আমলের অবসানের পর কালোদের ওপর ন্যস্ত আস্তাবলের কাজ-কর্মও হ্রাস পেতে থাকে। ঘোড়দৌড়ে কালোদের সংখ্যা কমতে থাকলেও যে কোনো প্রতিযোগিতায় যে ক’জন প্রতিযোগী অংশ নিতেন তারা বীরত্বের সাথেই কালোদের বিজয় ঝান্ডা তুলে ধরতেন। তবে কালোদের পক্ষে ইতিহাসের সব থেকে বড় কৃতিত্ব দেখান বর ম্যাককারডি। ১৯৬৩ সালে তিনি একশ’ সওয়ারকে পরাজিত করে বিস্ময়কর এক বিজয় অর্জন করেন। যা ঘোড়দৌড় ইতিহাসে কালোদের অবিস্মরণীয় অধ্যায়।

গ ল ফ

গলফের রাজা টাইগার উডস

গলফের রাজা টাইগার উডস

শুরুতে গলফ খেলাটি ছিলো কৃষ্ণাঙ্গদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। সে সময় এ খেলাটি শুধুমাত্র সাহেবদের খেলা হিসেবেই চিহিৃত ছিলো। কালোরা এর ধারে-কাছেও ঘেঁষতে পারতো না। অধিকাংশ গলফ ক্লাব ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ন্ত্রিত হতো বলে সেখানে শুধু মাত্র বিত্তশালীদেরই প্রবেশাধিকার ছিলো। গলফে কালোদের বঞ্চনার এ ধারা চলে অনেকদিন। ধীরে ধীরে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য গড়ে ওঠে দু’একটি ক্লাব। চার্লি সিফোর্ড ছিলেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ গলফ খেলোয়াড় যিনি পেশাজীবী গলফ খেলোয়াড়দের সমিতিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং ১৯৫৭ সালে ‘লং বীচ ওপেন’ জয়লাভ করে গলফ ওয়ার্ল্ডে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। এ ছাড়া এ খেলায় লি এল্ডার, পিট ব্রাইন আপন নৈপুণ্য গুণে কালোদের মর্যাদাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। আজকের দুনিয়ায় কালো চামড়ার টাইগার উড তো শীর্ষ খ্যাতি অর্জনকারী খেলোয়াড়। গলফ জগতে টাইগার উড মানেই এক বিস্ময়কর প্রতিভা। শুধু তাই নয় বিশ্ব ক্রীড়ার সব চাইতে দামী খেলোয়াড়ের মর্যাদাও তার দখলে। বিশ্বের সব চাইতে দামী ফুটবলার হচ্ছেন ডেভিড বেকহ্যামকে। বছরে তার আয় ১৮ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু শুনলে অবাক হবেন, টাইগার উডের আয়-রোজগারের কাছে ডেভিড বেকহ্যাম একেবারে ভিখেরীতুল্য। ২০০৪ সালের প্রথম দিকে ফোর্বস ম্যাগাজিন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী যে দশজন খেলোয়াড়ের নাম প্রকাশ করেছে তাতে স্থান পাননি বেকহ্যাম। অপরদিকে টাইগার উড রয়েছেন শীর্ষে। আয়-রোজগারে বিশ্বের এক নম্বর এই কৃষ্ণ গলফারের বাৎসরিক আয় দেখানো হয়েছে বছরে ৬৯ মিলিয়ন ডলার।

টে নি স

আর্থার অ্যাস

আর্থার অ্যাস

এক সময় টেনিসও ছিলো কালোদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।  সাদারা কালোদের টেনিস কোর্টের আশেপাশেই ভিড়তে দিতো না। এমনকি দর্শক হিসেবেও কালোরা ছিলো নিষিদ্ধ। ১৯৫১ সালের কথা। বিশ্ব টেনিসে কালোদের এক অভূতপূর্ব বিজয় অর্জিত হলো। বিশ্ব টেনিসের সেরা আসর উইম্বলডনে খেললেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অ্যালথিয়া গিবসন। এরপর তিনি ১৯৫৭ সালে তাবৎ বিশ্বকে চমকে দিলেন, জয় করলেন একই সাথে উইম্বলডনের সিঙ্গেলস এবং ডাবলস। বিশ্ব টেনিসে কৃষ্ণাঙ্গ আর্থার এ্যাসের নামটি চির স্মরনীয় হয়ে আছে। কালজয়ী এই কৃষ্ণাঙ্গ টেনিস খেলোয়াড় আজও টেনিসপ্রেমীদের হৃদয় জুড়ে আছেন।। তিনি উইম্বলডন, ইউএস ওপেন, অষ্ট্রেলিয়ান ওপেনসহ বিশ্বের সব ক’টি বড় টুর্নামেন্টের শিরোপাই শুধু জিতে নেননি, সেই সাথে ইউএস ডেভিসকাপ দলের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।

আশির দশক থেকে বিশ্ব টেনিসে কালোদের প্রভাব দারুণভাবে বেড়ে যেতে থাকে। ইয়ানিক নুহ, চিপ হুপার, লরি ম্যাকনিল, জিনা গ্যারিসন, মার্টিন ক্লাবম্যান, কে এ্যাডামস প্রমুখ টেনিস তারকারা বিভিন্ন সময়ে কৃষ্ণাঙ্গদের ঝান্ডা তুলে ধরেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব টেনিসে ঝড় তোলা দুই কৃষ্ণকলি হচ্ছেন উইলিয়ামস ভগ্নিদ্বয়। বিশ্ব টেনিসে সেরেনা উইলিয়ামস ও ভেনাস উইলিয়ামসের আলো টেনিসপ্রেমিদের চমকৃত করেছে। উইম্বলডন ২০০২-এর আসরে এক শতাব্দী পর একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখলো বিশ্ববাসী। ফাইনালে মুখোমুখি হলো দুইবোন ভেনাস ও সেরনা উইলিয়ামস। ১১৮ বছর আগে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিলো সেবার উইম্বলডনের ফাইনালে প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হয়েছিরেন দুই বোন মাউড ওয়াটসন ও লিরিয়ান। ২০০০ সালে এই দই বোনের দখলেই ছিলো টেনিস অঙ্গন।

সেরেনা উইলিয়ামস

সেরেনা উইলিয়ামস

এ কথা তো বলা যায় যে, বিশ্বে এমন কোনো খেলা নেই যাতে কৃষ্ণাঙ্গদের আধিপত্য নেই বা ছিলোনা। তবে অপ্রিয় হলেও সত্যি যে অন্য আলোকে আলোকিত কৃষ্ণাঙ্গদের কেউ কেউ শীর্ষস্থানে অবস্থান করে কালোদের জাতীয় জীবনে কালিমাও লেপন করেছেন। এদের মধ্যে মাইক টাইসন অন্যতম। পেলের মতো বিশ্ববরেণ্য তারকারও রয়েছে নারী কেলেঙ্কারীর বদনাম। আর আর্থার এ্যাশ তো এইডসেই মারা গেলেন। ম্যাজিক জনসন আক্রান্ত হযেছেন এইডসে। বিশ্ব ক্রিকেটের রাজকুমার লারার নারীঘটিত বদনামও কম নেই। পোশাক বদলানোর মতোই নাকি লারা নারী বদলান। শোনা গিয়েছিলো অতিরিক্ত নারীসঙ্গের কারণেই লারা কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। বঞ্চনা, অভাব, দারিদ্রপূর্ণ জীবন থেকে উঠে আসা কৃষ্ণাঙ্গদের কেউ কেউ বিপুল অর্থ-খ্যাতি আর যশের সন্ধান পেয়ে বিগড়ে যান। আর এদের দ্বারাই কিছু কালিমা ছড়িয়ে পড়ে কালোদের শরীরে, কিন্তু তা সুবিশাল আলোর সমুদ্রে এক ফোটা কলঙ্কের মাত্র।

এ জাতীয় লেখার কাজ বেশ কষ্টসাধ্য। পত্রিকা, পুস্তক, ইন্টারনেট বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে দীর্ঘ সময় ও পরিশ্রমে কার্পন্যহীনভাবে তুলে আনা যথাসম্ভব নির্ভূল তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে লেখাটিতে। সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরও যদি কোথাও কোনো ত্রুটি ঘাপটি মেরে বসে থাকে; তবে বিজ্ঞ পাঠক,  খোঁচা মেরে ত্রুটিটাকে ঘায়েল করতে চেস্টা করবেন আশা করি।

Leave a comment