• যতো লেখা

  • মাহাবুবুল হাসান নীরুর ই-গ্রন্থ 'সেরা দশ গল্প'। অসাধারণ দশটি গল্পের এক অনবদ্য উপস্থাপন। বইটি পড়তে ক্লিক করুনসেরা দশ গল্প
  • ছবি ফেলে আসা এবং চলমান সময়ের কথা বলে। ধরে রাখে সময়কে স্মৃদির ফ্রেমে। মাহাবুবুল হাসান নীরু অ্যালবামটি দেখতে ক্লিক করুনঅ্যালবাম
  • মাহাবুবুল হাসান নীরুর ই-গ্রন্থ 'হৃদয়ছোঁয়া পঁয়ত্রিশ'। দৃষ্টিনন্দন অলঙ্করণ আর মন-জমিনে দাগ কাটার মতো পঁয়ত্রিশটি ছড়া-কাব্য। বইটি পড়তে ক্লিক করুনকাছের মানুষ
  • মাহাবুবুল হাসান নীরুর খেলাধুলা বিষয়ক লেখা পড়ার জন্য ক্লিক করুনখেলা
  • মাহাবুবুল হাসান নীরুর শিশুতোষ লেখাগুলো পড়তে ক্লিক করুনশিশুতোষ রচনা
  • মাহাবুবুল হাসান নীরুর গল্প পড়তে ক্লিক করুনগল্প
  • মাহাবুবুল হাসান নীরুর ছড়া পড়তে ক্লিক করুনE-BOOK
  • এক মাসের লেখা

আমাদের ফুটবলের বেলা অবেলা কালবে‍লা

একটি্ বিশেষ নিবন্ধ

foota24[1]

মা হা বু বু ল   হা সা ন   নী রু

ফুটবল এদেশের মাটি ও মানুষের প্রাণের খেলা। ফুটবলের নামে এদেশের মানুষের রক্তে নাচন লাগে, প্রাণে উৎসব জাগে। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশটির টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া- কোথায় নেই ফুটবলের প্রতি মানুষের গভীর ভালোবাসা? নানা কারণে যদিও আজ এদেশের ফুটবল সংকটাপন্ন, কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবল তো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, এদেশে ফুটবলের কী অসম্ভব জনপ্রিয়তা! সদ্যসমাপ্ত বিশ্বকাপ ফুটবলের কথাই ধরুন। বিশ্বকাপকে ঘিরে এদেশের আমজনতার সে কী উৎসাহ-উদ্দীপনা, উত্তাপ-উত্তেজনা! রাত জেগে খেলা দেখার কতো আয়োজন! প্রিয় দলের পতাকায় ছেয়ে গিয়েছিলো গোটা দেশ। বিশ্বকাপ চলাকালীন একটি মাস সারা দেশ কেঁপেছিলো ফুটবলের শ্লোগানে। আড্ডা-আলোচনার মূল বিষয় ছিলো ফুটবল।

এদিকে এ বছর পেশাদার লীগ চালুর মধ্য দিয়ে আমাদের মৃতপ্রায় ফুটবল গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। কিন্তু যথাযথ পদক্ষেপ ও প্রয়োজনীয় প্রচার প্রচারণার অভাবে এ ফুটবল সেভাবে আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারছে না। এ বছর প্রথম পেশাদার ফুটবল লীগ অনুষ্ঠিত হয়েছে বলতে গেলে দর্শকশূন্য মাঠে। প্রথম পেশাদার ফুটবল লীগের শিরোপা জয় করেছে আবাহনী ক্রীড়াচক্র। তবে পেশাদার লীগের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে সব কথা বলার সময় এখনো আসেনি। কিন্তু যা সত্যি তা হলো, এ লীগ সম্পর্কে বাফুফে আরো বেশী সচেতন না হলে এর ভবিষ্যতও তেমন মঙ্গলময় হবে না।

এদেশে ফুটবলের জনপ্রিয়তা আজও গগণচুম্বী। বিগত দিনে শহর থেকে গঞ্জ-গ্রাম কোন্ মাঠেই বা না বসতো ফুটবলের উৎসব? একসময় ঢাকা লীগ বা ফেডারেশন কাপের লড়াইকে ঘিরে কী মাতোয়ারাই না হয়ে উঠতো সারাদেশ! খেলোয়াড়দের পায়ে-বলে আগুন আর স্টেডিয়ামভরা দর্শকের উল্লাস-উত্তেজনা- মহান ফুটবলের সে কী মোহনীয় রূপ! হৃদয় ছোঁয়া আহবান! ফুটবলের সেই প্রতিযোগিতা আজ নেই, কিন্তু দেশের মানুষের রয়েছে ফুটবলের প্রতি প্রবল টান, প্রগাঢ় ভালোবাসা। চলুন না একটু হাঁটা যাক এই কালজয়ী ফুটবলের এ দেশীয় ইতিহাসের পথ ধরে।

তবে শুরুতেই একটা কথা বলে নেই, আমাদের ‘অতীত’ নামের পুরনো তোবড়ানো ট্রাঙ্কের ভেতোরে গড়ে ওঠা উঁই-ইঁদুর আর আরশোলার রাজত্ব থেকে ইতিহাসকে উদ্ধার করা খুব সহজ কাজ নয়। তা যেকোনো ক্ষেত্রের কথাই বলা হোক না কেনো। ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে আমাদের অনীহা আর অবহেলার কথা কার না জানা। ইতিহাস-ঐতিহ্য লালন কিংবা সংরক্ষণে এ জাতির কার্পণ্য বা আলস্যের জুড়ি নেই। অতীতকে ‘অতীত’ বলে কালের গর্ভে চালান করে দিতে আমরা পটু। ফলে কোনো ক্ষেত্রে ইতিহাস ঘাটতে গেলে একেবারে যেনো অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে হয়। রাষ্ট্রীয় কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ইতিহাস সংরক্ষণের মানসিকতা নেই বলে, যারা ইতিহাস-ঐতিহ্যের সন্ধানে পা বাড়ান, তাদের পড়তে হয় দুঃখজনক অন্ধদশায়। পরে ছুটতে হয় প্রবীণ, কিংবা বোদ্ধা বা জানা শোনা এর ওর কাছে, অথবা কড়া নাড়তে হয় সংগ্রাহকদের দ্বারে, কিংবা ঝুঁকতে হয় পুরনো দিনের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার পাতায়। এ লেখাটি লিখতে গিয়ে আমাকে আমাদের ফুটবলের ইতিহাসের অনেক বাঁকে থমকে যেতে হয়েছে। কখনো তথ্য যোগাড় করতে গিয়ে অপ্রতূলতা বা অসংলগ্নতার কারণে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়েছে। আবার একই ঘটনার বিভিন্ন সূত্রে অভিন্ন চিত্র বা বর্ণনা না পাবার ফলে বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়েছে। তারপরও যতোটা সম্ভব চেষ্টা করেছি সঠিক তথ্য তুলে এনে লেখাটিতে নির্ভূল তথ্য উপস্থাপন করতে। এরপরও যদি কোনো কারণে লেখাটির কোথাও কোনো দুর্বলতা কিংবা ত্রুটি চোখে পড়ে, বা যদি কোনো কৃতি ফুটবলার অথবা সংগঠকের নাম বাদ পড়ে থাকে – সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের নির্ভুল তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার সবিশেষ অনুরোধ রইলো। নির্ভুল, নিখুঁত ইতিহাস সংরক্ষণ এবং লালনই হোক আমাদের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার।

উ প ম হা দে শে ফু ট ব লে র আ বি র্ভা ব

foota24[1]প্রথমেই আলোকপাত করা যাক, উপমহাদেশে কেমন করে এলো এই বরেণ্য ফুটবল। আর কেমন করেই বা সে করলো এ অঞ্চলের মানুষের হৃদয়। একটি বিদেশী খেলা হওয়া সত্ত্বেও কি করে খেলাটা মিশে গেলো এদেশের মাটি ও মানুষের মাঝে? কেমন করেই বা বিজয় রথ উড়িয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো নগর-বন্দর, গ্রামে-গঞ্জে? কি জানতে ইচ্ছে করে না সে ইতিহাস?

এই উপমহাদেশে ফুটবলের আবির্ভাব সম্পর্কে জানা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলে গঙ্গার ঘাটে নোঙ্গর করা দু’টো বিলেতি জাহাজে করেই এসেছিলো ‘ফুটবল’ নামের এই আজব খেলার বীজ। একদিন সকালবেলার সোনারোদ ছড়িয়ে পড়া একটি পুরনো কেল্লার মাঠে জাহাজের ফুটবল নিয়ে নামলো বিলেতি নাবিকরা । তারা যখন ফুটবল খেলছিলো তখন কেল্লার সৈনিকদের চোখ তো ছানাবড়া। এ আবার কি খেলা রে বাবা! তারা নাবিকদের খেলা দেখতে লাগলো অবাক চোখে এবং একসময় নিজেরাও যোগ দিলো নাবিকদের সাথে। লাথি মারলো ফুটবলের গায়ে। উপমহাদেশে এই হলো কালজয়ী ফুটবলের গোড়াপত্তন। এটা হচ্ছে লোকমুখে চালান হয়ে আসা একটা অলিখিত ইতিহাস। কাগজে-কলমে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে নথিপত্র ঘাটলে দেখা যায়, এসপ্লানেড ময়দানে ১৮৫৪ সালের এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রথম ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হয়। খেলাটিতে কলকাতার শীর্ষস্থানীয় রাজপুরুষদের সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন ব্যারাকপুরের ইংরেজ সাহেবরা। এ খেলায় অংশ নেয়া দল দু’টির একটির নাম ছিলো ‘ক্যালকাটা অফ সিভিলিয়ানস’ আর অপরটি ‘জ্যান্টলম্যান অফ ব্যারাকপুর’। এই খেলাটির পর পরবর্তী ১৪ বছর আর ফুটবলের কোনো অস্তিত্ব নথিপত্রে মেলে না। এরপর আবার ফুটবলের সাক্ষাৎ মেলে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর। সিপাহী বিদ্রোহের জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড থেকে বেড়িয়ে ইংরেজরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আবার খেলাটির দিকে মনোযোগ দেয়। বলা যায়, এখান থেকেই ফুটবল উপমহাদেশে তার জয়যাত্রা শুরু করে।

১৮৬৮ সালে এসপ্লানেড ময়দানে অনুষ্ঠিত হলো এক প্রীতি ম্যাচ। এতে ‘আইসিএস’দের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত বিদ্যালয় ইটনের সাবেক ছাত্রদের নিয়ে গঠিত ‘হটোনিয়াস ক্লাব’। এ খেলায় হটোনিয়াস ৩-০ গোলে জয়লাভ করে। হটোনিয়াস ক্লাবের হয়ে চমৎকার নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন খোদ কলকাতার সে সময়ের গভর্ণর রবার্ট ভ্যানসিটার্ট। তিনি একাই ২টি গোল করেন । অপর গোলটি করেন ডব্লু এইচ ট্রান্ট।

দু’বছর বন্ধ থাকার পর ১৮৭০ সালে আবার ফুটবল শুরু হলো এসপ্লানেট মাঠে। এ সময় লড়াই হতো পাবলিক স্কুল হ্যারো, ইটন, উইনচেস্টারের ছাত্রদের সাথে প্রাইভেট স্কুল মিসটিনার ছাত্রদের। এদের খেলা দেখার পর খেলাটি খেলতে বেনিয়া সাহেবদেরও সাধ জাগে। তারা দল গঠন করে খেলতে নামে এবং প্রথম খেলাতেই হেরে যায় আইসিএস-এর কাছে।

বলাবাহুল্য, ব্রিটিশ সম্রাজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিলো বলে সে সময় কলকাতার বন্দরে ভিড়তো বড় বড় জাহাজ, আর এসব জাহাজের নাবিকদের সাথে কেল্লার সেনাদের ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হতো।

১৮৭২ সালে গঠিত হয় এক ফুটবল ক্লাব। যে ক্লাবের খেলোয়াড়রা ফুটবল খেলতো অনেকটা রাগবির মতো করে। জানা যায়, শুধু ফুটবল খেলার জন্য ট্রেডস ক্লাব নামে একটি ক্লাব গড়ে ওঠে ১৮৭৮ সালে। উদ্যোগটা ছিলো ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের। সে সময় ডালহৌসী ইনস্টিটিউট ছিলো ক্যালকাটা ট্রেডস এসোশিয়েশনের প্রধান কর্মস্থল। আর যার কারণে পরে ট্রেডস ক্লাবটি ডালহৌসী ক্লাবে রূপান্তরিত হয়। ইতিমধ্যে ফুটবল তার কালজয়ী আলোকমালার সূচনা করে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সরকারী ও মিশনারী স্কুলগুলোতে। এ সময় শিক্ষিত বাঙালীরা ফুটবলের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। ১৮৭৯ সালে মি. বি ভি গুপ্ত নামের এক ভদ্রলোক গড়ে তোলেন প্রেসিডেন্সি কলেজ ক্লাব। শুরুতে ক্রিকেটের প্রতি এই ক্লাবের ঝোঁক থাকলেও পরবর্তীতে এরা ফুটবলও খেলতে শুরু করে। নথিপত্রে পাওয়া যায়, ১৮৮৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের বাঙালী ছাত্ররাই প্রথম ফুটবল খেলে। আর এ আয়োজনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন স্ট্যাক নামের এক অধ্যাপক। তিনি গাঁটের পয়সা খরচ করে ফুটবল কিনে এনে ছাত্রদের মাঠে নামান। এ বছরই গঙ্গার এপাড়ে ‘নেভাল ভলান্টিয়ার্স ক্লাব’ আর ওপাড়ে ‘হাওড়া ইউনাইটেড ক্লাব’ গড়ে ওঠে। ‘নেভাল ভলান্টিয়ার্স ক্লাব’ পরে অবশ্য ‘ক্যালকাটা রেঞ্জার্স ক্লাব’ নাম ধারণ করে। আর্মেনিয়ানরাও তখন একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে। এ সময়টাতে বিভিন্ন কলেজে ফুটবলের প্রসার বাড়তে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিকেল কলেজ, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ। যদিও এসব কলেজের ছাত্রদের মধ্যে বাঙালী ছিলো না বললেই চলে।

দিন বদলের সাথে সাথে ফুটবলও গড়াতে থাকে সোনালী অধ্যায় রচনার লক্ষ্যে। সে সময় ফুটবল সাধারণদের কাছে সাহেবী খেলার মর্যাদা পেতো। স্বভাবতই নিজেদের মর্যাদার পরিধি বাড়াবার জন্য কলকাতার নব্য বাবুরা এই খেলার প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। সাহেবী ঢঙ্গে জীবন যাপনে অভ্যস্ত শোভাবাজারের রাজপরিবারের সদ্যরা ১৮৮৫ সালে গড়ে তোলেন ‘শোভাবাজার ক্লাব’- যা প্রথম বাঙ্গালী ক্লাব হিসেবে স্বীকৃত। এরপর জন্ম নেয় ‘কুমারটুলি ক্লাব’। ১৮৮৪ সালে কলেজ ছাত্রদের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠলো ‘ওয়েলিংটন ক্লাব’। পরে এই ক্লাবের সদস্যদের একটা অংশ অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে বিভক্ত হয়ে গড়ে তোলে ‘টাউন ক্লাব’। এ সময় দক্ষিণ কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ন্যাশনাল ক্লাব’।

দিনবদলের সাথে সাথে ফুটবলের রঙ ছড়িয়ে পড়তে লাগলো উপমহাদেশের মানুষের অন্তরে। ফুটবল খেলতে নেমে অন্যরকম একটা আনন্দ আর মজা পাওয়ার কারণে খেলাটির জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে থাকে। ঘটতে থাকে এর প্রসার। আর কলকাতায় ফুটবলের এ প্রসারে আরো বেশী উৎসাহী হয়ে ওঠে ইংলিশ বনিকরা। সে আমলে অর্থাৎ ১৯৮৯ সালে পাঁচশত টাকা দিয়ে একটি কাপ বানিয়ে তারা শুরু করে ‘ট্রেভস কাপ’-এর প্রতিযোগিতা। অবশ্য এ প্রতিযোগিতা বলতে গেলে সাদা চামড়াদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো। কেননা একমাত্র শোভাবাজার ছাড়া এ আয়োজনে আর কোনো বাঙালী ক্লাব খেলার অনুমতি পায়নি। ট্রেভস কাপ-এর প্রথম শিরোপা জয় করে ডালহৌসী ক্লাব। এরপর ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে সেন্ট জেভিয়াস কলেজ, মেডিকেল কলেজ ও শিবপুর কলেজ এই কাপ জয় করে। কুচবিহারের মহারাজার উদ্যোগে ১৮৯৩ সালে চালু হয় ‘কুচবিহার কাপ’। এর পরের বছর ইংলিশ ছাত্রদের জন্য ‘ক্যাডেট কাপ’ আর বাঙালী ছাত্রদের জন্য ‘এলিয়ট শিল্ড’ প্রবর্তিত হয়। ১৮৯৮ সালে প্রথম বিভাগ লীগ চালু হলেও ১৯১৬ সাল পর্যন্ত এ লীগে কোনো ভারতীয় দল খেলার সুযোগ পায়নি। তবে সেকেন্ড ডিভিশনে দু’টি বাঙালী দল মোহনবাগান ও এরিয়ান ক্লাব খেলার সুযোগ পেতো।

অপর একটি সূত্রমতে, উপমহাদেশে বড় মাপের একটি প্রতিযোগিতা চালানোর জন্য ১৮৯৩ সালে গড়ে তোলা হয় ‘ইন্ডিয়ান ফুটবল এসোসিয়েশন’, যা ‘আইএফএ’ নামে পরিচিত। এই এসোসিয়েশনই একই বছর শুরু করে ‘আইএফএ শিল্ড’ প্রতিযোগিতা। জানা যায়, এই প্রতিযোগিতার উদ্যোক্তা ছিলেন জার্মান সাহেব স্যার এ.এ আপকার, ইংরেজ সাহেব জে সাদারল্যান্ড এবং কুচবিহার ও পাতিয়ালয়ের দুই মহারাজ। শিল্ডটি তৈরী করে কলকাতার ওয়াল্টার লক কোম্পানীর মাধ্যমে লন্ডনের বিখ্যাত এলকিংটন কোম্পানী। আর এ শিল্ডের গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ক্লাব, গোরা সৈন্যদের দল এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটি একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে।

উনিশ শতকে ফুটবল মূলত সাহেব ও তাদের সেনা ছাউনীর সীমানাবন্দী থেকে কচ্ছপ গতিতে এগিয়েছে। এখানে ভারতীয়দের বঞ্চনারও একটা করুণ ইতিহাস আছে। বর্ণবিদ্বেষী ইংরেজরা নিজেদের খেলা বলে ফুটবল থেকে ভারতীয়দের যতোটা পারতো দূরে ঠেলে দিতো। তবে তা সত্ত্বেও এই খেলাটি দিনে দিনে শ্বেতাঙ্গ বাবুদের সেই সীমানার দেয়াল টপকে ধরা দেয় ভারতীয়দের কাছে। ক্রমে ক্রমে ফুটবলকে ঘিরে গড়ে ওঠে ছোট-বড় ক্লাব। একথা তো সকলেরই জানা যে, বৃটিশ শাসনামলে এদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-খেলাধুলা সবকিছুই ছিলো হিন্দুদের দখলে। আর তাদের এই আধিপত্যের মুখে মুসলিম সম্প্রদায় ছিলো বড়ই অসহায়। আর যার কারণে বৃটিশদের পর ফুটবল ছিলো হিন্দুদের পায়ে। উনিশ শতকের শেষ দশকে জন্মলাভ করা কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ফুটবলকে মুসলিম শিবিরে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। কারো কারো মতে, এ ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই তৎকালীন বাংলার পূর্বাঞ্চলে ফুটবলের ফরোয়ার্ড মার্চ শুরু হয়। দিনে দিনে এই অঞ্চলের অনেক স্থানে মোহামেডানের বহু ইউনিট জন্ম নেয়। গেলো শতাব্দীর বিশের দশকে প্রতিষ্ঠিত অনেক ইউনিটের একটি হচ্ছে কুমিল্লা মোহামেডান। শুধু কি তাই, সে সময়ে মুসলমানের রাজনৈতিক উথ্থানের পেছনেও রয়েছে ফুটবল এবং এই ক্লাবের একটা বিশেষ ভূমিকা। বৃটিশদের কু-শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে যখন ভারতীয়দের মধ্যে আন্দোলন দানা বাঁধছিলো, ভারতীয় রাজনীতির তাওয়া যখন ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছিলো সে সময় নবাবজাদা আজিজুল ইসলাম ফুটবলের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা দেখে এবং মুসলমান সমাজকে ফুটবলের প্রতি আকৃষ্ট করতে অর্থাৎ ১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন জুবিলী ক্লাব। পরে এই ক্লাবটির নাম দু’বার পরিবর্তিত হয়েছে। প্রথমে ক্রিসেন্ট ক্লাব ও পরে হামিদিয়া ক্লাব। এই ক্লাবটি সর্বশেষ ১৮৯১ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব নামধারণ করে নতুন পথে যাত্রা শুরু করে। তবে প্রথম দিকে এ যাত্রা পথ কুসুমাচ্চীর্ন ছিলো না। বরং বলা যায় প্রবল প্রতিকূলতা তাকে গ্রাস করে। বিশেষ মহলের রক্তচক্ষু আর আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে শুধু নামের অস্তিত্ব নিয়েই ক্লাবটিকে চলতে হয় প্রায় তিনটি দশক। মূলত এরপরই শুরু হয় অবিস্মরনীয় ইতিহাস রচনার পালা।

আমরা মুখে যতোই বলি না কেনো যে, খেলাধুলার সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। বাস্তব সত্যি হচ্ছে, ক্রীড়াক্ষেত্রে রাজনীতির একটা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ প্রভাব সবসময় ছিলো, এখনো আছে। গত শতাব্দীর বিশের দশক থেকেই ভারতবর্ষে কংগ্রেস, খেলাফত আন্দোলন, চট্রগামের অস্ত্রাগার লুটসহ উত্তপ্ত নানা রাজনৈতিক কর্মকান্ডের প্রেক্ষাপটে হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায় স্বতন্ত্র আবাসভূমির দাবীতে যখন সোচ্চার হয়ে ওঠে সে সময় কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব কলকাতা ফুটবল লীগের দ্বিতীয় বিভাগ থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম বিভাগে উন্নীত হয় এবং এখান থেকেই শুরু হয় তাদের লাগাতার বিজয় যাত্রা। ’৩৫ থেকে ’৩৮ টানা পাঁচ বছর এই ক্লাবটি কলকাতা লীগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করলে মুসলমানদের মধ্যে নবজাগরনের সৃষ্টি হয়। এবং মুসলমানদের এই নবজাগরণ তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনকে বেগবান করতে বিশেষ ভুমিকা রাখে। অপরদিকে মোহামেডানের এই অভূতপূর্ব সাফল্যে ঈর্ষান্বিত মৌলবাদী হিন্দু সম্প্রদায় বিচলিত হয়ে পড়ে। তারা সোচ্চার হয়ে ওঠে মোহামেডান তথা মুসলমানদের অগ্রগতি রুখতে। এ লক্ষ্যে তাদের একটা অংশ নানা অপকর্ম এবং অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়। তারা ক্লাবটির বিরুদ্ধে ইংরেজদেরও ক্ষেপিয়ে তোলে। এক সময় ইংরেজরা ক্লাবটিকে ‘ইংরেজ বিরোধী ঘাঁটি’ হিসেবে চিহিৃত করে এর খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের ওপর নানা নির্যাতনের মাধ্যমে দমন নীতি প্রয়োগ করে। জানা যায়, বৃটিশদের কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে এই মোহামেডান ক্লাবে একবার আশ্রয় নিয়েছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এখানে আত্মগোপন করে থাকার সময় তিনি মোহামেডানকে নিয়ে একটা গানও লিখেছিলেন। নজরুলের প্রসঙ্গ যখন এলোই তখন এখানে তার আর একটি পরিচয়ের কথা না বলে পারছি না। আমার ধারণা, নজরুলের এ পরিচয়টা অনেকেরই অজানা। নজরুলও একসময় ফুটবল জগতের একজন ছিলেন। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে মুসলমানদের প্রথম পত্রিকা সওগাত-এর সম্পাদক নাসিরউদ্দিনের মুখোমুখি হয়েছিলাম একাধিকবার। সে সাক্ষাৎকারে কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে স্মৃতিচারণকালে নাসিরউদ্দিন বলেছিলেন, ‘নজরুলের বয়স যখন ৭/৮ বছর তখন তার সঙ্গে আমার পরিচয়। নজরুলকে আমি ফুটবল এবং দাবা খেলতে দেখেছি। তবে ও আড্ডা মারতে বেশী পছন্দ করতো। আবার অনেক সময় দেখা যেতো বল নিয়ে সারাদিন মাঠে পার করে দিতো। এ সময় সে খাওয়া-দাওয়ার কথাও ভুলে যেতো।’ আর নিজের ফুটবল খেলা সম্পর্কে এই বরেণ্য ব্যক্তিত্ব বলেছেন, ‘মাঝে মাঝে আমিও ফুটবল খেলতাম, তবে আমাদের সময়টাতে ফুটবল ছিলো অনেকটা দুর্লভ আর যার কারণে আমরা আশেপাশের গ্রামের ছেলেরা মিলে জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলতাম।’ এ সময় সওগাত সম্পাদক ফুটবল খেলতে গিয়ে তাঁর একটি মজার ঘটনার বর্ণনা দেন এভাবে-‘ আমরা ক’জন ছেলে জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলছিলাম। অনেক চেষ্টা করেও আমি গোল করতে পারছিলাম না। যখন পায়ের কাজে ব্যর্থ হলাম তখন হঠাৎ করেই জাম্বুরাটা হাত দিয়ে তুলে গোলবারের ভেতোরে ছুঁড়ে মারলাম। গোল হলো। কিন্তু কোনো খেলোয়াড়ই আমার সে গোল মেনে নিতে চাইলো না। শেষ পর্যন্ত হৈ চৈ আর তর্কাতর্কির মধ্য দিয়ে সেদিনের খেলা শেষ হলো।’

সে যাই হোক, মুসলিম সমাজে ফুটবলের জাগরণের স্রষ্টা কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব বিভিন্ন সময়ে নানা বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হলেও সাফল্যের ঝান্ডা কখনোই তাদের হস্তচ্যুত হয়নি। গত শতকের সত্তর দশক পর্যন্ত এই দলটি ভারতীয় ফুটবলে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে ছিলো। আজ অবশ্য সেই টগবগে যৌবন নেই।

ঢা কা র ফু ট ব ল লী গ

foota24[1]ঢাকার ফুটবল লীগ শেষ হওয়ার পর পত্র-পত্রিকায় লীগের যে ‘রোল অব অনার’ প্রকাশ করা হয়, তাতে দেখা যায়, ঢাকার ফুটবল লীগের প্রথম আসর বসেছিলো ১৯৪৮ সালে। তবে এই তথ্য যে ঠিক নয়, সেটা ইতিহাস ঘাঁটলেই বেড়িয়ে পড়ে। কোথাও কোথাও পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, এরও অনেক আগে শুরু হয়েছিলো ঢাকার ফুটবল লীগ। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার ঈদসংখ্যায় মুদ্রিত একটি নিবন্ধে একটি ঘটনার বর্ণনা করা হয়েছিলো এভাবে- ১৯২৯ সালে ঢাকার নবাব পরিবারের এক সন্তান ঢাকার ফুটবল লীগে অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দের মধ্যে জাকাত বন্টন করতে গিয়ে খেলোয়াড়দের দ্বারা আক্রান্ত হন। খেলোয়াড়দের কারো কারো ভাগে টাকা কম পড়াতে তারা নবাব পরিবারের সেই সদস্যকে আক্রমন করে। খবর পেয়ে নবাব বাড়ির গার্ডরা খেলোয়াড়দের ওপর পাথর ছুঁড়ে আহত সদস্যকে উদ্ধার করে। উল্লেখ্য, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেবার পুরনো ঢাকায় ঈদ উৎসব পালিত হয়েছে অত্যন্ত ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে।

এদিকে পুরনো ঢাকার লোকমান নামের এক বাসিন্দা তার স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে- ‘আমার দাদা পাকিস্তান মাঠে (বর্তমানে বাংলাদেশ মাঠ) অনুষ্ঠিত ঢাকা ফুটবল লীগের দর্শক ছিলেন। সে সময় লীগে অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা ছিলো কম। পাঁচ থেকে ছ’টা। আর দলগুলোর অধিকাংশ খেলোয়াড়ই ছিলো ইংরেজ। দলে খেলোয়াড় হিসেবে নাম থাকলেও হিন্দু ও মুসলমানেরা মূলত ইংরেজ ফুটবলারদের সাজ-সরঞ্জাম বহন করতো।’ পুরনো ঢাকার বাসিন্দা লোকমানের ভাষ্য মতে, ‘যে দল লীগে চ্যাম্পিয়ন হতো তাদের সাত রাত বাঈজীদের সাথে ফুর্তি করার অনুমতি দেয়া হতো।’

আবার ঢাকার ওয়ারী ক্লাবের গোড়ার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, উনিশ শতকের গোড়ার দিকেই ঢাকায় নিয়মিত ফুটবল লীগ অনুষ্ঠিত হতো। কলকাতায় ফুটবল চালু হওয়ার কিছুদিন পরই তা চলে আসে ঢাকায়। তখন একে বলা হতো ‘কলকাত্তাইয়া ফ্যাশন’। ফুটবলে লাথি মেরে বেশ মজা পায় এ অঞ্চলের তরুণরা। তারা এ খেলার প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। ফলে একদিকে যেমন খেলোয়াড় বাড়তে থাকে অপরদিকে বাড়তে থাকে দর্শক। ক্রমেই খেলাটি পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় চালু হয়ে যায়। একের পর এক স্কুল-কলেজগুলোর মাঠ ফুটবলের দখলে চলে যেতে থাকে। গড়ে ওঠে বিভিন্ন দল। শুরু হয় ফ্রেন্ডলি ম্যাচের প্রচলন। এক এলাকার দল আর এক এলাকায় গিয়ে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতো। ঠিক এ সময় ফুটবলের জনপ্রিয়তার কথা বিবেচনা করে একটি নিয়মিত ফুটবল লীগ চালু করতে এগিয়ে আসেন ঢাকার কয়েক বিত্তশালী। সেটা উনিশ শতকের গোড়াতেই। এ সময় ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব ও ওয়ারী ক্লাবই ছিলো প্রধান দু’টো দল। সে আমলে এই ক্লাব দু’টো শুধু ঢাকাতেই নয়, কলকাতাতেও আলোচনার ঝড় তোলে। ঢাকা এবং কলকাতার মাঠে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন দলের বিরুদ্ধে নৈপুণ্যপূর্ণ ফুটবল প্রদর্শন করে দর্শকদের নজর কাড়ে এ দু’টি দল। এদের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে ঢাকার ফুটবলের সুনাম। সে সময় এই ক্লাব দু’টোতে খেলতো একঝাঁক কৃতি ফুটবলার। যাদের নাম ঘুরে বেড়াতো মানুষের মুখে মুখে।

১৯১৫ সালে শক্তিশালী কাস্টমসের বিরুদ্ধে আইএফএ শিল্ডে পর পর দু’দিন ড্র করার পর তৃতীয় দিন পরাজিত হলেও ওয়ারী ক্লাবের ফুটবল নৈপুণ্য কলকাতার মানুষের মুখে মুখে প্রশংসিত হয়। ১৯১৭ সালে এই ওয়ারী ক্লাব সে সময়ের লীগ চ্যাম্পিয়ন ইংরেজ দল লিংকসকে পরাজিত করে চমকে দেয় সকলকে। এর পরের বছরই তারা হারায় কলকাতার অন্যতম শক্তিশালী দল মোহনবাগানকে। সে সময়ে মোহনবাগানকে হারানো খুব সহজ কথা ছিলো না। এ খেলায় ওয়ারীর অধিনায়ক ছিলেন কানু রায়। ১৯২৫ সালে আইএফএ শিল্ডের প্রথম খেলায় ওয়ারী শক্তিশালী শেরউডের সাথে তুমুল লড়াই করার পর দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১-২ গোলে হেরে যায়। ওয়ারীর এ লড়াইয়ের ভূয়সী প্রশংসা করে সে সময়ের ইংলিশ পত্রিকাগুলোও । এরপর ১৯২৯ সালে কলকাতায় সফররত ভুটানের রেঙ্গুন ক্লাবের সাথে খেলাটি ১-১ গোলে অমিমাংসিত থাকলে পরের দিন গড়ায়, তবে পরের দিন বৃষ্টির কারণে ওয়ারীর কপাল পোড়ে। এ খেলায় তারা তিন গোলে হেরে যায়। অর্থাৎ এ সব ঘটনা প্রবাহ থেকেই বোঝা যায়, ১৯৪৭ নয়, ঢাকার লীগ তারও অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ বছর আগে মাঠে গড়িয়েছে।

ঢা কা র ফু ট ব লা র

foota24[1]সে আমলে কেমন ছিলো ঢাকার ফুটবল? কেমন খেলতো ঢাকার ফুটবলাররা? এ সব প্রশ্নের উত্তর কোন্ ফুটবলামোদীরইবা জানতে না ইচ্ছে করে? ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, ঢাকার তারুণ্য ফুটবলে লাথি মারার পর থেকেই উদ্ভাসিত। গোড়া থেকেই মাঠে তাদের নৈপুণ্য ছিলো চোখে পড়ার মতো। ঢাকার ছেলেরা যেখানেই খেলতে গেছে সেখানেই প্রশংসিত হয়েছে তাদের ফুটবল নৈপুণ্য। গড়ে উঠেছে অসংখ্য ভক্ত-সমর্থক। এ প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, কলকাতায় গিয়ে ঢাকার ছেলেরা যখন একের পর এক খেলায় চমকপ্রদ নৈপুণ্য প্রদর্শন করতে থাকে তখন কলকাতায় গড়ে ওঠে ঢাকার ফুটবলের বিশাল প্রেমিক গোষ্ঠী। আর পরে এদেরই উৎসাহ অনুপ্রেরণায় পূর্ববঙ্গের ছেলেদের নিয়ে গঠিত হয় ‘ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব’। ঢাকার ওয়ারী ক্লাব থেকে এ সময় দীনেশ গুহ, ভোলা, ভানু দত্ত রায়, প্রশান্ত, পোদ্দার- প্রমুখ ফুটবলার ইস্ট বেঙ্গলে যোগ দেন।

সে স ম য়ে র ক’ জ ন সে রা

foota24[1]দিন বদলের সাথে ফুটবলে ঢাকার ছেলেদের নৈপুণ্য বাড়তে থাকে আর বাড়তে থাকে তাদের চাহিদা। আজ ইউরোপীয় ক্লাবগুলো যেমন ঝুঁকে পড়েছে আফ্রিকার ফুটবলারদের দিকে, তেমনি দশ এবং বিশের দশকে কলকাতার ক্লাবগুলো ঢাকার ফুটবলারদের দলে ভেড়ানোর জন্য যেনো উন্মুখ হয়ে থাকতো। এবার তেমনি চাহিদা সম্পন্ন ঢাকার ক’জন ফুটবলারের ওপর আলোকপাত করা যাক- তাঁর প্রকৃত নাম ছিলো যতীন্দ্রনাথ রায়। তবে ফুটবল জগতে কানু রায় নামেই পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন ঢাকার ওয়ারী ক্লাবের নিয়মিত খেলোয়াড়। কানু রায় ছিলেন সেকালের সর্বজনস্বীকৃত সেরা রাইট আউট। যদিও তিনি সমান দক্ষতায় লেফটআউট পজিশনেও খেলতে পারতেন। পরে তিনি মোহনবাগানে যোগ দেন।

ঢাকার আর এক খেলোয়াড় রাজেন সেনগুপ্ত। অসামান্য ফুটবল দক্ষতার কারণে তার নাম ছিলো সকলের মুখে মুখে। তাকে অনেকেই ইতিহাস সৃষ্টিকারী ফুটবলারও বলে থাকেন। তিনি হাফ সেন্টার পজিশনে খেলতেন। রাজেন সেনগুপ্ত ওয়ারীতে খেলতেন, পরে যোগ দেন মোহনবাগানে।

ঢাকার আর এক বিখ্যাত খেলোয়াড় হচ্ছেন নগেন কালী। মোহনবাগানের হয়ে খেলে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।

কলকাতার ফুটবলে একসময় বাঘা সোম নামটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। বাঘা সোমের প্রকৃত নাম ছিলো তেজশচন্দ্র সোম। তিনি ইনসাইট পজিশনে খেলা শুরু করলেও পরে হাফসেন্টার পজিশনে খেলে প্রশংসা কুড়ান। এ ছাড়া মেজর জেনারেল এবিএস রায়, সিদ্দিক দেওয়ান, সোনা মিয়া, সাহেব আলী, আলাউদ্দিন, রশিদ, আব্বাস মির্জা, মোনা দত্ত প্রমুখ খেলোয়াড়রা নিজ ফুটবল গুণে আলোচনায় ঠাঁই করে নেন।

ঢা কা র ফু ট ব ল

foota24[1]সেকালের ফুটবলের সোনালী তারকা শেখ মোহাম্মদ সাহেব আলীর নাম কারো অজানা নয়। পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর এক স্মৃতিচারণে পাওয়া যায়- ১৯৩১ সালের দিকে ঢাকায় খেলার জন্য নির্দিষ্ট ছিলো পল্টন ময়দান। বর্তমান ঢাকা স্টেডিয়ামের উত্তর গেটের স্থানে ছিলো পুলিশের চানমায়ী পাহাড় এবং পাহাড় লাগোয়া দক্ষিণ দিকে ছিলো জঙ্গল। বর্তমান বঙ্গভবনের স্থানে ছিলো একটা সুদৃশ্য বাগানবাড়ি। এ বাড়িতে বাস করতেন তৎকালীন সামরিক বাহিনীর এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। পল্টন ময়দানে ছিলো ওয়ারী, ভিক্টোরিয়া ও লক্ষীবাজার ক্লাব। ক্লাবের নিজ নিজ মাঠ ছিলো টিন দিয়ে ঘেরা। বর্তমান ভলিবল মাঠটি ছিলো ঈদগাহ ময়দান। অবশ্য এটা মাদ্রাসা ও মুসলিম হাই স্কুলের ছাত্রদের খেলার মাঠ হিশেবেও ব্যবহার হতো। বর্তমান জেনারেল পোস্ট অফিসের স্থানে ছিলো জগন্নাথ কলেজের খেলার মাঠ। এ মাঠে আন্তঃস্কুল ও আন্তঃকলেজ ফুটবল অনুষ্ঠিত হতো।

ডি এস এ গ ঠ ন

foota24[1]দেশের খেলাধুলার সার্বিক উন্নতি ও পৃষ্ঠপোষকতা দানের লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৯৩৩ সালে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এক সভায় মিলিত হন। এ সভায় উপস্থিত ছিলেন খান বাহাদুর খাজা মোহাম্মদ ইসমাইল, জমিদার রায় বাহাদুর, পি গুপ্ত, কেশব চন্দ্র ব্যানার্জি, জমিদার সুরেশ চন্দ্র ধাম, বারোদার জমিদার পুত্র নৃপেন্দ্র রায় চৌধুরী, খাজা মোহাম্মদ আদেল, এনপি গুপ্ত, খাজা মোহাম্মদ আজমল, এপি গুপ্ত প্রমুখ। সভায় উপস্থিত সকলে একমত হয়ে গঠন করেন ‘ ঢাকা স্পোর্টিং এসোসিয়েশন’ অর্থাৎ ‘ডিএসএ’। ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারকে সভাপতি ও পি গুপ্তকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় ডিএসএ’র প্রথম কার্যকরী কমিটি।

ঢাকার ফুটবলের উন্নয়নে ডিএসএ’র প্রচেষ্টা ছিলো লক্ষ্যণীয়। প্রাথমিক দিকে এসোসিয়েশনের কোনো মাঠ কিংবা অফিস ছিলো না। ওয়ারী ক্লাবের একটি কক্ষ তারা অফিস হিসেবে ব্যাবহার করতো। তাদের আয়োজনে ফুটবল লীগ ও নকআউট টুর্নামেন্টগুলো অনুষ্ঠিত হতো লক্ষীবাজার, ভিক্টোরিয়া, ওয়ারী ও জগন্নাথ কলেজ মাঠে। সে সময় বাঁশের বেড়া দ্বারা ঘিরে টিকিট দিয়ে খেলা অনুষ্ঠিত হতো। ১৯৩৬ সালে তৈরী হয় টিনের চাল, টিনের বেড়া ও কাঠের ফ্লোরের ডিএসএ প্যাভিলিয়ন । আর এ বছর ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বিভাগের দল ইজলিন্টন করিনথিয়ন ঢাকা সফরে এলে এ নতুন মাঠেই খেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম খেলায় সফরকারী দলের বিরুদ্ধে ঢাকা একাদশ ০-১ গোলে জয়লাভ করে। দলের পক্ষে একমাত্র গোলটি করেন পাখি সেন। ইজলিন্টন করিনথিয়নের বিরুদ্ধে ঢাকা একাদশ পরে আরো একটি খেলায অংশগ্রহণ করে। এ সম্পর্কে সাবেক ফুটবলার সাহেব আলী তার এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘খেলা দুটোতে টিকিটের হার ছিলো- মাটিতে এক টাকা, কাঠের গ্যলারী দুই টাকা এবং চেয়ার পাঁচ টাকা। এ দুই খেলায় ২০ হাজার টাকারও বেশী টিকিট বিক্রি হয়। আর এ টিকিট বিক্রির পরিমাণ দেখে বোঝা যায়, সে সময় ঢাকায় ফুটবল কতোটা জনপ্রিয় ছিলো। যখন ঢাকায় লোকসংখ্যা আর বসতি ছিলো কম, তখনই যদি বিশ হাজার টাকার টিকিট বিক্রি হয়ে থাকে তবে খুব সহজেই অনুমেয়, গোড়া থেকে ঢাকাবাসী ফুটবলকে তাদের হৃদয়ে কতোটা ধারণ করতো। অথচ দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, আজ এমনও খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে যেখানে দু’হাজার টাকারও টিকিট বিক্রি হয় না। ডিএসএ’র আয়োজনে সে সময় ঢাকায় কলকাতার ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মুসলিম একাদশ, মোহামেডানের মতো বিখ্যাত ক্লাবগুলো ছাড়াও বিলেতের অনেক দল খেলতে আসতো। আর এসব খেলায় বিপুল দর্শক সমাগম ঘটতো। প্রাক্তন ফুটবলার সাহেব আলী তার আর এক নিবন্ধের এক স্থানে বলেছেন, ‘প্রদর্শনী খেলাগুলোতে একমাত্র কলকাতা মোহামেডানই প্রতিবার বিজয়ী হয়েছে।’ অর্থাৎ অন্যান্য দল ঢাকার দলগুলোর কাছে হেরে যেতো। এ থেকে বোঝা যায়, সে সময় ঢাকার ফুটবলের শক্তিমত্তা। আর ‘ঢাকা একাদশ’ তো ছিলো অধিক শক্তিশালী। সাহেব আলী তার নিবন্ধে আরো লিখেছেন, ‘চল্লিশের দশকে ঢাকায় খেলতে আসা বিদেশী বা ভারতবর্ষের কোনো দলের মধ্যে একমাত্র কলকাতা মোহামেডানই একবার ঢাকা একাদশকে হারাতে পেরেছিলো’। ১৯৩২ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত ঢাকার ফুটবল লীগে যেসব ক্লাব অংশগ্রহণ করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ওয়ারী ক্লাব, ভিক্টোরিয়া এসসি, লক্ষিবাজার ক্লাব, ইস্ট এন্ড ক্লাব, সেন্ট্রাল জেল একাদশ, আরমানী টোলা ক্লাব, রমনা এসি, ঢাকা মুসলিম ওয়ান্ডারার্স (পরে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স), মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, তেজগাঁও ফ্রেন্ডস ইউনিয়ন, ঢাকেশ্বরী কটন মিলস, মনিপুর ফার্ম, বিজিএইচ। এছাড়া জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা কলেজ, সলিমুল্লাহ কলেজ, ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট কলেজ, ঢাকা হল, জগন্নাথ হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, এআরপি (দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সিভিল ডিফেন্স, ফাস্ট এইড ও ফায়ার সার্ভিস কার্যক্রম পরিচালিত প্রতিষ্ঠান) ও ইষ্টার্ণ ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস (গুর্খা রেজিমেন্ট) দলগুলো রোনাল্ড শিল্ডসহ বিভিন্ন নকআউট ফুটবলে অংশগ্রহণ করতো। এ সময় প্রতি বছর লীগের পাশাপাশি রোনাল্ড শিল্ড নকআউট ফুটবল অনুষ্ঠিত হতো। ত্রিশের দশকে ঢাকার জনপ্রিয় দলগুলোর মধ্যে সেরা ছিলো ওয়ারী, ভিক্টোরিয়া ও মনিপুর ফার্ম।

ঢা কা র শি ক্ষা ঙ্গ নে ফু ট ব ল

foota24[1]সে সময় ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাধুলার চর্চা ছিলো বেশ। শিক্ষার পাশাপাশি ক্রীড়াকে গুরুত্ব দিতেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। তারা বেশ বুঝতেন যে, সুস্থ দেহ আর সুন্দর মন না হলে বিদ্যা চর্চা চলে না। আর সুস্থদেহ ও সুন্দর মন গড়ার প্রধান শর্তই হচ্ছে খেলাধুলা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও তাই বলে গেছেন, ‘চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, চাই উজ্জ্বল পরমায়ু।’ আর এজন্য প্রয়োজন খেলাধুলা। আজ ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা নানা ধাঁচের, নানা আকৃতি-প্রকৃতির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢাকা সয়লাব। আর এসব প্রতিষ্ঠানে নানা কায়দায় ছাত্রদের বেটে খাওয়ানো হচ্ছে বিদ্যা। শিক্ষকরা গলদঘর্ম তাদের বুদ্ধি বাড়ানোর প্রক্রিয়ায়। কিন্তু তাতে কি ভবিষ্যতের সুন্দর, সুস্থ জাতির নিশ্চয়তা মিলছে? আজকের এই সব শিক্ষালয়ে ছাত্রদের খেলাধুলার বিষয়টি উপেক্ষিত হলেও অতীতে এমনটি ছিলোনা। খুব বেশী পেছনে নাই বা গেলাম। স্বাধীনতার পরও সত্তরের দশকে স্কুল-কলেজগুলোতে খেলাধুলার যে চিত্র চোখে পড়তো আজ কি তা আছে? ফুটবল ছাড়া ছেলেদের স্কুল-কলেজ তো কল্পনাই করা যেতো না।

ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ফুটবল ছিলো বেশ সরব। লীগ ও নকআউট ফুটবল ছাড়াও নিয়মিতভাবে আন্তঃকলেজ ও আন্তঃহল ফুটবল জমজমাটভাবেই অনুষ্ঠিত হতো। এ সব প্রতিযোগিতায় স্বাগতিক ঢাকা জেলার কলেজ দল ছাড়াও অন্যান্য জেলা অংশ নিতো। ভারতের প্রেসিডেন্সি কলেজ ও রিপন কলেজের ফুটবল দল প্রতি বছরই ঢাকার বিভিন্ন কলেজ দল বা হল দলের সাথে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে আসতো। প্রতি বছর ‘ঢাকা সিটি আন্তঃস্কুল’ ফুটবল অনুষ্ঠিত হতো। দিনে দিনে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার স্কুলগুলোতে ফুটবলের প্রসার ঘটতে থাকে। এর সাথে বাড়তে থাকে প্রতিযোগিতা।

জে লা প র্যা য়ে ফু ট ব ল

foota24[1]সে সময় জেলা পর্যায়েও ফুটবল ছিলো জমজমাট। ময়মনসিংহের ‘সূর্যকান্ত শিল্ড’ রংপুরের ‘গোবিন্দলাল শিল্ড’, দিনাজপুরের নরনারায়ণ রামকানাই কুন্ড শিল্ড’-এর প্রতিযোগিতা ছিলো দেশ-বিদেশে আলোচিত। এসব প্রতিযোগিতায় ঢাকা ছাড়াও কলকাতা প্রথম বিভাগের নামী-দামী দল অংশ নিতো। অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে শিরোপার জন্য হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতো। ঢাকা ও কলকাতার বিখ্যাত অনেক ফুটবলার এসব প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রতিযোগিতার আকর্ষণ বাড়াতেন। স্বীয় নৈপুণ্য প্রদর্শন করে দর্শকদের নয়ন ও মন ভরাতেন, এবং প্রভাবিত করতেন স্থানীয় তারুণ্যকে। এদের সংস্পর্শে রঙিন স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়তো স্থানীয় উঠতি ফুটবলারদের চোখে। জেলা পর্যায়ে অনুষ্ঠিত এসব প্রতিযোগিতার ফলে যেমন বাড়তো দর্শক, তেমন ঘটতো ফুটবলের প্রসার।

আ ন্তঃ প্রা দে শি ক ফু ট ব লে ঢা কা

foota24[1]১৯৪০ সালের ১৫ এপ্রিল দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ফুটবল এসোসিয়েশনের চতুর্থ সাধারণ বার্ষিক সভায় ঢাকা স্পোর্টিং এসেসিয়েশনের সভাপতি পঙ্কজ গুপ্ত আন্তঃপ্রাদেশিক ফুটবল চালু করার প্রস্তাব দিলে তা অনুমোদিত হয় এবং মান বিবেচনা করে ঢাকাকে আন্তঃপ্রাদেশিক ফুটবল খেলার ব্যাপারে প্রভিনশিয়াল মর্যাদা দেয়া হয়। কিন্তু সে বছর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে ঢাকা ডিএসএ সে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেনি। ১৯৪৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় আন্তঃপ্রাদেশিক ফুটবল। এ প্রতিযোগিতায় ডিএসএ পশ্চিমবঙ্গ একাদশের কাছে ০-২ গোলে পরাজিত হয়। ডিএসএ’র পক্ষে খেলেন- কমলেন্দু সেন, চিনু ঘোষ, সাহেব আলী, সুবোধ মিত্র, রতিশ তালুকদার, যোগেস রায়, অনিল ধর, খোকা ধর, অনিল ররুদ্র, সার্জেন্ট ডিমেলো ও সার্জেন্ট জোন্স। এছাড়া ১৯৪৫ সালে বোম্বে কুপারেজ স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় ফুটবলে ডিএসএ দল ১-৩ গোলে বোম্বে প্রদেশের কাছে পরাজিত হয়। এ খেলায় নিয়মভঙ্গ করে চারজন বৃটিশ খেলোয়াড় বোম্বের পক্ষে খেলেন। বৃটিশ শাসনামলে এদেশের শিক্ষা, ব্যবসা, বাণিজ্য প্রায় সব ক্ষেত্রেই ছিলো হিন্দুদের আধিপত্য। মুসলিম সমাজ ছিলো অবহেলিত ও উপক্ষেতি। ১৯৪৩ সালে ঢাকায় এবং ১৯৪৫ সালে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক ফুটবল প্রতিযোগিতায় ডিএসএ’র পক্ষে একমাত্র মুসলিম খেলোয়াড় হিসেবে খেলার সুযোগ পান সাহেব আলী।

যা দু ক র সা মা দ

foota24[1]ভারতীয় উপমহাদেশে ফুটবলের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অধ্যায়টি যিনি রচনা করেছেন তিনি হচ্ছেন যাদুকর সামাদ। দেশ-বিদেশে কেনা শুনেছে তার নাম? এক সামাদ তাঁর ফুটবল নৈপুণ্য দিয়ে বিশ্বের দরবারে ভারতবাসীকে যেভাবে তুলে ধরেছিলেন তা এক অনন্য ইতিহাস। ফুটবল যেনো তাঁর কথা শুনতো, ফুটবলের সাথে তাঁর সম্পর্কটা ছিলো নিখুঁত। আর তাই সামাদের নামের পেছনে জুড়ে আছে ‘ফুটবলের কিংবদন্তীর মহান নায়ক’, ‘ইতিহাস সৃষ্টিকারী ফুটবলার’ ইত্যাদি নানা বিশেষণ। সময়টা ত্রিশের দশক। বাঙালী জাতি তখন শিক্ষা-সংস্কৃতি, সাহিত্য ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হারানো অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সোচ্চার। এ সময় ভারতীয় ক্রীড়াঙ্গনে যে সকল ক্রীড়াবিদ দেশে-বিদেশে নিজস্ব নৈপুণ্য প্রদর্শন করে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন এবং দেশ ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করেছেন এক কথায় সামাদ তাদের মধ্যে প্রধান। সামাদ তাঁর খেলোয়াড়ী জীবনে ফুটবলের সবুজ চত্বরে নিজের অসাধারণ নৈপুণ্যের অপরূপ কারুকাজে এমন সব ঘটনার জন্ম দিয়েছিলেন, যা ফুটবল ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। আর তার এই ব্যতিক্রমধর্মী অসাধারণ যাদুকরী ফুটবল নৈপুণ্যের কারণে তিনি ভূষিত হয়েছিলেন ‘ফুটবল যাদুকর’ উপাধিতে।

প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, মাত্র ১২ বছর বয়সে সামাদ শুরু করেন তাঁর বিস্ময়কর ফুটবল জীবন। ১৯১২ সালে প্রথম কলকাতা মেইন টাউন ক্লাবের পক্ষে খেলেন। ১৯১৮ সালে এরিয়েন্স ক্লাবের সদস্য হন। ১৯১৯ সালে তাজহাট ক্লাবের পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯২১ সাল থেকে ’৩১ সাল পর্যন্ত খেলেন ইবিআর দলে। ভারতের জাতীয় দলের হয়ে তিনি ইন্দোনেশিয়ার জাভায় খেলতে যান ১৯২৪ সালে। উল্লেখ্য, এটাই ছিলো ভারতীয় দলের প্রথম বিদেশ সফর। এরপর তিনি পুনরায় জাভায় যান ১৯২৬ সালে। একই বছর সামাদের নৈপুণ্যের ওপর ভর করে কলকাতা মোহামেডান জয় করে ‘ডুরান্ড কাপ’। সামাদ ১৯৩২ সালে অল ইন্ডিয়া দলের হয়ে খেলতে যান শ্রীলঙ্কায়। ১৯৩৩ সালে যোগ দেন কলকাতা মোহামেডানে। ঐ বছরই উন্নত মানের খেলা উপহার দেয়ার জন্য তাঁকে ‘হিরো অব দ্য গেমস’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। পরবর্তী বছরগুলো ছিলো মোহামেডানের স্বর্ণযুগ। আর মোহামেডানের এই স্বর্ণযুগের রচয়িতা ছিলেন সামাদ। সামাদের অসাধারণ যাদুকরী নৈপুণ্যের কারণেই মোহামেডান পর পর পাঁচবার আইএফএ শিল্ড জয় ও লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের পর সামাদ স্বপরিবারে এ দেশে চলে আসেন এবং পার্বতীপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। চাকুরী পান রেল জংশনে প্লাটফরম ইন্সপেক্টর হিসেবে। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত এ চাকুরী করে অবসর নেন। এবং এর ৭ বছর পর ১৯৬৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

 সামাদ যে কতো বড় ফুটবল যাদুকর ছিলেন, তা গোটা তিনেক ঘটনা থেকেই সহজে অনুমেয়। সামাদের মেয়ে জামিলা খাতুনের মুখে শোনা যায় তার পিতার এসব ফুটবল কেরামতির কথা –

১. একবার তিনি এক মাঠে খেলতে গিয়ে মাঠের চারিদিকে ঘুরে ফিরে পায়চারী করে বললেন, মাঠটি আন্তর্জাতিক মাপের চাইতে ছোট আছে। সুতরাং তিনি এ মাঠে খেলবেন না। পরে মাঠ মাপার পর তার বক্তব্য সত্য বলে প্রমাণিত হয়।

২. ইন্দোনেশিয়ার জাভায় দ্বিতীয়বার খেলতে গিয়ে খেলা চলাকালে তিনি গোলবারে একটি শট নিলেন। বল বারে লেগে চলে গেলো মাঠের বাইরে। সামাদ চ্যালেঞ্জ করে বললেন, ‘নিশ্চয় গোলপোস্ট ছোট আছে। আমার শট মানেই নিখুঁত মাপা শট। তা মিস হবার কথা নয়।’ পরে গোলবার মেপে দেখা গেলো, সমাদ ঠিকই বলেছেন, গোলবারটি নির্ধারিত মাপের চাইতে ছোট। এমন চ্যালেঞ্জ কি আজকের দিনেও কোনো খেলোয়াড়ের পক্ষে রাখা সম্ভব?

৩. দায়ভাঙ্গার রানী তো সামাদের নাম শুনে শুনে অস্থির। একবার তিনি রাজাকে বললেন, ‘আমার বড্ড ইচ্ছে করছে সামাদের খেলা দেখতে।’ রাজার নিজেরও যে ইচ্ছে ছিলো না তা নয়। রাজা বিহারের সব নামী-দামী ফুটবলারদের একত্রিত করে ‘বিহার একাদশ’ গঠন করলেন এবং এই দলের বিরুদ্ধে খেলার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন সামাদের দল কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবকে। সামাদ তখন মোহামেডানে খেলতেন। রাজা ও রানীর সঙ্গে হাজার হাজার দর্শক উদগ্রীব হয়ে আছে সামাদের খেলা দেখার জন্য। শুরু হলো খেলা। তুমুল উত্তেজনা। দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বীতা। অথচ সামাদ তখন পর্যন্ত মোটেও খেলছেন না। মাঝে মাঝে মাঠে দাঁড়িয়ে গোঁফে তা দিচ্ছেন। যার খেলা দেখার জন্য এতো আয়োজন, এই কি না তার খেলার নমুনা! রানী বিরক্ত হয়ে মোহামেডানের কর্মকর্তা নুরুদ্দিনকে ডেকে বললেন- ‘এই বুঝি তোমাদের সামাদ, যে কিনা একজন সাধারণ খেলোয়াড়ের চাইতেও খারাপ খেলছে!’ বিরতির সময় কথাটা সামাদের কানে গেলো। তিনি রানীর সামনে উপস্থিত হয়ে বললেন- ‘মহারানী ছাহেবা, আপ কেতনে গোল চাহতি হ্যায়?’ উত্তরে রানী বললেন- ‘তিনটি’। সামাদ বললেন- ‘ঠিক হ্যায়।’ বিরতির পর খেলা আবার শুরু হলো। সামাদ মুচকি হেসে মাঠে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ গোঁফে তা দিলেন। এর কিছু পরই তিনি শুরু করলেন তার পায়ে-বলে আগুন ঝরানো খেলা। আর অতি অল্প সময়ে বিস্ময়কর দক্ষতায় পর পর তিনটি গোল করলেন। খেলা শেষে আবেগাপ্লুত রানী নিজের গলার মূল্যবান হার খুলে সামাদের গলায় পরিয়ে দিলেন। উপমহাদেশের এই ফুটবল যাদুকরের ফুটবল জীবন মানেই আমাদের ফুটবলের সোনালী অধ্যায়। সামাদ আমাদের গর্ব, অহঙ্কার। তবে ভারতবর্ষের দুর্ভাগ্য যে, এর পর থেকে আজও এখানে সামাদের মতো আর কোনো বিস্ময়কর ফুটবল প্রতিভার জন্ম হয়নি। আর সামাদের দুর্ভাগ্য যে, কখনোই তার প্রকৃত মূল্যায়ন হয়নি।

দে শ  ভা গে র  প র

foota24[1]১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তের পর ঢাকার ক্রীড়াঙ্গনে একটা বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন ক্লাবের হিন্দু পৃষ্টপোষক ও সংগঠকরা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেলে একটা স্থবিরতা যেনো জেঁকে বসে ঢাকার ফুটবলেও। কিন্তু এ সময়টা খুব বেশী দিন স্থায়ী হয় না। ’৪৭-এ দেশ ভাগের পর পূর্বে বাংলা এবং পশ্চিমে পাঞ্জাব-সিন্ধু-বেলুচিস্থান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত নিয়ে সূচিত হয় নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান। মূলত ধর্মের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারিত হয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন এবং পরবর্তীতে রাজনৈতিক অস্থিরতা যে এদেশের খেলাধুলার ওপর প্রভাব ফেলেনি তা নয়, কিন্তু তারপরও ক্রীড়াক্ষেত্রের গতি ছিলো সচল। তবে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) মানুষ বেশ উপলব্ধি করলো, এই দেশ বিভাগে আসলে তাদের লাভ কিছুই হয়নি, শুধু প্রভুর পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। ইংরেজদের আসনে বসেছে করাচি-লাহোরের অবাঙ্গালী প্রভু। আর এই অবাঙ্গালী প্রভুরা ক্রীড়াক্ষেত্রেও তাদের প্রভুত্ব বিস্তারে ছিলো সোচ্চার। ফলে পাক আমলে এদেশের ক্রীড়াবিদরা বিভিন্ন সময়ে বৈষম্যের শিকার হয়েছে। বঞ্চিত হয়েছে নানা সুযোগ থেকে। জাতীয় দল গঠনে থেকেছে উপেক্ষিত। তারপরও এদেশের ফুটবল থেমে থাকেনি। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের বছরও ঢাকায় ফুটবল লীগ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বছর বিজি প্রেস লীগ চ্যাম্পিয়ন এবং ওয়ান্ডারার্স রানার্সআপ হয়। তবে বরেণ্য প্রবীন ক্রীড়া সাংবাদিক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান তার এক নিবন্ধে লিখেছেন- ‘পঞ্চাশের দশকে ফুটবলে প্রান ছিলো না। আর এই প্রানহীন, গতিহীন ফুটবলে সে সময়ের কিছু ফুটবলার প্রান ও গতি ফিরিয়ে এনেছিলেন।’ কামরুজ্জামান যাদের মধ্যে দাউদকান্দির ছেলে আশরাফ চৌধুরীকে অন্যতম বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, পঞ্চাশের দশকে ইপিআর-এর শওকত, ক্যাপ্টেন নেওয়াজ, বিজি প্রেসের ছুন্না রশিদ, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের আনোয়ার, মান্না, ওয়ান্ডারার্সের বলাই, বাহারাম, মহারাজ, সেন্ট্রাল স্টেশনারীর চার্লস, জামাল, ওয়ারীর আউয়াল প্রমুখ খেলোয়াড়রদের নৈপুণ্য সে সময়ের দর্শকদের নজর কাড়ে। এ সময়টাতে আরো যারা নিজেদের ফুটবল নৈপুন্য দিয়ে এদেশের ফুটবলকে আলোকিত করেছিলেন, তাদের মধ্যে মিয়াজী, মোমতাজ, রঞ্জিত, নবী চৌধুরী, ভাওয়াল ওয়াজেদ, সাদেক, মঞ্জুর হাসান মিন্টু, কামরুজ্জামান, সিতাংশু প্রমূখের নাম উল্লেখযোগ্য। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আরো যে সব খেলোয়াড় স্বীয় নৈপুণ্য দ্বারা ফুটবলকে আলোকিত করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন, গজনবী, আরজু, কবির, আশ্রাফ, শাহ আলম, আমান, পি ঘোষ, সামাদ, হুমায়ুন, নাসির, তফাজ্জল, কানু, মারি, খায়ের, নজরুল, মদন, দেবাশীষ, আবেদ, কালা গফুর, রাহি, সিদ্দিক, আম্বিয়া, হাশেম দীন, কাদিও, কাইয়ুম, চেঙ্গেজি প্রমূখ।

মো হা মে ডা নে র  উ ত্থা ন

foota24[1]পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ঢাকার ফুটবলে ওয়ান্ডারার্সের একচেটিয়া আধিপত্য ছিলো। তখন ওয়ান্ডারার্স যে কতোটা অপ্রতিরোধ্য ছিলো, সেটা সে সময় লীগে তাদের পারফরমেন্সের ওপর চোখ রাখলেই পরিস্কার হয়ে যায়। ১৯৪৮ থেকে ’৫৬- এই নয় বছরের মধ্যে তারা লীগ শিরোপা জয় করেছে ৫ বার (’৫০,’৫১,’৫৩,’৫৪,’৫৬)। রানার্সআপ হয়েছে ১ বার (’৫২)। বন্যার কারণে ’৫৫ সালে লীগ মাঝ পথে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় মোহামেডানের অপ্রতিরোধ্য উত্থান। এবার তাকানো যাক এই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির জন্মলগ্নের দিকে ঃ ‘বেস্ট অব ক্রীড়ালোক’ পুস্তকে প্রকাশিত মজিবর রহমান লিখিত ‘মোহামেডান ক্লাবের ইতিহাস’ শীর্ষক লেখাটিতে এ সম্পর্কে তথ্য মেলে। কারো কারো মতে, ঢাকা মোহামেডানের জন্ম ১৯৩৮ সালে। তবে অনুসন্ধান করে ১৯৪৭ সালের ক্লাব প্যাডের একটি সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ১৯৩৮ সালে ক্লাবের জন্ম হওয়ার তথ্যটি সঠিক নয়। অপরদিকে দিলকুশার খাজা পরিবারে যে ঢাকা মোহামেডানের কার্যক্রম একসময় সচল ছিলো, তা সহজে অনুমান করা যায়। উল্লেখ্য, খাজা নাজিমউদ্দিন, খাজা নুরুদ্দিন ও বেগম নুরুদ্দিন কলকাতা মোহামেডানের নির্বাহী কমিটিতে ছিলেন। খাজা নুরুদ্দিন এক সময় কলকাতা মোহামেডানের সাধারণ সম্পাদকেরও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৭ সালের ৭ মে দিলকুশা হাউজে খাজা পরিবারের বেশ কয়েকজন ক্রীড়ানুরাগীর উপস্থিতিতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন খাজা আদেল, খাজা ইসমাইল, খাজা আজাদ, খাজা সুলেমান, খাজা আতিকউল্লাহ, খাজা আজমল প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। সভাপতিত্ব করেন হকির গোলরক্ষক খাজা সুলেমান। সভায় খাজা ইসমাইলকে সভাপতি ও খাজা আদেলকে সাধারণ সম্পাদক করে ‘মুসলিম স্পোর্টিং ক্লাব’ নামে একটি ক্লাব গঠন করা হয়। এরপর ঢাকার হাজারীবাগের ২৫ নম্বর মনেশ্বর রোডের কাজী আউয়ালকে ফুটবল দল গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়। কাজী আউয়াল ঢাকার স্কুল, কলেজ ,মাদ্রাসা ঘুরে ঘুরে একটি ফুটবল দল গঠন করেন। মুসলিম স্পোর্টিং এ বছর রোনাল্ড শিল্ডে অংশ নিয়ে দর্শকদের প্রশংসা কুড়ায়। এরপর এই ক্লাবের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পরে। আর এভাবে বেশ ক’টি বছর গত হবার পর নবাব পরিবার আবার ক্লাবটির প্রতি মনোযোগী হয়।

১৯৩৪ সালে খাজা আজমল ও খাজা নিমরুল্লাহসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ক্লাবটির নাম পরিবর্তন করে ‘মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব’ রাখেন। জন্ম লাভের পর প্রায় দুই দশক তেমন চমকপ্রদ কিছু করতে পারেনি মোহামেডান। এর সাফল্যের রথ ছুটতে শুরু করে মূলত ১৯৫৬ সাল থেকে। এ বছরের লীগে তারা সে সময়ের ফুটবলে একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তারকারী ও আগের দু’বছরের লীগ চ্যাম্পিয়ন ওয়ান্ডারার্সের শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে দাঁড়ায়। যদিও সে বছর ওয়ান্ডারার্সের কাছ থেকে তারা শিরোপা ছিনিয়ে নিতে পারেনি, রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। কিন্তু এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৭ সালে ওয়ান্ডারার্সকে পরাভূত করে প্রথমবারের মতো লীগ শিরোপার স্বাদ গ্রহণ করে মোহামেডান। সেই যে সাফল্যের শুরু আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি এই ক্লাবটিকে। আজও সে এগিয়ে চলছে শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কার নিয়ে আপন আলোকমালায় উদ্ভাসিত হয়ে। ষাটের পুরো দশক জুড়েই মোহামেডানের এই আধিপত্য বলতে গেলে অক্ষুন্ন থাকে। এ সময়ে অবশ্য ঢাকার অন্যতম প্রবীণ ক্লাব ভিক্টোরিয়া ও ইপিআইডিসি মোহামেডানের বিরুদ্ধে শক্ত হয়ে বার কয়েক দাঁড়ায় বটে, তবে তা ছিলো সাময়িক।

পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে ঢাকার ফুটবলে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব, বিজি প্রেস, ইপিআইডিসি দলগুলো শক্ত লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতো। ঢাকা লীগের পাশাপাশি স্বাধীনতা দিবস ফুটবল, আগা খান গোল্ড কাপের জমজমাট আসর বসতো। এছাড়া বগুড়ায় মোহাম্মদ আলী কাপ, কুমিল্লায় রকিবউদ্দিন গোল্ড কাপ, গাইবান্ধায় খান বাহাদুর শিল্ড, রংপুরে গোবিন্দলার শিল্ড, ময়মনসিংহের ‘সূর্যকান্ত শিল্ড’, দিনাজপুরের নরনারায়ণ রামকানাই কুন্ড শিল্ড’-এর প্রতিযোগিতাগুলো জমজমাটভাবে অনুষ্ঠিত হতো। চট্রগ্রামের ফুটবলও ছিলো সরগরম।

মু ক্তি যু দ্ধে  ফু ট ব ল

foota24[1]আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলনে ফুটবলের রয়েছে অসামান্য অবদান। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে বসে থাকেননি ফুটবলাররাও। প্রিয় বাংলাদেশকে শত্রমুক্ত করতে তারাও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সুদৃঢ় প্রত্যয়ে যখন দেশের প্রদীপ্ত তরুণেরা হাতে তুলে নিয়েছিলো অস্ত্র, তখন বাংলাদেশের একঝাঁক তরুণ ফুটবলার খেলার মাঠে গড়ে তুলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের আর এক ফ্রন্ট। গঠন করেছিলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। তারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেছেন, সংগ্রহ করেছেন জনমত এবং অর্থ। সে সময় প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ভারতীয় মুদ্রায় তিন লাখ টাকা তুলে দিয়েছিলো তৎকালীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের হাতে। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ভারতের বিভিন্ন স্থানে মোট ১৬টি খেলায় অংশ নেয়। এর মধ্যে ১২টিতে জয়ী, ৩টিতে পরাজিত হয় ও ১টি খেলা ড্র করে। ১৯৭১ সালের ২৪ জুলাই স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ভারতে তাদের প্রথম ম্যাচটি খেলে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর কালেক্টরেট মাঠে কৃষ্ণনগর একাদশের বিরুদ্ধে। ঐ ম্যাচের পূর্বে স্বাধীন বাংলার ফুটবল সৈনিকরা প্রথম বিদেশের মাঠে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলো এবং জাতীয় সঙ্গিত বাজিয়েছিলো।। এ সময় অবশ্য একটা জটিলতার সৃষ্টি হযেছিলো, যেহেতু ভারত সরকার তখন পর্যন্ত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি সেহেতু নদীয়া জেলা প্রশাসন জোর আপত্তি তুললো স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর ব্যাপারে। এদিকে বেঁকে বসলো স্বাধীন বাংলা একাদশ, তাদেও কথা একটাই- ’পতাকা উত্তোলন না করা হলে এবং জাতীয় সঙ্গীত না বাজানো হলে আমরা মাঠে নামবো না।’ পরে মুক্তিকামী খেলোয়াড়দের কাছে নতি স্বীকার করে নদীয়া জেলা প্রশাসন। ভারতের জাতীয় পতাকার পাশে যখন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হয় তখন বাজানো হয় দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত। খেলাটি ২-২ গোলে অমীমাংসিত থাকে। এরপর স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ৮ আগস্ট মোহনবাগান মাঠে গোস্টপাল একাদশের বিরুদ্ধে খেলে। উল্লেখ্য, গোস্টপাল একাদশ ছিলো মূলত মোহনবাগানের সেরা একাদশের ধারণকৃত নাম। এ খেলায় তারা ২-৪ গোলে গোস্টপাল একাদশের কাছে পরাজিত হয়। ১৪ আগস্ট কলকাতার রবীন্দ্র সরোবর মাঠে দক্ষিণ কলকাতা স্পোর্টস ফেডারেশনের বিরুদ্ধে তারা ৪-২ গোলে জয়ী হয় সফরকারী দল। পশ্চিমবঙ্গের রামকৃষ্ণ মিশনে নরেন্দ্রপুর একাদশের বিরুদ্ধে ৪র্থ ম্যাচ খেলে স্বাধীন বাংলা ফুটবল একাদশ। এ খেলায় তারা জয়ী হয় ২-০ গোলে। এর ক’দিন পর দলটি বর্ধমান একাদশের বিরুদ্ধে মাঠে নামে। পরবর্তীতে বানারস, বিহার প্রদেশের সিওয়ান, ফখরপুর, দুর্গাপুর, বানপুর, চিত্তরঞ্জন, মালদহ, বালুরঘাট, বোম্বে প্রভৃতি স্থানে প্রদর্শনী ম্যাচে অংশ নেয়। তবে এর মধ্যে বোম্বের খেলাটি ছিলো সবচাইতে আকর্ষণীয় ও জমজমাট। এখানে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল মহারাষ্ট্র একাদশের বিরুদ্ধে খেলতে নামে। এ খেলায় মহারাষ্ট্র একাদশের অধিনায়ক ছিলেন ভারতের এককালের তুখোড় ক্রিকেটার পতৌদির নবাব মনসুর আলী। আর বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ফুটবলারদের উৎসাহিত করতে এদিন মাঠে উপস্থিত ছিলেন বোম্বের পর্দা কাঁপানো অভিনেতা-অভিনেত্রী দিলীপ কুমার, শর্মিলা ঠাকুর, রাজেশ খান্না, মোমতাজ, বিশ্বজিৎ প্রমুখ। খেলায় স্বাধীন বাংলা একাদশ ৩-২ গোলে মহারাষ্ট্র একাদশকে পরাজিত করে। ভারত সফরকালে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলটি প্রতিটি ম্যাচের পূর্বে প্রিয় জন্মভূমির পতাকা হাতে মাঠ প্রদক্ষিণ করে। এ সময় ভারতের যেখনেই খেলতে গেছে সেখানেই এই মুক্তিকামী ফুটবলাররা পেয়েছে বিপুল সংবর্ধনা আর উচ্ছ্বাসভরা উৎসাহ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ফুটবলারদের এ ভূমিকা চিরদিন অম্লাণ হয়ে থাকবে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে মুক্তিযোদ্ধা ফুটবলারদেরও। এবার এক নজরে তাকানো যাক এ দলের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তার তালিকাটির দিকে- ১ম সভাপতি- শামসুল হক (তৎকালীন মন্ত্রী), ২য় সভাপতি-আশরাফ আলী চৌধুরী, তৃতীয় সভাপতি- এন এ চৌধুরী (কালু ভাই)। ম্যানেজার- তানভির মাজহারুল ইসলাম তান্না, কোচ- ননী বসাক, অধিনায়ক- জাকারিয়া পিন্টু, সহঃঅধিনায়ক- প্রতাপ শংকর হাজরা, খেলোয়াড়- মোঃ নুরুন্নবী, আইনুল হক, শাজাহান আলম, আলী ইমাম, লালু, মোঃ কায়কোবাদ, সুভাষ চন্দ্র সাহা, অমলেস সেন, শেখ আশরাফ আলী, এনায়েতুর রহমান, সাইদুর রহমান প্যাটেল, বিমল কর, তসলিম, অনিরুদ্ধ, মোমিন, খোকন, কাজী সালাহউদ্দিন, নওসুরুজ্জামান, সুরুজ, আব্দুল হাকিম, শিহাব, লুৎফর রহমান, গোবিন্দ কুন্ড, সঞ্জিত, মহিবুর রহমান, সাত্তার, পেয়ারা, মাহমুদ ও মোজাম্মেল।

স্বা ধী ন তা র প র ফু ট ব ল

foota24[1]স্বাধীনতার সোনালী আলোকমালায় উদ্ভাসিত হয়ে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো ফুটবলও নতুন পরিচয়ে, নব উদ্দমে যাত্রা শুরু করে। এরপর থেকেই ফুটবল ধাবিত হতে থাকে এক স্বর্ণালী অধ্যায় রচনার লক্ষ্যে। সত্তর এবং আশির দশকের সেই জমজমাট ফুটবল এখন যেনো শুধুই স্মৃতি। যারা সে সময় ফুটবলের সেই মেজাজ, সেই রূপ প্রত্যক্ষ করেছেন- সেদিনের সেই বর্ণাঢ্য স্মৃতি মনে করে তারা আজ বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে থাকেন। এ সময়ে ঢাকার দলগুলো যেমন যৌবন জোয়ারে ফুলে ফেঁপে উঠেছিলো তেমনি ঢাকার মাঠও ছিলো উচ্চ মানসম্পন্ন খেলোয়াড়দের দখলে। আর এসব খেলোয়াড়ের নাম ছড়িয়ে ছিলো নগর-জনপদে মানুষের মুখে মুখে। এদের খেলা দেখার জন্য স্টেডিয়ামে দর্শকদের ঢল নামতো।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ঢাকার লীগ মাঠে গড়ালেও মাঝ পথে তা বন্ধ হয়ে যায়। ‘৭৩ সালে প্রথম সুসম্পন্ন লীগে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম লীগ চ্যাম্পিয়নের স্বাদ গ্রহণ করে বিআইডিসি এবং যৌথভাবে রানার্সআপ হয় মোহামেডান, আবাহনী ও ওয়ান্ডারার্স। ১৯৭২ সালে এ দেশের ফুটবলে আবাহনী ক্রীড়া চক্র নামের এক নতুন শক্তির আবির্ভাব ঘটে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামাল একঝাঁক প্রদীপ্ত ক্রীড়ানুরাগী যুবককে নিয়ে এ ক্লাবটি গড়ে তোলেন। আপন শক্তিমত্তার পরিচয় দিযে খুব অল্প সময়ে এ ক্লাব উঠে আসে সাফল্যের শিখরে। পরিণত হয় একটি সেরা সংগঠনে। শুধু তাই নয়, আবাহনী ক্রীড়াচক্রকে বলা হয় এদেশে আধুনিক ফুটবলের প্রবর্তক। ক্লাবটি আনুষ্ঠানিকতার প্রবর্তন করে দেশীয় ফুটবলে এক নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করে। জন্মলাভের পর থেকেই এ ক্লাবটি দোর্দন্ড দাপটে এগুতে থাকে সমুখের পানে, যা আজো অব্যাহত আছে। লীগে তাদের সাফল্য দেখলে মনে হয়, তারা যেনো লীগ শিরোপার দাবীদার হয়েই জন্মলাভ করেছে। ’৭২-এ জন্ম নিয়ে ’৭৩-এ রানার্সআপ এবং‘৭৪-এ চ্যাম্পিয়ন! সত্তুর-আশির দশকে মোহামেডান ও আবাহনীর দ্বিমুখী দাপটের পাশাপাশি ওয়ান্ডারার্স, দিলকুশা, বিজেএমসি, রহমতগঞ্জ, ব্রাদার্স দলগুলোর শক্তিমত্তাও ছিলো চোখে পড়ার মতো। তবে ’৭৫ সালে প্রথম বিভাগে ব্রাদার্স ইউনিয়নের আবির্ভাবের পর ঢাকার ফুটবল ত্রিমুখী লড়াইয়ের আবর্তে পতিত হয়। ব্রাদার্স এদেশের অন্যতম একটি পুরনো ক্লাব হলেও এর প্রচার এবং প্রসার ঘটে মূলত ৭৫-এর পরে। ১৯৪৯ সালে ঢাকার গোপীবাগ এলাকায় ক্রীড়ানুরাগী রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, হেলালউদ্দিন, মিজানুর রহমান, লতিফ মোল্লা প্রমূখ স্বনামধ্য ব্যাক্তিবর্গের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় এই ক্লাবটি। এরপর দীর্ঘসময় ক্লাবটির কোনো কার্যক্রম ছিলো না বললেই চলে। ’৭৩ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ছিলো তৃতীয় বিভাগের একটি দল। ঐ বছর তৃতীয় বিভাগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে এবং পরের বছর দ্বিতীয় বিভাগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ’৭৫-এ প্রথম বিভাগ ফুটবলে পা রাখে। এবং এরপর থেকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলে দিনবদলের সাথে সাথে তৃতীয় শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। ’৭২ থেকে নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত লীগের গতি ছিলো বিরতিহীন। সে সময় প্রতি বছর লীগের আয়োজন মানেই ছিলো যেনো জমজমাট ফুটবল উৎসব। আর এই উৎসবকে কেন্দ্র করে শুধু ঢাকা নয়, গোটা দেশে বয়ে যেতো ফুটবলের জোয়ার। লীগের বড় ম্যাচগুলো দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন জনপদ থেকে ভক্ত-সমর্থকরা ছুটে আসতো ঢাকায়। তারা গ্যালারীতে সমবেত হয়ে নিজ দল ও খেলোয়াড়দের জোগাতো উৎসাহ। আর আবাহনী, মোহামেডান কিংবা ব্রাদার্সের খেলায় তো এক কথায় স্টেডিয়াম পরিগ্রহ করতো জনসমুদ্রের রূপ। উত্তেজনায় ধনুকের ছিলার মতো টানটান হয়ে থাকতো ফুটবলামোদীরা। ঘরে-বাইরে, হাট-বাজার, রাস্তা-ঘাটে একটি প্রশ্নকে ঘিরে চলতো একই আলোচনা, ‘কে জিতবে আজকের খেলায়?’

দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধারাবিবরণী শোনার জন্য রেডিও সেটের সামনে ভীড় করতো ফুটবলানুরাগীরা। যদি টিভিতে খেলা দেখানো হতো তবে টিভি সেটের সামনে জড়ো হতো দর্শকরা। আর যেদিন আবাহনী-মোহামেডানের লড়াই হতো সেদিন যেনো গোটা দেশের চেহারাই পাল্টে যেতো। অফিস-আদালত, বাস-লঞ্চ-ট্রেন, হোটেল- রেস্তোরা সর্বত্র চলতো একই আলোচনা। প্রিয় দলের জয়-পরাজয়ের প্রশ্নে ভক্ত-সমর্থকরা মেতে উঠতো বিতর্কে। স্টেডিয়াম এলাকা জেগে উঠতো সাজ সাজ রবে। ব্যানার-ফেস্টুনে ভরে ওঠা গ্যালারী ক্ষণে ক্ষণে ফেটে পড়তো ‘গোল’, ‘গোল’ চিৎকারে। এদেশের ফুটবলে মোহামেডানের আধিপত্য বলতে গেলে যখন ছিলো একচ্ছত্র ঠিক তখন মোহামেডানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয় আবাহনী ক্রীড়াচক্র। আবাহনীর আবির্ভাব মূলত দেশীয় ফুটবলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়িয়েছে, বাড়িয়েছে আকর্ষণ আর দর্শক। সংযোজিত হয়েছে একটা তীব্র প্রতিযোগিতার ধারা। বলার অপেক্ষা রাখে না, এতে প্রধান দুটি দল হিসেবে যেমন মোহামেডান-আবাহনীর বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে পাশাপাশি ফুটবলেরও ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হযেছে। ফুটবলে যোগ হযেছে নবতর কলা-কৌশল। এসেছেন বিদেশী প্রশিক্ষক এবং খেলোয়াড়। কলাকৌশলের আধুনিক প্রয়োগ, তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মেজাজ, জয় ছিনিয়ে নেয়ার অদম্য বাসনা- সব মিলিয়ে আবাহনী-মোহামেডানের ফুটবল মানেই ছিলো যেনো জ্বলে ওঠা বারুদ। তখন ছোট দলগুলোও লড়তো সেয়ানের মতো। ছিলো না পাতানো খেলার গন্ধও। সেই দিনগুলোকে আজ মনে হয় স্বপ্ন। ’৭৩ থেকে ’৯০ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১৭টি লীগের মধ্যে মোহামেডান ৭ বার, আবাহনী ৮ বার, বিআইডিসি ১ বার, এবং বিজেএমসি একবার করে শিরোপা জয় করে। এর মধ্যে আবাহনী একবার (’৮৩,’৮৪,’৮৫) এবং মোহামেডান একবার (’৮৬, ’৮৭, ’৮৮-৮৯) হ্যাট্রিক শিরোপার স্বাদ পায়। এ সময়ে একটি ব্যাপার বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, ’৭৫-এ লীগের আঙ্গিনায় পা রাখার পর থেকে প্রতিটি আসরে শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়ে লড়াই করলেও একবারো লীগ শিরোপার স্বাদ পায়নি ব্রাদার্স ইউনিয়ন। তারা তৃতীয় শক্তি হিসেবেই যেনো স্থায়ী আসন করে নিয়েছিলো। তবে এখানে একটি তথ্য দেয়া দরকার। আর তা হচ্ছে, ‘৭৫-এর পর থেকে যে স্বপ্ন লালন করে আসছিলো ব্রাদার্স, দুই যুগেরও বেশী সময় অপেক্ষার পর অবশেষে তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ২০০৩ সালে তারা পেয়েছে প্রথম লীগ শিরোপার স্বাদ। নব্বই দশকের শেষদিকে লীগের দাবীদার হিসেবে উথ্থান ঘটে মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্রের। উল্লেখ্য, এই দলটি ১৯৯৭ সালে প্রথম লীগ শিরোপার স্বাদ পায়। এখানে আরও একটি তথ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন, আর তা হচ্ছে, ’৭২ থেকে ’৭৮ পর্যন্ত লীগ অনুষ্ঠিত হতো বাফুফে’র অধীনে। ’৭৯ সাল থেকে তা অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পায় ডামফা কর্তৃপক্ষ। কোথায় হারিয়ে গেলো সেসব দিন, আর কোথায়ই বা হারিয়ে গেলো সেই ফুটবল? কেনো আজ ফুটবলের করুণ চিত্র? আসলে ফুটবল মূলত দলাদলির বলি হয়েছে। একদিকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অপরদিকে ঢাকা স্টেডিয়াম টু মিরপুর স্টেডিয়াম টানাহ্যাঁচড়া ফুটবলের বারোটা বাজিয়েছে। আর সেই সাথে বারোটা বেজেছে গোটা দেশের ফুটবলেরও। কেননা ঢাকায় ফুটবল অনুষ্ঠিত হলে এর রেশ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। একটা ব্যাপার বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, ঢাকার ফুটবলের অবনতির সাথে সাথে বিভিন্ন জেলাতেও ফুটবলের অবনতি ঘটেছে। এখন জেলা স্টেডিয়ামগুলো সারা বছরই হয় শূন্য থাকে, নয়তো গোচারণভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ে ফুটবল মৃতপ্রায় বলে বিভিন্ন জেলায় লীগ ও অন্য টুর্নামেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সারা দেশেই ফুটবল কফিনবন্দী হয়ে পড়েছে। অপরদিকে ফুটবলারদের মানও পড়ে গেছে। আর মান কমে যাওয়ার ফলে ফুটবলারদের ব্যক্তিগত ইমেজও কমে গেছে। আগে যেমন সালাহউদ্দিন, এনায়েত, চুন্নু, এমিলি, গাফ্ফার, সালাম মুর্শেদী, বাদল রায়, খুরশীদ বাবুল, আসলাম, নান্নু, মঞ্জ, টুটুলদের খেলা দেখার জন্য দর্শকরা মাঠে ছুটে যেতো কিন্তু আজ তেমনভাবে কোনো খেলোয়াড়ই দর্শকদের মাঠে টানতে পারছেন না।

মি র পু রে ফু ট ব ল

foota24[1]১৯৮৭-৮৮ সালে ফুটবলের যখন স্বর্ণযুগ চলছিলো তখনই প্রথম ফুটবলের ওপর আঘাত আসে। ফুটবলকে ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুর স্টেডিয়ামে। যাতায়াত সমস্যা, নিরাপত্তার প্রশ্ন, বাড়তি খরচের বোঝা ইত্যাদি নানা কারণে দর্শকরা মিরপুর পর্যন্ত যেতে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে। এতে ফুটবলের দর্শক সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যেতে থাকে। আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয় এই জনপ্রিয় খেলাটি। ব্যাপারটি অনুধাবন করতে পেরে কর্তৃপক্ষ আবার ফুটবলকে ফিরিয়ে আনে ঢাকা স্টেডিয়ামে। আবার ফুটবলের আঙিনা আলোয় ঝলমল করে ওঠে। এরপর ’৯৫ পর্যন্ত ফুটবল ঢাকা স্টেডিয়ামেই ছিলো। এই সময়কালেও ফুটবলের রঙ ছিলো, দর্শকদের আকর্ষণ ছিলো। দর্শকরা ফুটবলের টানে ছুটে আসতো ঢাকা স্টেডিয়ামে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৯৩ সালে লীগে মোট টিকিট বিক্রি হয়েছিলো ১ কোটি ২৬ লাখ ৬০ হাজার ৮শ’ টাকার। এর মধ্যে মোহামেডান-আবাহনীর মধ্যকার লীগের শেষ ম্যাচটিতে টিকিট বিক্রির পরিমান ছিলো ৪ লাখ ৬০ হাজার ৮শ’ টাকা। আর মিরপুর স্টেডিয়ামে ফুটবলকে নির্বাসিত করার পর পনের ভাগের একভাগও টিকিট বিক্রি নেই। কোনো কোনো ম্যাচে দর্শক খরা দেখলে তো কষ্ট লাগে। শূন্য গ্যালারী দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, এই কি আমাদের সেই ফুটবল? আবার অন্যদিকে স্পন্সররাও মিরপুরে যেতে চায় না। অথচ ঢাকা স্টেডিয়ামে বড় অঙ্কের স্পন্সর পেতে কোনো সমস্যাই হতো না। লীগের পর ১৯৮০ সালে শুরু হওয়া ফেডারেশন কাপকে ঘিরে আর এক উত্তেজনায় মেতে উঠতো ফুটবলামোদীরা। আজ সে আসরেরও নেই উত্তাপ-উত্তেজনা। যদিও বর্তমানে স্থায়ীভাবে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ফুটবলকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে তবে সেই রূপ আর মেজাজ এখন আর প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে না। দর্শকও সেভাবে আর মাঠে আসছে না। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এখন আবাহনী-মোহামেডানের খেলাতেও গ্যালারী থাকে দর্শকশূন্য।

ফু ট ব লে র কাঁ ধে ক্রি কে টে র ভূ ত

foota24[1]একথা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করে থাকেন যে, দিনে দিনে ক্রিকেটের ভূত এমনভাবে ফুটবলের ওপর চেপে বসেছে- যা ফুটবলের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে চলেছে। বিশেষ করে ক্রিকেটের কারণেই ফুটবল ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে বিতাড়িত হয়েছিলো। আবারো হবার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। ফুটবলের মিরপুরে নির্বাসন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সোনালী অতীতের ফুটবলার বাদল রায় ‘৯৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসর পর ক্রিকেটের উন্নয়নের জন্য ক্রীড়ামন্ত্রীর বিশেষ অনুরোধে আমরা প্রথম বছর অর্থাৎ ’৯৬ সালে লীগ মিরপুরে অনুষ্ঠিত করি। কিন্তু তাতে আমরা দারুণভাবে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হই। খেলোয়াড়দের গুণগত মান, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নিরাপত্তার কারণে ফুটবল মিরপুরে দর্শক টানতে ব্যর্থ হয়।’ ১৯৯৭ সালে জাতীয় ক্রিকেট দল আইসিসি ট্রফি জয় করলে সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা অনেকটা ধাক্কা মেরে ফুটবলকে খাঁদে ফেলে দেন। এরপর ক্রিকেটের ওয়ানডে ও টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তিতে আবেগপ্রবণ কর্মকর্তাদের ক্রিকেটের প্রতি আবেগ আরো বেড়ে গেলো। সরকার বদলালেও ফুটবলের ভাগ্য বদলালো না। অনেক ক্ষেত্রে ফুটবল বিমাতাসুলভ আচরণের শিকার হতে থাকে। দিনে দিনে নদীর পানি গড়িয়েছে অনেক, এরই মাঝে ফুটবল আবার ফিরে এসেছে তার পুরনো ঠিকানায়, তবে আসল বাস্তবতা হচ্ছে, ফুটবল আজও পারছেনা কাঁধ থেকে ক্রিকেটের ভূতটাকে নামিয়ে ফেলতে। তবে সচেতন মহলের এক কথা, ক্রিকেট নিয়ে যতোই মাতামাতি করা হোক না কেনো, ৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে যেমন বাংলাদেশ বাঁচবে, তেমনি ফুটবল বাঁচলেই এদেশের সকল খেলাধুলা বাঁচবে।

আ ন্ত র্জা তি ক  ম য় দা নে  আ মা দে র   ফু ট ব ল

foota24[1]সত্তর-আশির দশকে ঢাকার ফুটবল সবসময়ই সরগরম থাকতো। আগা খান গোল্ড কাপকে ঘিরে বসতো জমজমাট আন্তর্জাতিক ফুটবল। প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপের আন্তর্জাতিক ফুটবল উৎসবে মেতে উঠতো ফুটবলামোদীরা। উল্লেখ্য, ঢাকায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপের শিরোপা জয় করেছিলো বাংলাদেশ আর সেটাই আন্তর্জাতিক ফুটবলে আমাদের অর্জিত প্রথম ট্রফি। আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের অবস্থান মোটেও ভালো নয়। আগের সাতটি আসরে নাকানি-চুবানি খেয়ে, বছরের পর বছর অপেক্ষা করে ১৯৯৯ সালে কাঠমন্ডুতে অনুষ্ঠিত অষ্টম সাফ গেমস ফুটবলে সোনা পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে ঐ একবারই। এরপর আর নয়। প্রতি আসরে আমরা আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করেছি, সাফ গেমসের সব চাইতে আকর্ষনীয় এবং মর্যাদাপূর্ণ ইভেন্টটিতে নিশ্চয় আমাদের ফুটবলাররা অতীতের ব্যর্থতাকে ঢেকে দিয়ে ছিনিয়ে আনবে সোনার পদক। কিন্তু মাঠে আমাদের সে স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়েছে। তবে ২০০৩ সালের জানুয়ারী মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ৩য় সাফ ফুটবলে আমরা শিরোপা জয় করেছি, তবে আগের দুটো আসরে বুক ভেঙ্গে গেছে দলের বর্থ্যতায়। ৩য় সাফ ফুটবলে শিরোপা জয়ের পরই আবার একই বছর ইসলামাবাদ সাফ গেমস ফুটবলে আমাদের ফলাফল ছিলো লজ্জাজনক। আসলে ফুটবল পাগল জাতি হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক ফুটবলে আমাদের অবস্থান আজও দুঃখজনকভাবে অনেক পেছনে। সদ্যসমাপ্ত সাফ গেমসের পরিবর্তিত রূপ এসএ গেমস, শ্রীলঙ্কা ২০০৬-এ বাংলাদেশ ফুটবল দলের ব্যর্থতা জাতিকে আবারো হতাশার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। গেমসে বাংলাদেশের নাম ফেভারিট হিসেবে উচ্চারিত হলেও, বাংলাদেশ দল প্রথম রাউন্ডের গণ্ডি পেরুতে পারে নি। মোট কথা, বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব থেকে শুরু করে, এশিয়ান ফুটবলে আমাদের জাতীয় দলের ফলাফল মোটেও সুখপ্রদ নয়। আজ ভারত, পাকিস্তান তো দূরের কথা,- নেপাল, মালদ্বীপের মতো দেশের ফুটবলও আমাদের চাইতে অনেক এগিয়ে। আন্তর্জাতিক ফুটবলে ছিটেফোটা সাফল্য থাকলেও ব্যর্থতার বোঝাটা বেশী ভারী। এছাড়া বিভিন্ন সময় আমাদের দেশের ক্লাবগুলো দেশ-বিদেশের মাঠে নৈপুণ্য প্রদর্শন করে তুলে এনেছে সাফল্য।

স্বা ধী ন তা র প র ঢা কা র ফু ট ব লে সে রা রা

foota24[1]স্বাধীনতার পর অনেক প্রতিভাধর খেলোযাড়ের আবির্ভাব ঘটেছে ঢাকার ফুটবলে। এদের মধ্যে সেরা কিছু খেলোয়াড়ের নাম তুলে ধরা হলো- সালাহউদ্দিন, আশিষ ভদ্র, টিপু, নওশের, জহির, পিন্টু, আমিন, মঞ্জু, মেজর হাফিজ, এনায়েত, রামা, আবুল, অমলেস, মোহসীন, সামসু, কানন, সালাম মুর্শেদী, বাদল রায়, কায়সার, সাব্বির, আয়াজ, মিজান, জনি, এমিলি, সাদেক, নান্নু, টুটুল, চুন্নু, জামিল, আকতার, ইফসুফ, এফআই কামাল,রুপু, রনজিৎ আসলাম, রুমি, মুন্না, মামুন, রেহান, আলমগীর, মোতালিব, কাল, সামসু, শফিকুল ইসলাম মানিক, কানন, বাবলু, লাবলু, ওয়াসিম, আজমত, হালিম, সিজার, রকিব, ইশবাল, মানিক-১, মুন, বাদল দাস, জোসী, মাসুদ, তুহিন, টিটো, মর্তজা, বাটু, আবুল, খুরশিদ বাবুল, বাবুল, মনু, উত্তম, বাবুল, পনির, পিযুস, গিয়াস, আমান, রুবেল প্রমূখ। সাম্প্রতিক সময়ে আরো অনেক ফুটবলার তাদের নৈপুণ্য দিয়ে দর্শকদের নজর কেড়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- জুয়েল রানা, নকিব, আলফাজ, মাসুদ রানা, জয় প্রমুখ।

ফু ট ব লা র দে র পা রি শ্র মি ক

foota24[1]স্বাধীনতার পর দেশের ফুটবলের উত্তরণের সাথে সাথে বাড়তে থাকে ফুটবলারদের পারিশ্রমিক। বিশেষ করে আশির দশকে এই পারিশ্রমিকের পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। আশি ও নব্বইয়ের দশকে স্টার, সুপারস্টার ফুটবলারদের পারিশ্রমিক দশ থেকে বিশ লাখ পর্যন্ত ওঠানামা করেছে। ’৮৬ থেকে ’৮৯ পর্যন্ত সাড়া জাগানো ডিফেন্ডার কায়সার হামিদ ছিলেন সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত খেলোয়াড়। এ সময় তার পারিশ্রমিক ১০ থেকে ১৩/১৪ লাখে ওঠানামা করেছে। আসলাম, সাব্বির , মোনেম মুন্না, রুমি, জুয়েল রানা, নকিবের মতো খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক ১০ লাখের ওপরে ছিলো। তবে নব্বই দশকের একেবারে গোড়ায় বিস্ফোরণ ঘটান মোনেম মুন্না। এ সময় তিনি আবাহনীর নিকট থেকে ২০ লাখ টাকা পারিশ্রমিক গ্রহণ করেন। এদেশের ফুটবল ইতিহাসে যা একটা রেকর্ড। কিন্তু দুঃখজনক সত্যি হচ্ছে, ফুটবলের গতি মন্থর হওয়ার সাথে সাথে ফুটবলারদের পারিশ্রমিক কমতে থাকে। মাঝখানে ফুটবলারদের পারিশ্রমিক তো আগের তুলনায় অনেক কমে গিয়েছিলো, কিন্তু বর্তমানে তা কিছুটা বেড়েছে। আশি-নব্বইয়ের দশকে যেখানে ফুটবলারদের পারিশ্রমিক ১০ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকায় ওঠানামা করেছে, সে ধারাবাহিকতায় ২০০৪-৫ সালে ফুটবলারদের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক বেড়ে ৩০/৩৫ লাখ টাকা হওয়ার কথা- কিন্তু তা হয়নি; বরং কমে গেছে অনেক।

কা লো টা কা র দা প ট

foota24[1]কারো কারো মতে, আশির দশকের শেষদিকে ফুটবলে কালো টাকার দাপট বেড়ে যায়, যা ফুটবলের ক্ষতির পেছনে আর একটি বড় কারণ। সে সময় যাচ্ছেতাইভাবে কালো টাকার ছড়াছড়ি ফুটবলারদের বিভ্রান্ত করে ফেলেছিলো। ফলে তারা নিজেদের খেলার মানের দিকে যতোনা মনোযোগী হয়েছে, তার চাইতে বেশী ছুটেছে টাকার পেছনে। আর এদের অনুসরণ করেছে পরের জেনারেশন। তখন বড় দলগুলো যেনো টাকার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেছিলো। একটু নজর কেড়েছে এমন খেলোযাড়কেও তারা সে সময় ৫/৬ লাখ টাকায় চুক্তি করেছেন। এ সময় রসিকজনেরা বলতেন- ‘বুটের ফিতে বাঁধতে জানলেই ঢাকার মাঠে পাঁচ-সাত লাখ টাকা আয় করা যায়।’ বড় দলগুলোর সাথে ছোট দলগুলোর, বড় মাপের খেলোয়াড়দের সাথে ছোটমাপের খেলোয়াড়দের অর্থনৈতিক বিশাল বৈষম্যও ফুটবলের অনেক ক্ষতি সাধন করেছে। মানসম্পন্ন ফুটবলার তৈরীর ক্ষেত্রে সৃষ্টি করেছে প্রতিবন্ধকতা। ১৯৯১ সালে এক সাক্ষাৎকারে ’৭৮ সালে ইরানের হয়ে বিশ্বকাপে অংশ নেয়া খেলোয়াড় এবং ঢাকা মোহামেডান ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী নাসের হেজাজী বলেছিলেন, ‘ফুটবলারদের মানের চাইতে পারিশ্রমিক বাড়াটা ফুটবলের জন্য ক্ষতিকর। অধিক পারিশ্রমিক খেলার মানোন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।’

পা তা নো খে লা

foota24[1]ফুটবলে অর্থের দাপট বাড়ার সাথে সাথে পাতানো খেলার প্রভাব বাড়তে থাকে। শিরোপাকে করায়ত্ত করার জন্য বড় দলগুলো মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে পাতানো খেলা খেলতে শুরু করে। আবার রেলিগেশনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ছোট দলগুলো অর্থের বিনিময়ে পাতানো খেলার সুযোগ নিতে থাকে। আর এই পাতানো খেলার কালচার ফুটবলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। পাশাপাশি দর্শকরা হতে থাকে প্রতারিত। ফুটবলের মান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার এটি আর একটি কারণ। ঢাকার মাঠে এখনো পাতানো খেলা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে একজন সাবেক খেলোয়াড়ের ভাষ্য হচ্ছে, ‘ফুটবলে এখন পাতানো খেলা আশঙ্কাজনক রূপ নিয়েছে।’ এ প্রসঙ্গে তিনি জাতীয় ফুটবল ২০০৫-এর কয়েকটি খেলার উদাহরণ দেন।

বি দে শী খে লো য়া ড়

foota24[1]ঢাকার মাঠে বিদেশী খেলোয়াড়ের আসা-যাওয়া অনেক আগে থেকেই ছিলো। । পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঢাকার ফুটবলে মারকানী ও বেলুচিস্তানের ফুটবলারদের দাপট ছিলো বেশ। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে উপমহাদেশের অনেক খ্যাতিমান খেলোয়াড় ঢাকায় খেলে গেছেন। সে সময় ওয়ারী, ভিক্টোরিয়া, ওয়ান্ডারার্স, ইপিআইডিসিতে পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারী ও পাঞ্জাবী খেলোয়াড়দের আসা-যাওয়া ছিলো লক্ষ্যণীয়। স্বাধীন দেশের মাটিতে প্রথম বিদেশী খেলোয়াড় নিয়ে আসে মোহামেডান। ১৯৭৪ সালে ভারতের চন্দ্রশেখর প্রসাদ ও প্রভাকর মিশ্র মোহামেডানের পক্ষে খেলতে ঢাকায় আসেন। মাঝখানে বিরতির পর ১৯৭৭ সালে আবার ঢাকায় বিদেশী খেলোয়াড়ের আবির্ভাব ঘটে। এ বছর মোহামেডানে পাকিস্তানের কালা গফুর, আশিক আলী, ফজলুর রহমান ও আফজাল হোসেন খেলেন এবং আবাহনীতে খেলেন শ্রীলঙ্কার গোলরক্ষক লায়নেল পিরিচ ও স্ট্রাইকার মহেন্দ্র পালা। আর এই দুই শ্রীলঙ্কান ফুটবলারের কল্যাণেই সেবার আবাহনী লীগ শিরোপা ঘরে তুলতে সক্ষম হয়। ১৯৭৮ সালেও আবাহনীতে লায়নেল পিরিচ ও মহেন্দ্র পালা খেলেন। এ বছর মোহামেডানের পক্ষে নেপালের সাক্য বড়ুয়া, এবং রহমতগঞ্জের পক্ষে স্কটিশ ফুটবলার পলকাসিং খেলেন। ১৯৭৯ সালে মোহামেডান ও ওয়ারীতে দু’জন করে ভারতীয় ও রহমতগঞ্জে নাইজেরিয়ান খেলোয়াড় টম খেলেন। ১৯৮০ সালে ভুটানের বাসনাত মোহামেডানের পক্ষে খেলেন। এরপর থেকে ঢাকার ফুটবলে বিদেশী খেলোয়াড়ের সংখ্যা বেড়ে যায়। আশি ও নব্বইয়ের দশকে ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, নাইজেরিয়া, ব্রাজিল, হল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, থাইল্যান্ড, ঘানা, রাশিয়া প্রভৃতি দেশের বেশ কিছু সংখ্যক খেলোয়াড় ঢাকায় খেলেন। তবে এ ক্ষেত্রে একটি ব্যাপার লক্ষনীয় আর তা হচ্ছে, প্রথম দিকে মানসম্পন্ন বিদেশী খেলোয়াড়ের আবির্ভাব ঘটলেও দিন যতোই যেতে থাকে দেশীয় ফুটবল এবং ফুটবলারদের সাথে পাল্লা দিয়ে বিদেশী ফুটবলারের মানও ততোই কমতে থাকে। ক্লাবগুলো ‘মান’ নয় ‘বিদেশী’ শব্দটাকেই অধিক গুরুত্ব দিতে থাকে। অনেকের মতে, স্রোতের মতো আসা এই সব বিদেশী খেলোয়াড় দেশের ফুটবলে যতোটা না কল্যাণ বয়ে আনছে, তার চাইতে ক্ষতিই করছে বেশী। এদের জন্য প্রতিভাধর অনেক দেশীয় ফুটবলারকে সাইড লাইনে বসে থাকতে হচ্ছে। একসময় যেমন বিদেশী ফুটবলাররা আমাদের ফুটবলের মান এবং সৌন্দর্য-দু’টোই বাড়াতো। বেশ উঁচু-মানের সেই সব খেলোয়াড়ের নাম এখনো ফুটবল প্রেমিকদের মুখে শোনা যায়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন শ্রীলঙ্কার পাকির আলী, লায়নেল পিরিচ, প্রেমলাল, চন্দ্রসিড়ি, অশোকা, নেপালের গনেশ থাপা, কৃষ্ণ থাপা, মান বাহাদুর থাপা, গালে, ভুটানের খরগ বাহাদুর বাসনাত, পাকিস্তানের কালা গফুর, নাইজেরিয়ার ইব্রাহিম সেঙ্গার, চিমা ওকেরী, এমেকা ইউজি, ইরানের নাসের হেজাজী (কোচ কাম গোল রক্ষক), নালজেগার, মর্তুজা, বোরহান জাগেদ, ভিজেন তাহেরী, ইরাকের শামির শাকির, করিম মোহাম্মদ, রাশিয়ার সের্গেই ঝুকভ, কাজাকভ আন্দ্রে, উজবেকিস্তানের আব্দুর রহিমভ। ১৯৮১ সালে আবাহনীতে খেলতে আসা শ্রীলঙ্কার ডিফেন্ডার পাকির আলীী পরবর্তীতে দীর্ঘ আট বছর আবাহনীর জার্সি গায়ে চাপিয়ে নিজের চমৎকার ফুটবল নৈপুণ্য প্রদর্শন করে এদেশের ফুটবলানুরাগীদের মন জয় করে নেন। বলতে গেলে, তিনি যেনো এদেশের মাটি ও মানুষের সাথে মিশেই গিয়েছিলেন। ’৮৩, ’৮৪ ও ’৮৫ সালে পরপর তিনবার লীগের শিরোপা অর্জন করে আবাহনী যে দুর্লভ হ্যাট্রিক করে তার পেছনে পাকির আলীর ছিলো অসামান্য অবদান। একথা সে সময়ের দর্শক এবং ফুটবলবোদ্ধারা অকপটে স্বীকার করতেন যে, পাকির আলী যতোদিন আবাহনীতে ছিলেন আবাহনীর রক্ষণভাগকে একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ বানিয়ে রেখেছিলেন । সর্বশেষ তিনি ’৯১-৯২ তে পিডব্লিউডিতে খেলেন। টানা চার বছর আবাহনীর জার্সি গায়ে চাপিয়ে খেলেন শ্রীলঙ্কার স্ট্রাইকার প্রেমলাল। তিনিও সর্বশষ ’৯১-৯২ তে পিডব্লিউডিতে খেলেন। শ্রীলঙ্কার অশোকা টানা পাঁচ বছর খেলেন আবাহনীতে। নেপালের গনেশ থাপা টানা চার বছর ঢাকা লীগে খেলেন। এখনো প্রতি বছর ঢাকা মাঠে খেলছেন অনেক বিদেশী খেলোয়াড়, কিন্তু তাদের কেউই পাকির আলীদের মতো মানসম্পন্ন ফুটবল নৈপুণ্য উপহার দিয়ে ফুটবল দর্শকদের মনে স্থান করে নিতে পারছেন না। এ সম্পর্কে সমালোচকদের ভাষ্য হচ্ছে, যাদের মান-ই নেই তারা মাঠ-ই মাতাবে কি, আর দর্শকদের নজরই বা কাড়বে কি।

শে ষ ক থা

foota24[1]ঢাকার ফুটবলের সাথে সারা দেশের ফুটবলের উত্থান-পতনের রয়েছে একটা সুগভীর সম্পর্ক। ঢাকার ফুটবলকে সামনে রেখেই গড়ে ওঠে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ফুটবলাররা। আজ ঢাকার ফুটবল নানা অনিয়ম, অব্যবস্থা আর দুর্নীতির মধ্যে নিপতিত। নেই সেই অকৃত্রিম ফুটবলপ্রীতি খেলোয়াড় ও সংগঠকদের মাঝে। বরং দুঃখজনকভাবে বেড়েছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। ফেডারেশনে চলে গেছে ক্ষমতাসীনদের দখলে। সেখানেও দলাদলি। ফুটবলকে রাখতে হবে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত। একথা তো কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে, ফুটবল বাঁচলে এদেশের খেলাধুলা বাঁচবে। আর খেলাধুলা বাঁচলে দেশ সুস্থ এবং শক্ত-সমর্থ প্রজন্ম পাবে। কমে যাবে অপরাধীর সংখ্যা আর অপরাধপ্রবণতা। কাজেই অত্যন্ত সহজলভ্য আর সেরা আনন্দদায়ক ফুটবলটাকে আজ আগে বাঁচানো জরুরী। ফুটবলের আঙ্গিনায় বিরাজিত কালবেলাকে মুছে দিয়ে আলোর ঝলকানি আনতে সকলকে হতে হবে সোচ্চার।

কালোদের শক্তির উৎস

একটি বিশেষ নিবন্ধ

ka-13[1]

মা হা বু বু ল  হা সা ন  নী রু

পশ্চিমা মিউজিক ওয়ার্ল্ডে ঝড় তোলা এক কৃষ্ণাঙ্গ পপ গায়কের একটি জনপ্রিয় প্রেমের গানের সুরের মূর্চ্ছনায় উৎফুল্ল মনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে বাস্কেটবল খেলোয়াড় এডামস। মাঝে মাঝে বেশ উঁচু স্বরে ঠোঁট মেলাচ্ছে গানের সাথে এবং সেই তালে আঙ্গুলগুলো স্টিয়ারিং-এর ওপর লাফাচ্ছে। গাড়ির গতির কাটা সত্তুর থেকে পঁচাত্তর ওঠানামা করছে।   গন্তব্য ম্যানচেষ্টার। লিভারপুল থেকে ম্যানচেষ্টার খুব দূরের পথ নয়। মাত্র পঁয়ত্রিশ মাইল। প্রেমিকার উষ্ণ সান্নিধ্য প্রাপ্তির প্রাবল্য থার্মোমিটারের তাপপ্রাপ্ত পারদের মতো লাফিয়ে ওপরে উঠে বসে আছে। ওর প্রেমিকা জেসিকা ম্যানচেষ্টারের একটি শপিং মলে কাজ করে। প্রতি সপ্তাহের সানডে নাইট ওরা এক সঙ্গে স্যাম্পেনের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে উপভোগ করে। একে অপরের শরীরের উত্তাপ বিনিময় করে।

মাত্র কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যা নেমেছে। আবহাওয়াটা চমৎকার অনুকুলে। মে-জুন সময়টাকে ইংল্যান্ডে ‘আর্লি সামার’ ধরা হয়। এ সময় স্বাভাবিক তাপমাত্রা ১৫-২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং আর্দ্রতা থাকে ৫০-৬০%।

হঠাৎ একটা সাদা টয়োটা কারিনা এডামসের গাড়ির গতি রোধ করে সামনে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে নামলো তিনজন শ্বেতাঙ্গ যুবক। ওরা ইশারায় এডামসকে গাড়ি থেকে নামতে ইঙ্গিত করলো। এডামস গাড়ি থেকে নামতেই যুবকরা ওর মুখোমুখি হলো। কথা নেই, বার্তা নেই এক যুবক ধাঁই করে একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো এডামসের চোয়ালে। হতভম্ব এডামস! প্রশ্ন করলো, তোমরা আমাকে মারছো কেন?

উত্তরে এক শ্বেতাঙ্গ যুবক খেঁকিয়ে বললো, ‘তুই কালো, তাই তোকে মারছি’। এরপর এডামসের বাঁ চোখের ওপর আর একটা ঘুষি পড়তেই ওর চোখের সামনে দুনিয়াটা অন্ধকার হয়ে গেলো।

কালোরা এতো শক্তি আর মনোবল পায় কী করে?

কালোরা এতো শক্তি আর মনোবল পায় কী করে?

শ্বেতাঙ্গদের নিপীড়ন আর নির্যাতনে কৃষ্ণাঙ্গদের দুনিয়া সব সময়ই আঁধারে ঢাকা থাকতো। ক্ষেত্রবিশেষে আজও আছে। চামড়া কালো বলে তাদের যেনো অপরাধের অন্ত নেই। নানা অজুহাতে শ্বেতাঙ্গরা তাদের ওপর চালাতো নির্যাতনের স্টিমরোলার। ক্রীড়াঙ্গনও এর বাইরে ছিলোনা। ক্ষেত্রবিশেষে আজও নেই। লাঞ্চনা-বঞ্চনা আর নির্যাতনের সে সব করুণ অধ্যায় কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। কারো কারো জীবনে রাতের ঘুম হারাম করা দুঃস্বপ্ন। তবে দিনে দিনে এ চিত্র অনেকটাই বদলেছে। শুধু বদলেছে বললে ভুল হবে, আসলে ক্রীড়াক্ষেত্রসহ অনেক ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গরা স্বীয় শৌর্য-বীর্যের প্রদীপ্ত মনোবলে পদানত করেছে অনেক প্রতিকুলতা। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে যে, খেলাধুলার ক্ষেত্রেই এসেছে তাদের সবচেয়ে বেশী সাফল্য। বিশ্ব ক্রীড়ায় কৃষ্ণাঙ্গদের বিস্ময়কর সাফল্যে বিস্মিত বিশ্ববাসী। আর যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যায়, কৃষ্ণাঙ্গদের এই সাফল্যের পেছনে আসল রহস্যটা কি। এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, খেলার মাঠে কালো ক্রীড়াবিদ আর রাজনৈতিক মঞ্চে নেলসন ম্যান্ডেলা কালোদের আলো ছড়িয়ে চমকে দিয়েছে বিশ্বকে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ম্যান্ডেলা আজ বিশ্বব্যপী একজন ত্যাগী মহান নেতা হিসেবে সর্বজন শ্রদ্ধেয়। কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে একজন অবিসংবাদিত, আপোষহীন নেতা তিনি।। রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, শিক্ষিত, আফ্রিকার উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক কৃষ্ণাঙ্গ ম্যান্ডেলা তাঁর জীবনের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ পঁচিশটি বছর মানবেতরভাবে কাটিয়েছেন আফ্রিকার এক অতি নির্জন দ্বীপের কারাগারে। এক কঠিন সংগ্রামের অব্যাহত ধারায় বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে এবং বর্ণবাদী ধ্যান-ধারণা ও কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়। কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের শান্তি ও মৈত্রির বন্ধনে আবদ্ধ করে ম্যান্ডেলা উন্মোচন করেন এক নয়া দিগন্ত। বস্তুত এখানে কালোদেরই বিজয় অর্জিত হয়েছে। এই ঐতিহাসিক বিজয় কালো ক্রীড়াবিদদের জীবনেও আশির্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। অবশ্য অন্যায় অনাচারের কবল থেকে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তি মিললেও পরোক্ষভাবে নানা কায়দায় তাদের আজও হয়রানী হতে হচ্ছে।

ছন্দের যাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর মানব জাতি কবিতায় লিখেছেন,“কালো আর ধল বাহিরে কেবল, ভিতরে সবার সমান রাঙা।” কবির এই উপলব্ধি বাস্তবে অনেকটাই ম্লাণ হয়ে যায় যখন মানব সভ্যতার আয়নায় ভেসে ওঠে বর্ণ-বৈষম্যের প্রকট রূপ। ইতিহাসের সেলুলয়েডে যখন দেখা যায় শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা র্কষ্ণাঙ্গদের নির্যাতনের দৃশ্য। কালোদের ওপর সাদাদের নির্যাতন আর কালোদের বঞ্চনার অব্যাহত ধারায় ধরা পড়ে- আসলে সব মানুষের ভেতোরটা সমান রাঙা নয়। এ প্রসঙ্গে এক ক্যারিবীয় কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার ক্রিস্টোফারের ভাষ্য হচ্ছে, ‘শ্বেতাঙ্গরা বাইরে রাঙা হলেও তাদের ভেতোরটা বড়ই কুৎসিত আর কদাকার। আবার কৃষ্ণাঙ্গদের চামড়া কালো হলেও তাদের ভেতোরটা পরিস্কার। সাদারা সব সময়ই কালোদের অপছন্দ করে, তারা সব সময়ই চায় কালোদের দমিয়ে রাখতে। আসলে কালোদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে তারা এক ধরনের মনস্তাতিক সুখ লাভ করে।’

চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, মানুষের ত্বকের নিচে ‘মেলানোসাইট’ নামে এক ধরনের কোষ পাওয়া যায়, যা থেকে নিঃসৃত হয় ‘মেলানিন’। আর এই মেলানিন যার যতো বেশী নিঃসৃত হবে সে ততো বেশী কালো হবে। ত্বকের নিচের এই মেলানিনই হচ্ছে কালোদের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। এই অভিশাপ তারা প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত। আর এই অভিশাপের প্রায়শ্চিত্য করছে তারা সাদাদের নির্যাতনের শিকার হয়ে। আগেও বলেছি, অন্য সব ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও কালোদের নির্যাতনে ইতিহাস সুদীর্ঘ আর মর্মভেদী। এখানেও রয়েছে সাদা কর্তৃক কালোদের ঠ্যাঙ্গানোর অজস্র ঘটনা। আর এই বর্ণ-বৈষম্যের কারণেই বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা ছিলো অনেকদিন নির্বাসিত।

খেলাধুলায় কালোদের পারদর্শিতা নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গরা খেলাধুলায় কেন এতো পারদর্শী? তারা কি বেশী বুদ্ধিসম্পন্ন? অনেকের মতে, ক্রীড়াঙ্গনে কালোদের সাফল্য তাদের জিদ্দি মনেরই বহিঃপ্রকাশ। আবার কারো মতে, শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করে বঞ্চনার যথাযথ জবাব দিতেই তারা বদ্ধপরিকর। এ সম্পর্কে অলিম্পিকের সোনার মেয়ে, সর্বকালের সেরা কৃষ্ণকলি এ্যাথলেট জ্যাকি জয়নার কার্সি বলেছেন, ‘কৃষ্ণাঙ্গদের খেলাধুলায় পারদর্শিতার কারণ তিনটি,  ১. খেলাধুলার জন্য জীবনকে উৎসর্গীকরণ, ২. দৃঢ় সংকল্প, ৩. উচ্চাকাঙ্খা’। কার্সি আরো বলেন, ‘শুধু কৃষ্ণাঙ্গই নয়, এই তিনটি গুণ যদি যে কোনো ক্ষেত্রের যে কোনো ব্যক্তির মধ্যে থাকে তবে তার জীবনে সাফল্য আসতে বাধ্য’।

আর একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীড়াবিদ আন্দ্রেঁ ডসন বলেন,‘তুমি যদি একজন কৃষ্ণাঙ্গ এ্যাথলেট হও তা হলে তোমার মনের মধ্যে এক ধরণের তাড়না কাজ করবে- যা তোমাকে কখনো দ্বিতীয় হতে দেবে না। অর্থাৎ তোমাকে প্রথম হতেই হবে, আর এ জন্য তোমাকে করতে হবে কঠোর পরিশ্রম।’

কালোদের আলোয় আলোকিত বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন

কালোদের আলোয় আলোকিত বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন

একজন সফল কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়ের অনুশীলন প্রক্রিয়ার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে স্পষ্টত:ই দেখা যায় আসলে তারা কতোটা পরিশ্রমী। কতোটা জিদ্দি। কার্ল লুইস, জেসি ওয়েন্স, মোহাম্মদ আলী কিংবা পেলেদের জীবনের ওপর দৃষ্টিপাত করলেই পরিস্কার হয়ে যায়, তাদের বিশ্ব জয়ের সাফল্য কতোটা জেদ, কতোটা পরিশ্রম আর কতোটা সাধনার ফসল। ফুটবল, ক্রিকেট, বাস্কেট বল, টেনিস, বক্সিং, এ্যাথলেটিক্স কোথায় নেই কালোদের শ্রেষ্ঠত্ব? কোথায় তারা রাখেনি তাদের নয়নাভিরাম নৈপুণ্যের স্বাক্ষর? আর প্রমিলা ক্রীড়াবিদদের কথা? গেইল ডেভার্স, মারিয়ন জোন্স, জ্যাকি জয়নার কার্সি, গ্রিফিত জয়নার, মার্লিন ওটি, উইলিয়ামস ভগ্নিদ্বয়। ওদের মুখগুলো মনে কি করিয়ে দেয়না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত কবিতাটিকে, “কালো? তা সে যতোই কালো হোক, আমি দেখেছি যে তার কালো হরিণ চোখ।” কবিগুরু তাঁর কৃষ্ণকলিকে দেখেছেন মেঘলা দিনে ময়নাপাড়ার মাঠে,“ঘোমটা তার ছিলো না মাথায় মোটে/ মুক্তবেণী পিঠের ’পরে লোটে”। আর কার্সি, গ্রিফিত জয়নার, মার্লিন ওটিদের মতো কৃষ্ণকলিদের বিশ্বের ক্রীড়ানুরাগীরা দেখেছেন খেলার মাঠে। কবিগুরুর কৃষ্ণকলি গ্রামের এক সহজ-সরলা, চপলা নারী। তারঁ ভাষায়,“ঘন মেঘে আঁধার হলো দেখে/ ডাকতেছিলো শ্যামল দুটি গাই/ শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে/ কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই। আকাশ পানে হানি যুগল ভুরু/ শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।” কবিগুরুর কৃষ্ণকলি যুগল ভুরু তুলে ভীত চোখে কালো মেঘের পানে তাকালেও আজন্ম বঞ্চনার শিকার কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েরা খেলার মাঠে অমীয় তেজী আর অপ্রতিরোধ্য। তাদের দৃষ্টি ভীত নয়; বরং প্রজ্জ্বলিত, ঝরে যেনো প্রতিশোধের আগুন। মন পাথরের মতো প্রত্যয়ী, আর তাদের সুদৃঢ় প্রদীপ্ত পদচারণায় কাঁপে ধরণী। চমকিত হয় প্রতিপক্ষ। তবে কবিগুরুর সেই উপলদ্ধির অসাধারণ বর্ণনা,“কালো? তা সে যতই কালো হোক,/ দেখেছি যে তার কালো হরিণ-চোখ॥” বিশ্ব ক্রীড়ার কালো হরিণ-চোখধারী নারীদের মাঝে শুধু জয় করার প্রত্যয়ই নেই, দেহময় ছড়িয়ে আছে অসামান্য সৌন্দর্য। বলা যায়, কালোর মাঝে জগত আলো করা রূপ। একেক জন যেনো একেকটা ব্লাক ডায়মন্ড। মারিয়ন জোন্স, জয়নার বা ওটিদের চোখের দিকে তাকালে ঐ চোখ নিয়ে কার না কবিতা লিখতে ইচ্ছে করবে। বেঁচে থাকলে ওদের মায়াবী চাহনী নিয়ে কিংবা ওদের কালো দেহের আলোকিত রূপ-সৌন্দর্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ-জীবনান্দ দাশ হয়তো আরো সেরা সব কবিতা লিখতেন।

কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীড়াবিদদের স্বর্ণালী সাফল্যের উৎস খুঁজতে সাদা চামড়াওয়ালারা সদাই ব্যস্ত। খেলার মাঠে ওদের শ্রেষ্ঠত্বকে মেনে নিতে তাদের বড় কষ্ট হয়, মনে বড়ই অপমানবোধ জাগ্রত হয়। তারা নানাভাবে কালোদের গতিরোধ করার প্রয়াস চালায়। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এতে গতিরোধ না হয়ে গতি আরো প্রবল হয়। কালোরা হয়ে ওঠে আরো অপ্রতিরোধ্য। আরো বিস্তার লাভ করে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব। একদিন সত্যি সত্যি সাদার বুকে কালোর দাপট সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। খেলার মাঠে আপন নৈপুণ্যের ঝলক দেখিয়ে কালোরা সাদাদের সন্মান আদায় করে ছেড়েছে। উন্নত বিশ্বের সাদা চামড়ার দেশগুলো আজ কালোদের ওপর নির্ভরশীলই শুধু নয় , আজ আন্তর্জাতিক ক্রীড়াক্ষেত্রে তারা কালোদের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত। তারপরও কি আর মনের নোংরা এতো সহজে মুছে যায়? একটা প্রবাদ আছে, “কয়লা ধু’লে কি আর ময়লা যায়?” এতোসব সত্বেও একটু সুযোগ পেলে কিংবা সুযোগ করে নিতে পারলে সাদারা এখনো কালোদের ল্যাং মারে। এ ক্ষেত্রে কালো চামড়ার সেলিব্রিটিরাও রেহাই পান না।

১৯৯৩ সালের ৮ মে। অলিম্পিকের স্বর্ণকন্যা জয়নার গাড়ি চালিয়ে ফিরছিলেন। এক সময় সিটি পুলিশ কোনো কারণ ছাড়াই তার গাড়ির গতিরোধ করে এবং তাকে গাড়ি থেকে নামায়। এখানেই শেষ নয়, এরপর সাদা চামড়ার সিটি পুলিশ হাতে হাতকড়া পরিয়ে অস্ত্রের মুখে হাঁটু গেড়ে তাকে মাফ চাইতে বাধ্য করে। এ ঘটনার পর জয়নার তার  অভিযোগে বলেন,“আমার বড় অপরাধ, আমার শরীরের চামড়া কালো। আমি কৃষ্ণঙ্গ বলেই পুলিশ আমার প্রতি এমন নির্মম আচরণ করেছে।”

25আসলে এই বৈষম্যমূলক আচরণ আর নির্যাতনই কালোদের মানসিকতাকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লক্ষ্যে অদম্য করে তুলেছে। ফলশ্র“তিতে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীড়াবিদরা এতোটাই প্রতিশ্র“তিশীল ও দৃঢ়চেতা যে, তারা যেনো খেলার মাঠে পরাজয়কে বরণ করে নিতে জানে না। এখানে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতেই তারা বদ্ধপরিকর।

অনেকের মতে, কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীড়াবিদরা জেনেটিক আশির্বাদপুষ্ঠ। তারা জন্মগতভাবে খেলোয়াড়। তাদের জিনে বংশানুক্রমিক খেলোয়াড়ী ধারা বহমান। তবে যে যতো কথাই বলুক আর যেভাবেই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিক না কেন, কিংবা যতো জেনেটিক ব্যাপার-স্যাপারই থাকনা কেনো, সব থেকে বড় কথা হচ্ছে, বঞ্চনার ঘটনাবলী থেকে জন্ম নেয়া মনের জেদই কৃষ্ণাঙ্গদের প্রধান প্রেরণা। একই সাথে কৃষ্ণাঙ্গরা খেলাধুলাকে তাদের দারিদ্র দূরিকরণ এবং সমাজে প্রতিষ্ঠা প্রাপ্তির প্রধান অবলম্বন মনে করে থাকে। তাদের মনে সব সময় একটা ধারণা কাজ করে থাকে আর তা হচ্ছে, ‘তুমি কৃষ্ণাঙ্গ, তাই তুমি কিছুই না, একেবারে মূল্যহীন। আর তুমি যদি কৃষ্ণাঙ্গ ধনী হও তবে তুমি কিছুটা র্সাথক, আর যদি তুমি হতে পারো একজন বড় ক্রীড়াবিদ তবে তো কোনো কথাই নেই, কারণ- ‘স্পোর্টস ইজ বিগ মানি।’

বিশ্ব টেনিসের সোনালী অতীতের বরেণ্য তারকা, পরে এইডস-এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী ব্লাক ডায়মন্ড আর্থার এ্যাশ তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এ হার্ড রোড টু গ্লোরী’-তে কালোদের সাফল্যের উৎস সম্পর্কে বলেছেন,“কঠোর সংগ্রামই হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গদের সাফল্যের উৎস। কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য নিরলস সাধনা ও সংগ্রাম করে থাকে।”

এ প্রসঙ্গে সাবেক এ্যাথলেটিক ডিরেক্টর ও জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান ফুটবল কোচ ভিন্স ডলের ভাষ্য হচ্ছে, “শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্যের কারণেই ক্রীড়াঙ্গনে কৃষ্ণাঙ্গরা এগিয়ে।” তিনি বলেছেন,‘ আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কৃষ্ণাঙ্গরা ক্রীড়ার সব ক্ষেত্রেই বিস্ময়করভাবে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। প্রকৃতির আশির্বাদ ছাড়া যা একেবারেই অসম্ভব।’ অবশ্য এর বেশী কিছু আর বলেননি তিনি।

তবে সুপ্রতিষ্ঠিত লেখক ও পত্রিকা সম্পাদক ফ্রেডেরিক ডগলাস কিন্তু বলেছেন ঠিক তার উল্টো কথা। তার মতে, ‘শুধু শারিরীক শক্তি দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনা যায় না, জয়ের জন্য দরকার হয় তীব্র বাসনা আর কঠোর সংগ্রাম।’ উল্লেখ্য, ডগলাস নিজেও এক সময় দাস ছিলেন।

কেউ বলেন, আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটেই  ক্রীড়াক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গরা হয়ে ওঠে পারঙ্গম। এ ছাড়া একটি প্রগাঢ় বিশ্বাস তাদের মধ্যে কাজ করে, তা হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তা মূলত: তাদের জন্যই খেলাধুলা সৃষ্টি করেছেন। কৃষ্ণাঙ্গদের বিস্ময়কর ক্রীড়াশক্তির ভূয়শী প্রসংসা করেছেন খোদ দুনিয়া কাঁপানো হিটলার। তবে সেটাতে তার মনোভাব পজেটিভ ছিলো না। কালোদের সাফল্যকে তিনি স্বীকার করেছেন বন্য প্রানীর সাথে তুলনা করে। ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীড়াবিদ জেসি ওয়েন্সের নৈপুণ্য দেখে হিটলার বলেছেন, ‘কালোরা মানুষ হলেও খেলাধুলায় এরা অন্যান্য প্রানীর মতো শক্তিশালী।’

শরীরবিদদের মতে, কালোদের দৈহিক কাঠামো খেলাধুলার উপযোগী করেই গঠিত। এদের শরীর সুঠাম এবং উরু দীর্ঘÑ সাফল্য অর্জনের জন্য একজন ক্রীড়াবিদের যা থাকতেই হবে। আর মনোবিজ্ঞানীরা তো বরাবরই বলে আসছেন, শ্বেতাঙ্গদের চাইতে মনের দিক থেকে কৃষ্ণাঙ্গরা অনেক বেশী বলিয়ান। দিনের পর দিন লাঞ্চনা-গঞ্জনার মধ্য দিয়েই তাদের মাঝে গড়ে উঠেছে এই দৃঢ় মানসিকতা।

খেলার মাঠে কৃষ্ণাঙ্গদের বঞ্চনার ইতিহাস দীর্ঘতরোÑ বর্ণ-বিদ্বেষ নীতির অবসান ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে লড়ার জন্য কৃষ্ণাঙ্গদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। শ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়-কর্মকর্তারা কখনোই নিজেদের পাশে কৃষ্ণাঙ্গদের দাঁড়ানোর সুযোগ দিতো না, এমনকি তাদের প্রতি সুবিচার পর্যন্ত করতো না; কিন্তু সেই কৃষ্ণাঙ্গরা যখন নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে একের পর এক শ্রেষ্ঠ আসনের অধিকারী হতে থাকলো তখন তাদের মর্যাদা এবং অর্থ দুই-ই বেড়ে যেতে লাগলো, সেই সাথে দ্রুত অবস্থানের পরিবর্তন সূচিত হলো। কৃষ্ণাঙ্গ বীর ক্রীড়াবিদরা দাস থেকে দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত হলো। যেমন ব্যক্তিগত, তেমনি দলীয়ভাবে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে কালোদের সাফল্য আকাশছোঁয়া। আবার অপর পিঠে তাদের নির্যাতনের ইতিহাসও দীর্ঘ। এই ক্ষুদ্র পরিসরে যেমন বলা যাবেনা তাদের সব সাফল্যের কথা তেমনি তুলে ধরা যাবে না বুকের সব ব্যাথা। তারপরও অন্যদিনের পাতায় কয়েকটি খেলা আর বেশ কিছু বিশ্ববরেণ্য কালো ক্রীড়াবিদের আলো ছড়িয়ে দেয়া হলো।

ব ক্সিং

আলী স্বীয় আলোকে আলোকিত করেছেন বিশ্ব

আলী স্বীয় আলোকে আলোকিত করেছেন বিশ্ব

বক্সিংয়ের সাথে কৃষ্ণাঙ্গদের জড়িয়ে পড়ার পেছনে একটা নির্মম হৃদয়বিদারক ইতিহাস আছে। যুগে যুগে দাসত্ব বা দাসপ্রথা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘিত এই প্রথা বিলোপের কথা তোলা হযেছে অনেক যুগ আগে থেকেই। দাসপ্রথা বহু প্রাচীন প্রথা। উপনিবেশ আমলে কৃষ্ণাঙ্গরা দাস হিশেবে পরিচিত ছিলো। শ্বেতাঙ্গ মালিকরা এই সব দাসদের দ্বারা তাদের বিকৃত মানসিকতা চরিতার্থ করতো। মালিকরা তাদের সব চাইতে শক্তিশালী দাসদের মোরগ যুদ্ধের মতো মুখোমুখি লড়াইয়ে নামিয়ে দিয়ে তা উপভোগ করতো। এই লড়াই দিনে দিনে মুষ্ঠিযুদ্ধে রূপান্তরিত হলো আর কৃষ্ণাঙ্গরা বাধ্যবাধকতায়, নেশায়-পেশায় জড়িয়ে গেলো এর সাথে। শুরুতে এ লড়াই ছিলো এক নির্মম লোমহর্ষক লড়াই। ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত হয়ে যেতো খেলোয়াড়রা। যদিও পরবর্তীতে এর নানা সংস্কার হয়েছে কিন্তু সভ্য সমাজে আজও এই খেলা প্রবলভাবে সমালোচিত। এই বর্বোরোচিত খেলা নিষিদ্ধ করার দাবী আজও অব্যাহত রয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৮৮৪ সালে মার্কুইস অব কুইন্সবেরী অ্যাক্টের আওতায় বক্সিং প্রচলিত হবার পর থেকে আজ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক বক্সার খেলা চলাকালীন সময়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেকের জীবনে পঙ্গুত্বের অভিশাপ তো আছেই। বক্সিং এমন একটি খেলা যেখানে মৃত্যু হচ্ছে নিত্যসাথী। আর শ্বেতাঙ্গ সাহেবরা তাদের কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের এই খেলায় লেলিয়ে দিয়ে মজা পেতো। তারা তাদের কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের এই বলে উত্তেজিত করতো, ‘হয় মারো, নয়তো মরো’। তবে সার্বক্ষণিক উত্তেজনার কারণে দিনে দিনে খেলাটি বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় খেলায় পরিনত হয়। এবং এর সাথে বিপুর অর্থ-বিত্ত আর সন্মানের সংযোগ ঘটে।

বক্সিংয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাস স্বাভাবিকভাবেই গৌরবোজ্জ্বল। আর এ গৌরবকে ম্লাণ করে দেয়া এবং অর্থ-বিত্ত-সন্মান কুক্ষিগত করার লক্ষ্য এবং অঙ্গীকার নিয়ে একদিন  ইর্ষান্বিত শ্বেতাঙ্গরাও রিংয়ে অবতীর্ন হলো। তারা শুধু কৃষ্ণাঙ্গদের রিংয়ের শ্রেষ্ঠত্বই কেড়ে নেয়ার চেষ্টা চালাতে লাগলো না, সেই সাথে নানাভাবে কৃষ্ণাঙ্গদের হেয় করার প্রচেষ্টাও চালাতে লাগলো। একবার একটি ঘটনা ঘটলো, প্রথম আমেরিকান হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন জর্জ গডফ্রে ছিলেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ। এ খেতাব পড়ে চলে যায় শ্বেতাঙ্গদের দখলে। এবং সে সময়ের শ্বেতাঙ্গ চ্যাম্পিয়ন জন সুলিভান এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না করে প্রথম চ্যাম্পিয়ন জর্জ গডফ্রেকে অপমান করেন। এতে কৃষ্ণাঙ্গরা দারুণ মর্মাহত হয়। তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ  জন্ম নেয়। তারা প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে। ১৯০৮ সালে কৃষ্ণাঙ্গ বক্সার জ্যাক জনসন শ্বেতাঙ্গ টমি বার্ণস-এর কাছ থেকে শিরোপা ছিনিয়ে নিলে কৃষ্ণাঙ্গদের মনের জ্বালা মেটে। তবে শ্বেতাঙ্গরা এ লজ্জা ঢাকতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা প্রতিশোধ নিতে অবসরপ্রাপ্ত একজন সাবেক হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নকে রিংয়ে ফিরিয়ে আনে এবং শিরোপাধারী কৃষ্ণাঙ্গ জ্যাক জনসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামায়। কিন্তু এবারও হেরে যায় শ্বেতাঙ্গরা। অটুট থাকে কালোদের শ্রেষ্ঠত্ব।

বক্সিংয়ে শ্বেতাঙ্গরা দু’এক পশলা সাফল্য দেখালেও কখনোই বক্সিংয়ে কালো আধিপত্য খর্ব হয়নি। আর এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় রিংয়ে আবির্ভূত হয়েছেন মোহাম্মদ আলী, জো ফ্রাজিয়ার, জারসি জো ওয়ালকোট, জো লুইস, লে লিওনার্ড, ল্যারি হোমস, হলিফিল্ড,  মাইক টাইসনের মতো বিশ্বসেরা কৃষ্ণাঙ্গ বক্সাররা।

এদের মধ্যে মোহাম্মদ আলী শুধু বক্সিং জগতেই নয়, গোটা ক্রীড়াবিশ্বে আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বিশ্ব ক্রীড়ার এই জীবন্ত কিংবদন্তী আপন নৈপুণ্য দিয়ে যেমন তাবৎ বিশ্বকে বিমোহিত করেছেন, তেমনি বর্বরোচিত খেলা বক্সিংকে শিল্পময় করে তুলেছেন এবং যুগান্তকারী পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এর আকর্ষণ বাড়িয়েছেন। খেলাটির প্রতি মানুষকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছেন। সেই সাথে নিজে পরিণত হয়েছেন আমজনতার ভালোবাসার মানুষে। আমাদের দেশে মোহাম্মদ আলীর পরিচয় মেলে যেনো ঘরের মানুষ হিসেবে। গেলো শতকের সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে যে এগারো জনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে তার এক নম্বরেই আছেন মোহাম্মদ আলী। আলী বিশ্ব হেভিওয়েট বক্সিংয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তিনবার। শিরোপা জিতেছেন সতেরোটি। লড়াই জিতেছেন ছাপ্পান্নটি। প্রপিক্ষকে নক আউট করেছেন সাঁইত্রিশবার। ১৯৬০ সালে তিনি অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হন। বিবিসিও তাঁকে শতবর্ষের সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে পুরস্কৃত করে।

কালো চামড়ার অধিকারী হলেও আলী নিজের যোগ্যতা আর দক্ষতা দিয়ে সাদা চামড়াওয়ালাদের সমীহই শুধু আদায় করে নেননি, সেই সাথে যেনো প্রভুত্বও বিস্তার করেছেন। মোহাম্মদ আলী যখন তৃতীয়বারের মতো বিশ্ব হেভিওয়েট খেতাব জয় করলেন তখন আমেরিকার জনগণ তাঁর মাঝে তাদের ভবিষ্যত প্রেসিডেন্টের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আলী পারকিনসন্স ডিজিজে আক্রান্ত হলে সে স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়। আজ আলী যেনো পঙ্গুত্বের কারাগারে আবদ্ধ এক চঞ্চল প্রজাপতি। অথচ একদিন এই মানুষটিই মুখ, হাত ও পায়ের অবিশ্বাস্য গতির কারণে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। আমেরিকার ৪২তম প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম জেফারসন ক্লিনটন আলীকে ‘চিরদিনের জন্য বিশ্বশ্রেষ্ঠ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই কালো আলীর আলোতেই আমেরিকার সাদারা আজ বিশ্বব্যাপী আলোকিত। তবে কালো বলে আলীকেও সহজে ছেড়ে দেয়নি শ্বেতাঙ্গরা। তারা একটা বড়সড় আলী বিরোধী গ্র“পও বানিয়ে রেখেছে। আর এই গ্র“পের অন্যতম একজন নেতা হচ্ছেন মার্কিন সাংবাদিক মার্ক ক্র্যাম। ক্র্যাম ২০০২ সালে প্রকাশিত তার  ’ঘোস্টস অফ ম্যানিলা’ গ্রন্থে আলী সম্পর্কে এমন কোনো বাজে শব্দ নেই যা ব্যবহার করেননি। বইয়ের উপসংহারে মার্ক ক্র্যাম লিখেছেন,‘‘আলী সেইন্ট ফ্রান্সিস অফ আসিসি নন। বরঞ্চ তিনি একজন দ্বৈত মনোভাবাপন্ন, সুবিধাবাদী, অন্যের হাতের পুতুল, নারী লোলুপ, সন্তানদের সম্পর্কে উদাসীন, কাপুরুষ, লোভী, বুদ্ধিহীন এক ব্যাক্তি। তারপরও মিডিয়া এমন একটি মুখসর্বস্ব লোককে নিয়ে মাতামাতি করছে। তাকে যে সব বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে এ সবের আড়ালে তার আসল চরিত্র ঢাকা পড়ে গেছে।” ক্র্যামের এই বক্তব্যে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই প্রবল নিন্দার ঝড় উঠেছিলো। অনেকে বলেছেনÑ আলী জবাব দিতে পারবেন না জেনেই ক্র্যাম তার বইয়ে এ সব কথা লিখেছে। আলী মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করায় ক্র্যামদের আক্রোশ আরো বেড়ে গেছে।

আলী লুইভিল শহরের ওহাইও নদীর তীরে ‘মোহাম্মদ আলী সেন্টার’ গড়ে তুলছেন। বছরে চার লাখ লোক এটা পরিদর্শন করবে। এটা নির্মানে খরচ পড়বে ৬ কোটি ডলার। এ ছাড়া লুইভিল বিশ্ববিদ্যালয়ে আলী ইন্সটিটিউট ফর পিস এন্ড কনফ্লিক্ট রেজুলেশনকে পরিচালনা করবেন। এখানে দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের জন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও স্থাপিত হবে। সবকিছু ঠিকমতো চললে বক্সিংয়ের বাইরে এসব হবে আলীর বড় কীর্তি।

মাইক টাইসন

মাইক টাইসন

বক্সিং জগতে আর একটি জগত কাঁপানো নাম হচ্ছে মাইক টাইসন। যদিও নারী কেলেঙ্কারীর কালিমায় নামটির ওপর কলঙ্কের আঁচড় পড়েছে, তবে শুধু এ কারণে তার বক্সিং নৈপুণ্যকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না।  একেবারে বস্তিঘরে জন্ম এই প্রতিভাধর বক্সারের। শৈশব কেটেছে নিউইয়র্কের রাস্তায় রাস্তায় একে ওকে মারধর করে । আর এই দুরন্তপনার কারণে মাত্র ১৩ বছর বয়সে পুলিশ তাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে নিউইয়র্কের এক সংশোধনী কেন্দ্রে পাঠায়। সেখানেই তার বক্সিং-এ হাতে খড়ি এবং সেখানেই ঘটে তার বক্সিং প্রতিভার বিকাশ। তার এই প্রতিভার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম নামী বক্সিং প্রশিক্ষক কাস ডি অ্যামেটো নিজের তত্বাবধানে নেন টাইসনকে। ব্র“কলিনের বস্তি জীবন থেকে টাইসন উঠে আসে ডি অ্যামেটোর বাসগৃহে। এ গৃহে অ্যামেটো তার বান্ধবী ক্যামিল ইওয়ারের সঙ্গে লিভ টুগেদার জীবন যাপন করতেন। এদের দু’জনের ভালোবাসা আর প্রশিক্ষনে গড়ে উঠতে থাকে টাইসন। অ্যামেটোকে বাবা এবং ক্যামিলকে মা বলে ডাকতো সে।অ্যামোটোর ক্ষুরধার প্রশিক্ষনে টাইসন একজন পরিপূর্ণ মুষ্ঠিযোদ্ধায় পরিণত হয়ে মাত্র ২৫ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালে সে সময়ের হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন ট্রেভর বারবিককে নকআউট করে বিশ্বেরর সর্বকনিষ্ঠ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌবর অর্জন করেন। তারপর রিংয়ের ভেতোরে-বাইরে শুরু হয় তার সাফল্যের ইতিহাস। একে একে টাইসনের কাছে ধরাশায়ী হতে থাকে বিশ্বের সেরা সব বক্সার। একদিন টাইসন হয়ে ওঠেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আকাশ ছোঁয়া খ্যাতি, অর্থ, যশ তাকে রাতারাতি তুলে আনে বিশ্ব-শিরোনামে। অত্যন্ত ঝলমলে ক্যারিয়ারের অধিকারী হয়েও নারী কেরেঙ্কারীর কারণে টাইসন অনেকের কাছেই আজ অপ্রিয়।

লায়লা আলী

লায়লা আলী

বক্সিং মানেই পৌরুষের উদ্যাম প্রকাশ আর শক্তিমত্তা ফুটিয়ে তোলার অপূর্ব এক শিল্প, এতোদিন তেমনটিই মনে করা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সে ধারণা মিথ্যে প্রমানিত করেছেন কৃষ্ণকন্যা লায়লা আলী। নারীরাও যে এই খেলার শিল্পময় রূপকে আরো সৌন্দর্যময় করে তুলতে পারে, এর আকর্ষণ বাড়াতে পারে, একটা বলিষ্ঠ নতুন ধারা সৃষ্টি করতে পারে, কিংবদন্তী বক্সার মোহাম্মদ আলী তনয়া লায়লা তা প্রমান করেছেন। আজ বক্সিং রিং-এ নারীর ছন্দময় উদ্দামমুখর উপস্থিতি বক্সিংকে এনে দিযেছে নতুন মাত্রা। এখন দর্শকের ঢল নামে প্রমিলা বক্সিংয়ের লড়াইয়ে। মুগ্ধ চোখে দর্শকরা উপভোগ করে রঙ্গিন প্রজাপতিদের চোখ ধাঁধানো লড়াই। অথচ মেয়েদের পেশাদারী বক্সিংয়ের ব্যাপারটা চার-পাঁচ বছর আগেও সেভাবে কেউ ভাবেনি। ছোটবেলা থেকেই বক্সিং পরিমন্ডলে মানুষ লায়লা আলী বিজনেস ম্যানেজম্যান্টের ওপর উচ্চতর ডিগ্রী নিলেও সব সময় মনে লালন করে আসছিলেন পেশাধারী বক্সার হওয়ার স্বপ্ন। ১৯৯৯ সালের ৮ অক্টোবর ভেরোনার টার্নিং স্টোন ক্যাসিনোতে এপ্রিল ফাউলারের বিরুদ্ধে বক্সার হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। এরপর টানা পনের ম্যাচে অপরাজিত থেকে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বোদ্ধাদের মতে, তার ম্যাচগুলো যে কোনো পুরুষ বক্সারের ম্যাচের তুলনায় অনেক বেশী উত্তেজক ও উপভোগ্য। তার পারফরমেন্স নারী-পুরুষ উভয় দর্শকদেরই আলোড়িত করে এবং আনন্দ দেয়। রিংয়ে তার উত্তাল আগ্রাসি মনোভাব এবং দ্রুত ফুটওয়ার্ক প্রমিলা বক্সিংয়ে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। লায়লা এখন বিশ্ব ক্রীড়ায় অন্যতম সফল এক ক্রীড়াবিদের নাম। তার প্রতিটি লড়াইয়ে টিকিটের দামও আকাশ ছোঁয়া। সেরেনা, ভেনাস ও অন্যান্য প্রমিলা ক্রীড়াবিদদের হারিয়ে আমেরিকায় বিআইটি’র ২০০২ সালের সেরা মহিলা ক্রীড়াবিদের সন্মান জয় করেছেন তিনি। অর্জন করেছেন দি ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্ল্ড বক্সিং ফেডারেশন সুপার মিডলওয়েট চ্যাম্পিয়ন ট্রফি, দি ইন্টারন্যাশনাল এসেসিযেশন বক্সিং ফেডারেশন সুপার মিডলওয়েট চ্যাম্পিয়ন ট্রফি, দি উইমেন্স ইন্টারন্যাশনাল বক্সিং এসোসিয়েশন সুপার মিডলওয়েট চ্যাম্পিয়ন ট্রফি। লায়লা আলীর শিল্পসুষমাময় প্রদর্শনী আলীর মতোই বাড়িয়েছে বক্সিংয়ের আকর্ষন। সেই সাথে নির্মিত হয়েছে কালোদের আর একটি সুউচ্চ মিনার।

ফু ট ব ল

29ফুটবলেও কৃষ্ণাঙ্গদের আধিপত্য ও যাদুকরী নৈপুণ্য বিস্ময়কর। ব্রাজিলিয়ান কৃষ্ণাঙ্গ, হত-দরিদ্র ঘরের সন্তান পেলের চামড়া কালো হলেও তার আলোকে আলোকিত হয়েছে বিশ্ব। কালো চামড়ার কারণে একদিকে যেমন তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের প্রেরণা হয়ে দেখা দিয়েছেন, অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গদের বুকে ধরিয়েছেন জ্বালা । পেলে তাঁর যাদুকরী ফুটবল নৈপুণ্য দিয়ে শুধু বিশ্ব ফুটবলের রাজার আসনটিই দখল করে নেননি সেই সাথে তাবৎ বিশ্বের ভালোবাসার মানুষে পরিনত হয়েছেন। পেলের চামড়া কালো তাই তার আর এক নাম ‘কালো মানিক’। বিশ্ব ফুটবলে পেলের নাম লেখা রয়েছে স্বর্ণাক্ষরে। প্রতিটি দেশের মানুষের কাছে পেলে যেনো একেবারে ঘরের মানুষ। গেলো শতকের সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে যে এগারো জনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে তার দু’নম্বরেই আছেন এই কালো মানিক। তিনি তিনবার বিশ্বকাপ জয় করেছেন ব্রাজিল দলের হয়ে। ফুটবলে তাঁর শৈল্পিক নৈপুণ্য রূপকথার মতো আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ১৯৫৮ সালে তিনি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার লাভ করেন। অবসর নেবার আগ পর্যন্ত তিনি ১৩৬৩টি আন্তর্জাতিক খেলায় গোল করেছেন ১২৮১টি। এটি একটি অুুলনীয় রেকর্ড।

বিশ্ব ফুটবলে কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাস সমৃদ্ধ হলেও তাদের বঞ্চনার ইতিহাসও কম পীড়াদায়ক নয়। সাদারা তো সে সময় কালোদের মাঠের কাছেই ঘেঁষতে দিতো না। বর্ণ-বৈষম্যের শিকার কৃষ্ণাঙ্গদের এক  ‘ব্লাক পার্ল’ হচ্ছেন লেয়ানেদ্রা আন্দ্রাস। দারিদ্রক্লিষ্ট, অবহেলিত এই কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার নিজের লাঞ্চনা-বঞ্চনাভরা ছেলেবেলার কথা ভোলেননি কখনো। ১৯০৭ সালে ছয় বছরের রোগা লিকলিকে এ বালক দূর থেকে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে সাহেবদের খেলা দেখতো। সে সময় কালোদের ফুটবল মাঠে ঢোকা তো দূরের কথা, মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখার অধিকারটুকুও ছিলোনা। আর এই বঞ্চনাই আন্দ্রাসের মনে জন্ম দেয় নিজেকে গড়ে তোলার জিঘাংসা। দিনে দিনে তিনি পরিনত হন এক শিল্পময় ফুটবলারে। আন্দ্রাস ১৯২৪ ও ১৯২৮ সালে অলিম্পিক জয়ী এবং প্রথম বিশ্বকাপ জয়ী উরুগুয়ে দলের সদস্য ছিলেন। বিশ্লেষকদের মতে, ফুটবল খেলাকে তিনি শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেন। যে সব ক্রীড়াবিদ স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ক্রীড়াক্ষেত্র থেকে অবসর নিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাতে কিংবা প্রতিশোধ নিতে হাজির হয়েছেন রাজনীতির মঞ্চে, আন্দ্রাস তাদেরই একজন। ফুটবল থেকে অবসর নেবার পর ১৯৪২ সালে তিনি উরুগুয়ের সিনেটর নির্বাচিত হন। কালোদের পক্ষে দিনে দিনে তার ভূমিকা প্রবলতরো হয়ে উঠলে ১৯৫৬ সালে তাকে মেরে ফেলা হয়। কালো মানিক পেলেও ব্রাজিলের রাজনীতিতে পা রাখেন এবং সে দেশের ক্রীড়ামন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন। পরবর্তীতে ধারাভাষ্যের স্বার্থে পদটি ছেড়ে দেন।

15ফুটবলে দিনে দিনে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রভাব-প্রতিপত্তি দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। আফ্রিকান ফুটবলের কালো মানিকরা এখন ইউরোপের প্রধান টার্গেটে পরিনত হয়েছেন। বিশ্বের সেরা দলগুলো প্রতিভাবান কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারদের প্রয়োজনে নাগরিকত্ব দিয়ে দলে রাখছে। আজকের বিশ্বফুটবলের শীর্ষ সাড়িতে সম্ভবত হাতে গোনা কয়েকটি দেশ আছে যাদের দলে কালো ফুটবলার  নেই। ফুটবলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের জন্য অফুরন্ত দম, দৈহিক শক্তি এবং দুরন্ত গতি দরকার আর এর সব কিছুই রয়েছে আফ্রিকান ফুটবলারদের মাঝে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব গুণাবলী আফ্রিকান ফুটবলাররা জন্মসূত্রেই পেয়ে থাকে। আর এই গুণাবলীকে কাজে লাগিয়ে আফ্রিকায় তৈরী হচ্ছে অনেক স্টার-সুপারস্টার ফুটবলার।

আফ্রিকানদের দক্ষ ফুটবলার হয়ে গড়ে ওঠার ইতিহাস খুব বেশীদিনের নয়, ’৫৮, ’৬২ এবং ’৭০-এর বিশ্বকাপে কালো চামড়ার পেলের অভূতপূর্ব নৈপুণ্য আর আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা অর্জন করে বিশ্ব তারকায় পরিনত হওয়াটা আফ্রিকান ব্ল্যাকম্যান বা কালো মানুষগুলোকে বেশ প্রভাবিত করে । আর পেলের অনুকরণের ফলে ল্যাটিন আমেরিকার শিল্পময় ফুটবল ঢুকে পড়ে আফ্রিকায়। এর পাশাপাশি চলে ইউরোপিয়ান স্টাইলও। বর্তমানে আফ্রিকান ফুটবলের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে ইউরোপিয়ান প্রভাবে। তবে ল্যাটিন আমেরিকার প্রভাব যে একেবারে নেই তা কিন্তু নয়। অপরদিকে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বকাপ ফুটবলে আফ্রিকান দলগুলোর আশাতিত সাফল্য আফ্রিকার ফুটবলের উত্তরণকে দ্রুততর করছে। ১৯৩৪ সালের দ্বিতীয় বিশ্বকাপে আফ্রিকার প্রথম দল হিসেবে মিশর অংশগ্রহণ করে। এরপর এক এক করে খেলে মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনেশিয়া, ক্যামেরুন, জায়ার, নাইজেরিয়া, সেনেগালের মতো দলগুলো। মনে করুন তো নব্বই সালের বিশ্বকাপের ক্যামেরুনকে, আর ক্যামেরুনের সেই রজার মিলাকে। যার ছন্দময় ফুটবল এখনো চোখ বন্ধ করলে দেখতে পায় ফুটবল প্রেমিকরা। সেবার ক্যামেরুনের কালোরা কী তান্ডবই না চালিয়েছিলো বিশ্বকাপের আসরে! চমকপ্রদ পারফরসেন্স দেখিয়ে তারা কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছিলো।

কালোরা বিশ্ব ফুটবলকে অনেকটাই আলোকিত করে রেখেছে

কালোরা বিশ্ব ফুটবলকে অনেকটাই আলোকিত করে রেখেছে

আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলাররা আজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে সারাবিশ্বে। ঢাকা, কোলকাতার লীগেও প্রতি বছর অনেক কালো ফুটবলার আসছেন এবং খেলে যাচ্ছেন। ঢাকার মাঠে এ যাবৎ যে সব কালোরা খেলে গেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, এমেকা ইউজি, চিমা ওকেরী, ক্রিষ্টোফার, লাডিবাবা, ওদিয়াম্বো প্রমূখ। আশির দশকের শুরু থেকে আফ্রিকান ফুটবলারদের দেশ ত্যাগের প্রবনতা লক্ষ্য করা গেলেও ১৯৩৮ সালে এর সূচনাকারী খেলোয়াড় হলেন লার্বী ব্যান বারেক নামের এক আফ্রিকান স্টার ফুটবলার। লার্বীর ফুটবল নৈপুণ্য এতোটাই প্রশংসিত ছিলো যে, চল্লিশের দশকে তাকে ব্রাজিলের লিউনিডাসের সাথে তুলনা করা হতো। ফুটবলে যাদুকরী নৈপুণ্যের কারণে তাকে ‘ব্লাক পার্ল’ বলে ডাকা হতো। মাত্র একুশ বছর বয়সে ফ্রান্সের বিখ্যাত ক্লাব অলিম্পিক মার্সেইলীতে যোগ দিয়ে এই কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার ফুটবল বিশ্বে ঝড় তোলেন। অবশ্য এর আগে ও পরে অনেক আফ্রিকান ফুটবলার খেলেছেন অলিম্পিক মার্সেইলীতে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন গোলরক্ষক অ্যালকাজার, রাহিব জার্মেনী, কার্বিট, আবেদী পেলে প্রমূখ। ঘানা তথা আফ্রিকার বিস্ময়কর প্রতিভা আবেদী পেলে, কলম্বিয়ার অ্যাসপ্রিলা, জর্জ ওয়াহ, এ্যান্থোনী ইয়াবো, থিয়োরে অঁরি প্রমুখ সুপার স্টাররা কালোদের মর্যাদাকে তুলেছেন সুউচ্চ আসনে।

অনেক আফ্রিকান ফুটবলার অতীতে তাদের নৈপুণ্য ঝরিযে জগত আলো করে গেছেন। এদেরই একজন হচ্ছেন পর্তুগালের উপনিবেশ মোজাম্বিকের কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার ইউসেবিও। যাকে বলা হতো পর্তুগালের গোলমেশিন। কারণ তাঁর পায়ের কাজ এবং সঠিক নিশানায় গোল করার দক্ষতা ছিলো মেশিনের মতোই নিখুঁত। অনেকে তাঁকে ‘আফ্রিকান সিংহ’ বলেও সম্বোধন করে থাকে। কেউ কেউ বলে ‘ব্লাক প্যান্থার।’ ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে একটি খেলার চিত্র এখানে তুলে ধরা যাকÑ খেলা হচ্ছিলো পর্তুগালের সাথে উত্তর কোরিয়ার। সে আসরে উত্তর কোরিয়ার ফুটবল যেনো ফুলে-ফেঁপে উঠেছিলো। তারা গ্র“প লীগের খেলায় হারিয়ে দিয়েছিলো দু’বারের বিশ্বকাপ বিজয়ী ইটালীকে, ড্র করেছিলো চিলির সাথে এবং হেরেছিলো রাশিয়ার সাথে। গ্র“পে রানার্সআপ হয়ে তারা কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালের মুখোমুখি হয়েছিলো। ইউসিবিও সমৃদ্ধ পর্তুগালকে শুরুতেই কোনঠাসা করে ফেললো উত্তর কোরিয়া। তিন তিনটি গোল তারা জড়িয়ে দিলো পর্তুগালের জালে। তিন গোল হজম করার পর খেলার আর কি কিছু বাকি থাকে? কিন্তু যে দলে ইউসিবিও রয়েছেন সে দলের শেষ তো রেফারীর শেষ বাঁশি না বাজা পর্যন্ত নির্ধারিত হতেই পারেনা। বিদ্যূতের ঝলকানিতে যেনো উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেন ইফসিবিও। একের পর এক একাই চারটি গোল জড়িয়ে দিলেন কোরিয়ার জালে। এ খেলায় পর্তুগাল জয়লাভ করলো ৫-৩ গোলে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে একে একটি বিস্ময়কর লড়াই হিসেবে চিহিৃত করে থাকেন বোদ্ধারা। এমনি আরো অনেক যাদুকরী নৈপুণ্য দেখিয়েছেন ইউসিবিও তাঁর খেলোয়াড়ী জীবনে। ব্রাজিলের গারিঞ্চা, ডিডিদের অবিস্মরনীয় খেলা ইতিহাসে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।

বিশ্ব ফুটবলে কালোদের দাপট সেই গোড়া থেকেই

বিশ্ব ফুটবলে কালোদের দাপট সেই গোড়া থেকেই

ওদিকে আমেরিকান ফুটবলে কৃষ্ণাঙ্গরা ছিলো বরাবরই উপেক্ষিত এবং বঞ্চিত। বর্ণবাদ সেখানে এতোটাই তীব্র ছিলো যে, সাদারা কালোদের মাঠের কাছেই আসতে দিতোনা। ১৯৪২ সালে ডিউ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ফুটবল খেলা দেখার জন্য কৃষ্ণাঙ্গরা টিকিট কেনার অনুমতি পর্যন্ত পায়নি। অথচ এখন সাদাদের রীতিমতো নির্ভর করতে হচ্ছে আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারদেরই ওপর। আফ্রিকান ফুটবলারদের নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে অনেক সময় দ্বন্ধ-যুদ্ধও হয়ে থাকে। বলা যায় আফ্রিকান ফুটবলাররা এখন পরিণত হয়েছে রপ্তানীযোগ্য সম্পদ হিসেবে। আর বিশ্বের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ে আজ তারা কালো চামড়াকে বিশ্বের দরবারে শুধু মর্যাদাশীল করে তুলছে না, সেই সাথে বিশ্ব ফুটবলকেও করছে পুষ্ট।  বোদ্ধাদের ধারণা, আগামীতে বিশ্ব ফুটবলে খবরদারীকারী ইউরোপের সমস্ত অহঙ্কারকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে পারে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গরা।

তাকানো যাক ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলে চমক সৃষ্টিকারী সেনেগালের দিকে। এ আসরে তারা তাদের সাফল্য দিয়ে বিশ্ব মাতিয়েছিলো। ফুটবলানুরাগীরা বিস্মিত চোখে দেখেছে তাদের অসাধারণ ফুটবল নৈপুণ্য। ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে তখন তাদের অবস্থান ছিলো ৪২-এর ঘরে। ২০০২ বিশ্বকাপের আসরের প্রথম রাউন্ডের প্রথম ম্যাচেই সেনেগালের কালো মানিকরা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে ১-০ গোলে পরাজিত করে তাবৎ বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিলো। শুধু কি তাই, গ্র“পে শক্তিশালী ডেনমার্কের সাথে ১-১ গোলে এবং উরুগুয়ের সাথে ৩-৩ গোলে ড্র করে ৫পয়েন্ট অর্জন করে দ্বিতীয় রাউন্ডে উন্নীত হয়। দ্বিতীয় রাউন্ডে গোল্ডেন গোলের মাধ্যমে সুইডেনকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে। এরপর কোয়ার্টার ফাইনালে তারা গোল্ডেন গোলে তুরস্কের কাছে পরাজিত হয়। অনেকের মতে, এ খেলায় যদি তারা গোল্ডেন গোলে পরাজিত না হতো তবে হয়তো পরর্তীতে সেমিফাইনালে বিশ্বকাপ ফুটবলে ঘটিযে দিতো এক প্রলয়ঙ্কারী ঘটনা। সেনেগালের সালিব দিয়াওয়ের, অঁরি কামরা, এল হাজি দিউফ, বুবা দিউপ, সুলেমান চামারা, হেনরি নামারা, পেপসার প্রমূখ খেলোয়াড়রা বিশ্বকাপে তাদের নৈপুণ্য দিয়ে গোটা বিশ্বকে চমকৃত করেন

ক্রি কে ট

ক্রিকেটেও কালোদের আধিপত্য

ক্রিকেটেও কালোদের আধিপত্য

ক্রিকেটে কৃষ্ণাঙ্গদের বঞ্চনার ইতিহাস আরো বেশী পীড়াদায়ক। ইংল্যান্ডের নাক উঁচু সাহেবরা তো মাঠের আশেপাশে কালো চামড়ার কাউকে দেখলে কুকুরের মতো দুর দুর করে তাড়িয়ে দিতেন। একবার এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে তারা বেধড়ক পিটিয়েছে তাদের খেলা চলাকালীন সময়ে মাঠে প্রবেশ করার জন্য। এমন আরো কতো যে নির্যাতনের কাহিনী রয়েছে ক্রিকেটের ইতিহাস জুড়ে তা কে বলতে পারে।

কালোরা ক্রিকেট বল বা ব্যাট স্পর্শ করলেই তা যেনো নোংরা হয়ে যাবেÑ এই ছিলো সাদা চামড়ার সাহেবদের অভিব্যক্তি। আর মাঠে কালোদের সাথে খেলতে নামা তো জাত-ধর্ম যাওয়ার মতো। নানা বঞ্চনার শিকার হয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের মনে জিঘাংসা প্রজ্জ্বলিত হয়। তারা একাগ্র সাধনা আর কঠোর প্রত্যয়ে সাদাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। সাদাদের অবহেলা আর বঞ্চনার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে হয় বদ্ধপরিকর। ফলশ্র“তিতে দিনে দিনে তারা নিজেদের তিলে তিলে গড়ে তুলে এমন একটা অবস্থানে পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়, যাকে ক্রিকেট বিশ্লেষকরা ‘সাদার বুকে কালোর দাপট’ বলে চিহিৃত করে থাকেন। একদিন এ দাপট রীতিমতো রাজত্বে পরিনত হয়। কালোদের অদম্য ইচ্ছার বলি হয় সাদারা। ক্রিকেটের সূতিকাগার ইংল্যান্ডের মতো শ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্রে কালোরা আজ বীরদর্পে চলমান। কালো চামড়ার আলোতে ক্রিকেট যখন আলোকিত তখন সাদারা ক্রমেই ফুরিয়ে যাচ্ছিলো, আর এই বোধদোয় থেকেই একদিন তারা লাজ-লজ্জা ঝেরে ফেলে শরনাপন্ন হয় কালোদের। নিজেদের ক্রিকেটকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে তারা কালোদের ব্যবহার করতে উদ্যোগী হয়। এবং এই কালোদের ওপর ভর করেই সাদাদের দেশ ইংল্যান্ড বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে বহুবার ঝড় তুলেছে। ফলে ইংল্যান্ডের ক্রীড়াঙ্গনে কালোদের গুরুত্ব দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। ইংল্যান্ড ক্রিকেট টীমের হয়ে এ যাবৎ বেশ কিছু সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার মাঠে নেমেছেন। কাউন্টি লীগে তো এদের কদরই আলাদা। ইংল্যান্ডের হয়ে মাঠে নামা প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় হলেন রোনাল্ড ওয়ালান্ডো বুচার। ১৯৮০-৮১ মৌসুমে এই কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার ইয়ান বোথামের নেতৃত্বে নিজ দেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর করেন। তিনটি টেস্ট ও তিনটি ওয়ানডে ম্যাচে অংশ নিয়ে তিনি ১৪.২০ গড়ে ৭১ রান করেছিলেন। কাউন্টি ক্রিকেটে তিনি ছিলেন মিডল সেক্সের খেলোয়াড়। এরপর একে একে জর্জ কাওরানস, উইফ্রেড বোরিস স্লাক, গ্লাডষ্টোন স্মল, ডিফ্রেটাস, মন্টি এ্যালান লিক্স, ডেভিড ম্যালকম, ক্রিস লুইস, ফিটজেরাল্ড উইলিয়াম প্রমূখ কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়রা ইংল্যান্ড দলের হয়ে খেলে দুর্দান্ত নৈপুণ্য উপহার দেন।

বিশ্ব ক্রিকেটে ক্যারিবীয় কালোদের রাজত্বের কথা তো সকলেরই জানা। কে না জানে গ্যারী সোবার্স, ভিভ রিচার্ডস, ক্লাইভ লয়েড, ডেসমন্ড হেইন্স, কার্টনি ওয়ালশ, ম্যালকম মার্শাল, রিচার্ডসন, লারা, চন্দরপলদের নাম? দলীয় পারফরমেন্সে সাফল্যের ধারাবাহিকতা আজ কিছুটা ম্লান হলেও একদিন এই ক্যারিবীয়দের নামে কেঁপে উঠতো ক্রিকেট বিশ্ব। টেস্ট ও ওয়ানডে দু’ক্ষেত্রেই তাদের ছিলো সমান আধিপত্য। ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বকাপ বিজয়ী এই দলটি টেষ্ট ক্রিকেটের আঙ্গিনায় পা রাখে ১৯২৮ সালে। এর পরপরই তারা অভিষেক টেস্ট খেলে ইংল্যান্ডের সাথে। সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর করে ইংল্যান্ড। অবাক লাগলেও সত্যি যে, ঐ সময় নির্বাচকরা অভিষেক টেস্ট দলের অধিনায়ক হিসেবে ৫১ বছর বয়স্ক শ্বেতাঙ্গ স্যার হেরাল্ড ব্র“স গার্ডেনার অস্টিনের নাম ঘোষনা করেন। কিন্তু অভিজ্ঞ অস্টিন নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন। পরে রবার্ট নুনেজের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইংল্যান্ডে যায় এবং তিন টেস্ট সিরিজের প্রতিটিতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে সিরিজ হারে।  ১৯২৯-৩০ সালে ইংল্যান্ডে খেলতে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজে। ৪ টেস্টের সিরিজ হারলেও তারা জর্জ টাউন টেস্টে জয় পায়। ক্যারিবীয়দের টেস্ট ইতিহাসে সেটাই হচ্ছে প্রথম জয়। ঐ টেস্টে তারা ইংল্যান্ডকে ৯৯ রানে পরাজিত করে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সিরিজ জয করতে খুব বেশী অপেক্ষা করতে হয়নি ক্যারিবীয়দের। ১৯৩৪-৩৫ সালে ইংল্যান্ড ৩ টেস্টের সিরিজ খেলতে আবার ওযেস্ট ইন্ডিজ সফরে আসে। সিরিজের প্রথম টেস্টে হেরে গেলেও পরবর্তী দুই টেস্টে জ্যামাইকা ও ত্রিনিদাদে জয়লাভ করে প্রমবারের মতো সিরিজ জয়ের স্বাদ পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত ক্যারিবিয়ানের কিছু দ্বীপের শ্বেতাঙ্গ খেরোয়াড় নিয়েই মূলত দল গড়া হতো। মাঝে মাঝে কিছু এশিয়ানকেও দলে নেয়া হতো। তবে এ অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে জর্জ হ্যাডলির অধিনায়কত্ব লাভের পর। সে সময় থেকেই স্থানীয় লীগগুলোতে কৃষ্ণাঙ্গরা খেলার সুযোগ পেতে থাকে। তবে এ সময়টাতে কালোদের নানাভাবে বঞ্চিত করা হয়। ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হলো ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কন্ট্রোলিং অব ক্রিকেট (ডব্লিউআইসিবিসি)। ১৯৫৯ সালে বোর্ড চালু করলো গোটা ওয়েস্ট ইন্ডিজ জুড়ে ‘ক্যারিবীয় ক্রিকেট লীগ’। ১৯৬০ সালে বার্বাডোজের সন্তান ফ্রাঙ্কওরেল ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়কত্ব লাভ করলে তিনি দলে ১০জন কৃষ্ণাঙ্গকে স্থান দেন। সাদা চামড়ার খেলোয়াড় ২জন এবং এশিয়ান ছিলেন ৫জন। বিশেষ করে ওয়েস হল, চার্লি গ্রিফিত ও রয় গিলক্রাইস্টকে নিয়ে গঠিত ফাস্ট বোলিং ডিপার্টমেন্টটি ছিলো পুরো কৃষ্ণাঙ্গদের দখলে ফলে শ্বেতাঙ্গদের দীর্ঘ কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। এখানে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করা যায আর তা হচ্ছে, সবচেযে বঞ্চিত ও উপেক্ষিত বার্বাডোজ ও জ্যামাইকা থেকে দলে স্থান পেলো একঝাঁক তারুণ্য প্রদীপ্ত ক্রিকেটার।এদের মধ্যে ছিলেন ওরেল, ওয়ালকট, উইকস, বুচার, হল, গ্রিফিত, গিলক্রাইস্ট, সোবার্স, ভ্যালেন্টাইন।

6১৯৬৫ সালে অধিনায়কত্ব লাভ করলেন ত্রিনিদাদের কৃতি সন্তান গ্যারী সোবার্স। এই সোবার্সই ঘটালেন এক বিপ্লব। তিনি দলে একজনও শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটারকে স্থান দিলেন না।  এরপর ক্লাইভ লযেড এলেন, তিনিও সোবার্সের পথ অনুসরণ করলেন। তিনি কালোদের শেখালেন বিজয়ের মন্ত্র। আর এই মন্ত্রই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের নিয়ে গেলো সাফল্যের স্বর্ণশিখরে। তাদের মাথায় শোভা পেলো একই সাথে বিশ্বকাপ ও অপরাজিত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব। ওরা হয়ে উঠলো অপ্রতিরোধ্য। যদিও লয়েড দলে সান্ত্বনাসূচক দু’জন শ্বেতাঙ্গ (জেফ দুজো ও ল্যারীগোমেজ) রেখেছিলেন তবে তার ব্লাক পাওয়ার পলিসিই কালোদের তুলে নিয়ে গেছে সুউচ্চ শিখরে।

অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে সাদা চামড়ার ক্রিকেট কুলিনদের বিরুদ্ধে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কালোদের ছিলো আকাশ সমান ক্ষোভ আর ঘৃনা। কালো বলে বর্ণবিদ্বেষী ব্রিটিশরা তাদের নানাভাবে বঞ্চিত ও নির্যাতিত করতো। মনের ভেতোর প্রজ্জ্বলিত প্রতিহিংসা দিনে দিনে ক্যারিবীয় ক্রিকেটকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। সাদাদের বঞ্চনা আর নির্যাতনের জবাব দিতেই ক্যারিবীয় ক্রিকেটাররা অদম্য মনেবলে নিজেদের গড়ে তুলতে থাকে। এবং ১৯৭৫ সালে তারা সাদাদের মাটিতেই ক্রিকেটের তীর্থভূমি লর্ডসে বিশ্বের সেরা সব শক্তিকে পরাভূত করে জয় করে প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেটের শিরোপা। ফাইনালে আর এক কুলিন, প্রচন্ড বর্ণবিদ্বেষী জাতি অস্ট্রেলিয়া কালো লয়েড বাহিনীর ব্যাটিং ও বোলিংয়ের ঝড়ো তান্ডবে ধরাশায়ী হলে শ্বেতাঙ্গ প্রভূদের একেবারে বুকের ওপর পতপত করে উড়তে থাকে এক সময়ের ভৃত্য বিবেচ্য কৃষ্ণাঙ্গদের বিজয় নিশান। ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোর ছিলো ৮ উইকেট হারিয়ে ৬০ ওভারে ২৯১, আর অষ্ট্রেলিয়ার স্কোর ছিলো সবক’টি উইকেট হারিয়ে ৫৮.৪ ওভারে ২৭৪। ১৭ রানে বিজয়ী হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ব্যক্তিগত ১০২ রানের সুবাদে ফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন ক্যারিবীয় অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড। অষ্ট্রেলিয়া দলের নেতৃত্ব দেন ইয়ান চ্যাপেল। যিনি সব সময়ই কালোদের খাটো করে দেখে থাকেন। এর পরের বিশ্বকাপটিও অনুষ্ঠিত হয় ইংল্যান্ডে ১৯৭৯ সালে। এ আসরেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের নেতৃত্ব দেন ক্লাইভ লয়েড এবং দলটি দ্বিতীবারের মতো জয় করে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। এ আসরে তারা ফাইনালে পায় এক সময়ের প্রভু খোদ ইংরেজদের।  রক্তে যেনো নাচন জাগে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের। চূড়ান্ত লড়াইয়ে ৯২ রানের বড় ব্যাবধানে তারা সাহেবদের নাক কেটে কালোদের বিজয় পতাকা গেঁথে দেয় সাদাদের বুকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোর ছিলো ৬০ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে ২৮৬ আর ইংল্যান্ডের ৫১ ওভারে সব ক’টি উইকেট হারিয়ে ২৯৪। কৃষ্ণকুমার জুয়েল গার্নার ৩৮ রানে ৫ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডের ড্রেসিং রূমকে শবাগারে পরিনত করেন। ইংল্যান্ড দলের নেতৃত্ব দেন মাইক ব্রিয়ারলি। প্রকৃতির কি বিচিত্র লীলা, পরপর দুটো আসরে দুই কুলিন বিধ্বস্ত!

ক্রিকেটের বরপুত্র ব্রায়ান লারা

ক্রিকেটের বরপুত্র ব্রায়ান লারা

শুধু কি তাই, বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা সব রেকর্ডগুলো গেঁথে আছে এই সব নামের পেছনে। অতি সম্প্রতি টেস্ট ক্রিকেটে লারার ৪০০ রানের বিশ্ব রেকর্ড হতবাক করেছে তাবৎ বিশ্বকে।  রেকর্ডে-নৈপুণ্যে এই কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার আজ এতোটাই সমৃদ্ধ যে, তাকে বলা হয়ে থাকে ‘ক্রিকেটের কৃষ্ণ রাজকুমার’। আর এই রাজকুমারের ঝলমালে সব ইনিংস ফ্রেমে বেঁধে রাখার মতোই। কখনো কালো মেঘ তার ক্যারিযারে ভর করলেও এখনো তিনি বিশ্ব ক্রিকেটকে শাসন করে চলেছেন রাজকীয় চালেই।

সব থেকে বড় কথা হচ্ছে, যে শ্বেতাঙ্গরা একদিন এই খেলাকে নিজেদের সম্পত্তি মনে করতো, যারা কৃষ্ণাঙ্গদের মাঠের ত্রিসীমানায় আসতে দিতো না সেই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেই লারা করেছে এই বিশ্ব রেকর্ড। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে এর আগে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ৩৭৫ রানের ইনিংটি ৯৩-৯৪ মৌসুমে লারা খেলেছিলেন এই নাকউঁচু ইংলিশদের বিরুদ্ধেই। এরপর ২০০৩-০৪ মৌমুমে ৩৮০ রান করে সে রেকর্ড ছিনিয়ে নেন অষ্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান ম্যাথু হেইডেন। কিন্তু ২০০৪ মৌসুমেই মাত্র ছ’মাসের ব্যবধানে ৪০০ রানের ইনিংস হাঁকিয়ে এমন দাপটের সাথে পুনরায় সেই মুকুট লারা ছিনিয়ে নিলেন যে, তার খুনে ব্যাট যেনো কঠিন ভাষায় হেইডেনকে বললোÑ‘এ মুকুট কেবল আমার মাথাতেই শোভা পায়।’ হেইডেন হচ্ছেন অষ্ট্রেলিয়ান শ্বেতাঙ্গ। অষ্ট্রেলিয়ানরা সব সময়ই অহঙ্কারী জাতি। বড় বেশী বর্ণ-বিদ্বেষী এরা। খেলার পাশাপাশি কালো চামড়াধারীদের নানাভাবে হেয়, অপদস্ত করাটাও যেনো তাদের দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পিছিয়ে নেই। এই তো ২০০৪ সালেই শ্রীলঙ্কান কৃষ্ণাঙ্গ সুপার স্টার ক্রিকেটার মুত্তিয়া মুরালিধরনকে ‘চাকার’ বলে বাজে রকম মন্তব্য করেছেন তিনি আর এর কারণে অষ্ট্রেলিয়া সফরে দল গেলেও মুরালী নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন। উল্লেখ্য, এই কালো চামড়ার মুরালী এখন বিশ্বের সেরা বোলার। আর এই ব্লাক প্যান্থারের প্রধান প্রতিপক্ষ হচ্ছেন শ্বেতাঙ্গ অষ্ট্রেলিয়ান শ্যেন ওয়ার্ণ।  শুধু কি বাজে রকম সমালোচনা-, মুরালীকে নানাভাবে হেনস্থা করতেও ছাড়ছেনা শ্বেতাঙ্গরা। এমনকি তারা তার ক্যারিয়ার ধ্বংসের প্রচেষ্টাও কম করছে না। তার বোলিং এ্যাকশনকে একাধিকবার পরীক্ষার সামনে দাঁড় করানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অষ্ট্রেলিয়ার শ্বেতাঙ্গদের ভুমিকাই বেশী। কেননা, কালো মুরালীকে সরাতে পারলে সাদা শ্যেন ওয়ার্ণের পথ পরিস্কার হয়ে যায়। মুরালী এখন বিশ্বের এক নম্বর বোলারÑ এই সত্যটাকে মেনে নিতেই সাদাদের যেনো বড় কষ্ট।

এদিকে চলতি বছরের ৭ সেপ্টেম্বর আইসিসি একটি বিশ্ব একাদশ ঘোষণা করে যেখানে বিশ্বের এক নম্বর বোলার হওয়া সত্ত্বে মুরালী নেই! এক নম্বরকে বাদ দিয়ে আইসিসি’র বিশ্ব একাদশ হয় কি করে? প্র্রশ্ন তুলেছে ক্রিকেট বিশ্ব। অপরদিকে সাজাভুক্ত এবং সারা বছর মাঠের বাইরে থাকা শ্যেন ওয়ার্ন ঠিকই স্থান পেয়েছেন ঐ দলটিতে। সচেতন মহল একে সাদা চামড়া প্রীতির আর এক দৃষ্টান্ত বলে মনে করছে। এ সম্পর্কে মুরালী তার ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় বলেছেনÑ‘এটা একটা পক্ষপাতিত্বের নিন্দনীয় নজির। অবশ্য হাস্যকরও বটে। আমাকে বর্ষসেরা চার খেলোয়াড়ের তালিকায় রাখা হয়েছে অথচ দলে রাখা হয়নি!’ বিবেচ্য সময়টাতে ৮টি টেস্টে ১৭.৪৭ গড়ে ৬৮ উইকেট নিয়েছেন মুরালীÑএমন কৃতিত্ব আর কারো নেই। অপরদিকে ওয়ার্ণ ছিলেন নিষিদ্ধ, তার ওপর বছরের অর্ধেক সময়ই খেলেননি। মুরালীকে এভাবে বঞ্চিত করার কারণ হিসেবে কেউ যদি তার বিতর্কিত বোলিং এ্যাকশনকে উল্লেখ করেন তবে তা গ্রহণযোগ্য নয়, কেননা তার বোলিং এ্যাকশন তো একাধিকবার পরীক্ষার পর ছাড়পত্র প্রাপ্ত। তবে যে যাই বলুক, মুরালীর গাযের চামড়াটা যদি কালো না হতো তবে তাকে এমন বিদ্ধেষের আগুনে পুড়তে হতোনা, বা এভাবে বঞ্চিত হতে হতো না।

ক্রিকেটে কালোরা যেনো রেকর্ডের বরপুত্র। আর কালোদের প্রতিনিধি হয়ে দু’দশকেরর বেশী সময় ধরে যে দেশটি বিশ্ব ক্রিকেটকে শাসন করেছে সে দেশের নাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আর এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের স্বর্ণ যুগের  সবচেয়ে সফল অধিনায়ক হচ্ছেন ক্লাইভ লয়েড। এ ছাড়া তিনি বিশ্বকাপ ক্রিকেটেরও অন্যতম সফল অধিনায়ক। তার নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৯৭৫ সালে প্রথম ও ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করে। বিশ্বকাপে তিনি ১৭টি ম্যাচে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ১৫টি ম্যাচেই জয় পেয়েছিলেন। পরাজিত হয়েছিলেন ২টি ম্যাচে। প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালে তিনি অস্ট্রেলিয়ানদের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরী করেছিলেন। সাফল্যের হার ৮৮.২৩। প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারও তিনি লাভ করেন। ক্লাইভ লয়েড ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান সফরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অধিনায়ক মনোনিত হন। তিনি ১৮টি টেস্ট সিরিজে দলের নেতৃত্ব দেন এর মধ্যে ১৪টিতে জয় পান, পরাজিত হন ২টিতে এবং ড্র করেন ২টি। তিনি ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যানদের তালিকার অন্যতম সেরা ।      নিজের অসমান্য নৈপুণ্য দিয়ে বিশ্ব জয়কারী আর এক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার হচ্ছেন ভিভিয়ান রিচার্ডস। যাকে ক্রিকেট বিশ্ব এক নামে ‘ভিভ’  বলেই চেনে। সত্তুরের দশকে ক্যারিবিয়ানদের বিজয় পতাকা ওড়ানোর পেছনে সবচেয়ে বেশী অবদান ছিলো এই অসামান্য প্রতিভাধর ক্রিকেটারটির। ঐ সময় তাঁকে আউট করতে পারলে যে কোনো বোলারের গর্বে বুক ভরে যেতো। বিশ্বকাপে তিনি মোট ম্যাচ খেলেছেন ২৩টি। ২১ ইনিংসে ৫ বার অপরাজিত থেকে রান করেছেন ১০১৩। যার গড় ৬৩.৩১। বিশ্বকাপে রয়েছে তাঁর তিনটি সেঞ্চুরীÑ১৩৮*, ১১৯, ১৮১। চতুর্থ বিশ্বকাপে করাচিতে অনুষ্ঠিত ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে দলনায়ক হিসেবে আবার ব্যক্তিগতভাবে দুটি অনন্য নজির স্থাপন করেন। ব্যাটসম্যান ভিভ তাঁর অসাধারণ ব্যাটিং নৈপুণ্য প্রদর্শন করে ১২৫ বল খেলে ১৬টি চার ও ৬টি ছক্কার সাহায্যে গড়েন ১৮১ রানের পাহাড় সমান এক বিশ্বরেকর্ড। যদিও পরবর্তীতে তার এই রেকর্ডটি ভেঙ্গেছেন ভারতের লিটল মাস্টার শচীন টেহুুলকর। এ খেলায় ওযেস্ট ইন্ডিজের দলীয় সংগ্রহ ছিলো মাত্র চার উইকেট হারিয়ে ৩৬০। এটি ছিলো বিশ্বকাপে দলীয় রানের বিশ্বরেকর্ড। ১৯৭৯-এর বিশ্বকাপ ফাইনালে তিনি অসাধারণ নৈপুণ্য উপহার দিযে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার জয় করেন। তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় সফল অধিনায়কও বটে। তার নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১২টি সিরিজ খেলে। এর মধ্যে ৮টিতে জয় পান এবং ৪টি ড্র করেন। পরাজিত হননি একটিতেও। ক্যারিবীয় ক্রিকেটের ব্লাক ডায়মন্ড ভিভ রিচার্ড ছিলেন প্রকাশ্যভাবে শ্বেতাঙ্গবিরোধী একজন ক্রিকেটার। তার অধিনায়কত্বের সময়কালে তিনি অ্যান্টিগুয়া ও ত্রিনিদাদের বঞ্চিত কালো ক্রিকেটারদের বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন। বর্ণ-বৈষম্যকে মনে-প্রানে ঘৃণা করেন ভিভ। ১৯৯২ সালের কথা, দক্ষিণ আফ্রিকার পশ্চিম প্রদেশের কারিকাপে খেলার জন্য বিরাট অঙ্কের অর্থের প্রস্তাব দেয়া হলো ভিভকে, কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভিভ সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। কারণ হিসেবে তিনি জানালেন, দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে ফিরে এলেও সেখানকার সাদা-কালো বৈষম্য দূর হয়নি, তাই তিনি সেখানে যাবেন না।

ক্রিকেট বিশ্বের আর এক কৃষ্ণাঙ্গ কিংবদন্তী স্যার গ্যারী সোবার্স। পরিসংখ্যানের আলোকে তাঁকেই বলতে হবে বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার। ৯৩ টেস্টে ১৬০ ইনিংসে ৫৭.৭৮ গড়ে ৮০৩২ রান করার পাশাপাশি ৩৪.০৩ গড়ে ২৩৫টি উইকেট দখল করে এই কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার শীর্ষে অবস্থান নিয়েছেন। সফল অধিনায়ক হিসেবে ক্যারিবীয় ক্রিকেটে তার অবস্থান তৃতীয়, অর্থাৎ ক্লাইভ লয়েড ও ভিভ রিচার্ডস-এর পরেই তার অবস্থান। সোবার্স ৩৯টি ম্যাচে দলকে নেতৃত্ব দেন। এর মধ্যে ৯টিতে জয়, ১০টিতে পরাজয় এবং ২০টি ম্যাচ ড্র করেন। তিনি ১৩টি টেস্টে দল পরিচালনা করেন। ১৯৫৭-৫৮ মৌসুমে তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৩৬৫ রান করে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। যে রেকর্ডটি পরবর্তীতে স্বদেশী ব্রায়ান লারা ভাঙ্গেন। ২০০০-এ উইজডেনের বিচারে ‘ক্রিকেটার অব দ্য সেঞ্চুরী’ নির্বাচিত হন এই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান। অতি সম্প্রতি এই বরেণ্য ক্রিকেটারের কল্যাণে কালোদের মুকুটে যুক্ত হয়েছে আর একটি সাফল্যের পালক। খোদ আইসিসি এতোদিন ক্রিকেটের শ্বেতাঙ্গ কিংবদন্তী স্যার ডন ব্রাডম্যানকে নানা কায়দায়, নানাভাবে সন্মানিত করে এসেছে। দেরীতে হলেও অবশেষ তাদের বোধোদয় হয়েছে। এবার তারা সন্মানিত করেছে ক্রিকেটের আর এক জীবন্ত কিংবদন্তী স্যার গ্যারী সোবার্সকে। স্যার ডন ব্রাডম্যানের পরই  তাঁকে ধরা হয় সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার। আইসিসি চালু করেছে স্যার গ্যারী সোবার্স ট্রফি। অনেকে একে বলছেন ক্রিকেটের ‘অস্কার’। পুরস্কারের নামকরনের দায়িত্বটি ছিলো সাবেক ক্রিকেটার সুনীল গাভাস্কার, রিচি বেনো ও মাইকেল হোল্ডিং-এর ওপর। এ কমিটিতে ইংরেজরা থাকলে হয়তো এখানেও সোবার্স বঞ্চিত হতেন। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে ইংল্যান্ড একদিন কালোদেরকে ক্রিকেটের ধারেকাছে ঘেঁষতে দিতো না, সেই ইংল্যান্ডের মাটিতেই স্যার গ্যারী সোবার্স ট্রফির প্রথম আয়োজনটি জমজমাটভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছে ৯ সেপ্টেম্বও ২০০৪। আর প্রথম গ্যারী সোবার্স ট্রফি জয় করেছের ভারতের কুল হেডেট ব্যাটসম্যান রাহুল দ্রাবিড়। ক্রিকেটে তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষও সাদা চামড়াদের দ্বারা কম লাঞ্চিত-বঞ্চিত হয়নি। ইংল্যান্ড-অষ্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়-কর্মকর্তারা তো এখনো ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়দের নিুবর্ণ বলে বিবেচনা করে। এ ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের মাটিতে স্যার গ্যারী সোবার্স ট্রফির আয়োজন আর ভরতীয় ক্রিকেটার রাহুল দ্রাবিড়ের প্রথম ট্রফিটি জয় সাদাদের নাকটাকে বলতে গেলে মাটিতে ঘষে দিয়েছে। এখানে আরো একটি ব্যাপার লক্ষ্যনীয় আর তা হচ্ছে, আলেকজান্দ্রা প্যালেস নামের পলেস্তারা খসে পড়া যে প্রাচীন ভবনে এই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় অতীতে তা ছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অফিস। ইতিহাসের কি বিচিত্র গতি! একদিন এই অফিসেই হয়তো বসতো ভারতীয়দের বিরুদ্ধে নীল নক্সা তৈরীর বৈঠক। কোনো সময় হয়তো এই অফিসেই তিরস্কৃত কিংবা নির্যাতিত হতে হয়েছে কোনো ভারতীয়কে। আজ সেখানেই পুরস্কৃত করা হলো একাধিক ভারতীয় কৃতি সন্তানকে । উল্লেখ্য, রাহুল দ্রাবিড়ের বর্ষসেরা ও সেরা টেস্ট ক্রিকেটারের ট্রফি জয়ের পাশাপাশি সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের ট্রফি অর্জন করেন আর এক ভারতীয় বাঁহাতি পেসার ইরফান পাঠান। অবশ্য কালো গ্যারী সোবর্সের আলোর স্বাদ ইংরেজরাও পেয়েছে। ইংল্যান্ডের প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ লাভ করেছেন বছরের সেরা ওয়ানডে ক্রিকেটারের ট্রফিটি।

বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ডেসমন্ড হাইন্স ও গর্ডন গ্রিনিজের রেকর্ড ঈর্ষনীয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন দলের কোচ ছিলেন গর্ডন গ্রিনিজ। বলা যায়, তার হাত ধরেই বাংলাদেশ বিশ্বকাপে প্রবেশ করে।

ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটে আর এক ব্লাক ডায়মন্ড কোর্টনি ওয়ালশ। তাকে বলা হয় ক্রিকেটের মহান যোদ্ধা। ১৩২টি টেস্টে ৫১৯টি উইকেট নিয়ে তিনি গড়েছিলেন অনন্য এক বিশ্বরেকর্ড। যদিও সেই রেকর্ডটি এখন আর তার দখলে নেই। ২০০৪ সালের মে মাসে শ্রীলঙ্কান বোলার মুত্তিয়া মুরালীধরণ তার এই রেকর্ডটি ভেঙ্গে ফেলেন। ওয়ালশ ২২টি টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বোলিং মার্কে ঘাতক বোলার হিসেবে তার পরিচিতি থাকলেও একটি ঘটনা এই কালো ক্রিকেটারকে বিশ্ব ক্রিকেটে এক মহান ক্রিকেটারের মর্যাদা এনে দিযেছে। সেই সাথে ক্রিকেটকে করেছে মহিমান্বিত। চতুর্থ বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডের খেলা চলছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তানের মধ্যে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ২১৬ রানের টার্গেটকে তাড়া করতে গিয়ে পাকিস্তান ২০৩ রানে ৯ উইকেট হারায। তখন ক্রিজে ছিলেন আব্দুল কাদের এবং ননস্ট্রাইকিং এন্ডে ছিলেন সেলিম জাফর। শেষ ওভারে পাকিস্তানের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিলো ১৪ রানের। শেষ ওভার বোলিং করেন ওয়ালশ। ওয়ালশ তার বোলিং মার্ক থেকে দৌড় শুরু করে আম্পায়ারকে অতিক্রম করার সময় লক্ষ্য করেন জাফর ক্রিজের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। ওয়ালশ তাকে রান আউট করলেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতে যায, কিন্তু খেলোয়াড়ী মনোভাবের সর্বোচ্চ নজির স্থাপন করে ওয়ালশ জাফরকে রান আউট না করে সতর্ক করে দেন। এরপর আব্দুল কাদির অসাধারণ ব্যাটিং করে ১৪ রান সংগ্রহের মাধ্যমে দলকে জয়ী করান। এ ম্যাচে পাকিস্তান বিজয়ী হলেও ওয়ালশ হয়ে ওঠেন প্রকৃত বীর। কারো কারো মতে, ওয়ালশ কালো বলেই এমন একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছেন। তার জায়গায় একজন ইংরেজ হলে এমন সুযোগ কখনোই হাত ছাড়া করতেন না।

ক্যারিবীয় ক্রিকেটের দুরন্ত গতি এক সময় শ্বেতাঙ্গদের দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলেছিলো।  তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই গতিতে বেশ ভাটা পড়েছে। কেউ কেউ একে পর্দার অন্তরালের কারসাজি হিসেবে চিহিৃত করে থাকেন। কারো মতে, ক্রিকেট খেলাটি ইংল্যান্ডের উচ্চবিত্তের খেলা হিসেবেই পরিচিত ছিলো। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটি প্রথম গঠিত হয় ১৮০০’র শেষ দিকে। স্বাধীনতার পর ঐ দলের খেলোয়াড়রা সব সময় ভালো খেলার চেষ্টা করতো। তাদের লক্ষ্য ছিলো একটাই, আর তা হচ্ছে, ক্রিকেট কুলীণদের একটা শিক্ষা দেয়া। যারা সব সময তাদেরকে অস্পৃশ্য মনে করে। নিজেদের যোগ্যতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে ক্যারিবীয়রা মরিয়া হয়ে লড়তো। লয়েড, সোবার্স, ভিভরা যে আদর্শ ও মানসিকতা নিয়ে ক্রিকেট খেলেছেন, এ খেলাকে তারা যেভাবে কালোদের উত্তরণ এবং প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেছেন, আজকের ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটারদের মাঝে সেই মানসিকতা অনুপস্থিত। এর কারণ হিসেবে অনেকে বলছেন, দারিদ্র এবং অভাব থেকে উঠে আসা এই সব ক্রিকেটার আজ খুব সহজেই বিবেক বিসর্জন দিয়ে অর্থের কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের অধ:গতির এটা একটা বড় কারণ। সোনালী অতীতের সেরা কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার ক্লাইভ লয়েডও বলছেন, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের তরুণরা দিন দিন ক্রিকেট থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যদিও এখানে আজও ক্রিকেটই হচ্ছে প্রধান জনপ্রিয় খেলা।’ তরুণদের এই ক্রিকেট বিমুখতার কারণ হিসেবে লয়েড বলেছেন, ‘আমাদের দেশ আমেরিকার নিকটবর্তী বলে আমাদের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে সারাদিন বেসবল আর বাস্কেটবল খেলা দেখানো হয়। ক্রিকেট তেমন একটা দেখানো হয়না। ফলশ্র“তিতে তরুণদের কাছে ঐ খেলাগুলো দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।’ অবশ্য লয়েড ঐ খেলাগুলোর উচ্চ পারিশ্রমিকের বিষয়টি উল্লেখ করেননি। ওয়েস্ট ইন্ডিজে এ্যাথলেটিক্স, বেসবল ও বাস্কেট বল খেলা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠার আর একটি বড় কারণ হচ্ছে, উচ্চ অঙ্কের পারিশ্রমিক। ঐ সব খেলার তুলনায় ক্রিকেটের পারিশ্রমিক কমে যাওয়ায় ক্রিকেটের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই কমে যাচ্ছে তরুণদের আগ্রহ। একজন ক্যারিবীয় প্রতিভাবান তরুণ এটা ভালো করেই জানে যে, আমেরিকার যে কোনো পেশাদার খেলায় ঢুকতে পারলেই মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক পাওয়া যায়, যা রাতারাতি ভাগ্য বদলে দেয়। এ ছাড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সব চাইতে বড় সমস্যা হচ্ছে, কতগুলো দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দলটির খেলোয়াড় আসে অ্যান্টিগুয়া, ত্রিনিদাদ, বারবাডোস, জ্যামাইকা ইত্যাদি দ্বীপরাষ্ট্র থেকে। আর এই দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীন কোন্দলও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটকে বেশ ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। কোনো কোনো দ্বীপ তো মাঝে মাঝে আলাদা হয়ে যাবার হুমকি পর্যন্ত দিয়ে বসে। দ্বীপগুলোর প্রসঙ্গ যখন এসেই গেলো তখন একটু ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখা যাকÑ কালোদের দেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজÑ এ তো সকলেরই জানা। তবে বিশ্বকাপ ফুটবল কিংবা অলিম্পিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নামটি পর্যন্ত শোনা যায় না কেনো? বিস্ময়কর তো বটেই, মজার ব্যাপারও হচ্ছে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামের দেশটি শুধু ক্রিকেটের গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ। অন্যান্য খেলায় ওয়েস্ট ইন্ডিজভুক্ত দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর নিজ নিজ দ্বীপের নামে অংশ নেয়। সে প্রসঙ্গে আরো একটু পরে আসছি, তার আগে দেখা যাক ওযেস্ট ইন্ডিজের অদিবাসীদের ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বা ক্যারিবীয় বলা হয় কেনো। প্রাচীন উপজাতি ক্যারিবদের নামানুসারেই এখানকার অধিবাসীদের ক্যারিবীয়ান বা ক্যারিবীয় বলা হয়। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার সংযোগ পানামা খালের পূর্বদিকে এবং ক্যারিবিয়ান সাগরের বুকে ভাসমান দ্বীপপুঞ্জের নাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ভারতের কাছাকাছি না হয়েও দেশটির এই নামকরনের কারণ খুঁজতে গেলে পনের শতাব্দীতে কলম্বাসের কাছে যেতে হবে। সমুদ্র পথে ভারত আবিস্কার করতে এসে দুঃসাহসী কলম্বাস ১৪৯৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেন্ট ক্রিস্টোফার এন্ড নেভিস-এ (বর্তমানে সেন্ট ক্রিটস) এসে পৌছান। এখানে এসে কলম্বাস ধারণা করলেন, তিনি ভারতের পশ্চিমের কোনো অংশে এসে পৌছেছেন। তার এই দুঃসাহসী অভিযানকে স্মরনীয় করে রাখতেই ভুল সত্বেও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। যদিও শাসক ইংরেজদের হাত ধরেই উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে প্রবেশ করে। তবে এখানকারও ক্রিকেটের ইতিহাসে কালোদের রয়েছে নানাবিধ লাঞ্চনা-বঞ্চনা আর নির্যাতনের ইতিহাস। আর এর ফলে দিনে দিনে শাসক সাদা চামড়ার বিরুদ্ধে তাদের মনে জমে উঠেছে ক্ষোভ, ঘৃনা আর প্রতিহিংসার বারুদ। আর এই ক্রিকেট দিয়েই তারা বৃটিশ শাসকদের সমুচিত জবাব দেয়ার জন্য কঠোর সাধনায় তিলে তিলে নিজেদের গড়ে তুলতে থাকে। দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীরা সমন্বিত হয়ে ১৯২৭ সালে যে ক্রিকেট বোর্ড গড়ে তোলে তারই তত্বাবধানে এক সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ হয়ে ওঠে যেনো ক্রিকেটার তৈরীর মেশিন। এক সময় প্রতিটি ক্রিকেটার মাঠে পা রাখতো সাদা চামড়ার শাসক আর ক্রিকেটের  কুলিনদের শক্ত জবাব দেবার তীব্র প্রত্যয় নিয়ে; আর এই প্রত্যয়ের কারণেই মেশিনের মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে যেমন বিখ্যাত সব ক্রিকেটাররা বেরিয়ে আসতে থাকে তেমনি অপ্রতিরোধ্য গতি পায় ক্যারিবীয় ক্রিকেট। এক সময় তারা নিজেরা বিশ্ব ক্রিকেটের দখল নিয়ে নেয়। কালোদের ক্রিকেটের আলোতে আলোকিত হয়ে ওঠে বিশ্ব ক্রিকেট। এই দ্বীপপুঞ্জে ক্রিকেটার জন্ম দিতে কোনো দ্বীপের চাইতে কোনো দ্বীপ কম পিছিয়ে নেই। এবার আসুন না পৃথক পৃথকভাবে দ্বীপগুলোর প্রতিভাধর ক্রিকেটারদের দিকে তাকানো যাক ঃ ছোট দ্বীপ বার্বাডোজ। স্বাধীনতা লাভ করেছে ১৯৬৬ সালে। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এই দ্বীপটি যে সব ক্রিকেটার উপহার দিয়েছে তাদের মধ্যে আছেন, বিখ্যাত ‘থ্রি ডব্লিউ’ ওরেল-উইকস-ওয়ালকট। এঁদের পুরো নাম হচ্ছে,  ফ্ল্যাঙ্ক ওরেল,এভার্টন উইকস ও ক্লাইভ ওয়ালকট। এ ছাড়া সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার স্যার গ্যারী সোবার্স, দুরন্ত পেসার হল-গ্রিফিথ জুটি, গতির রাজা মার্শাল, একুরেট গার্নার, বিখ্যাত ওপেনিং জুটি গ্রীনিজ-হায়ান্স, কনরাড হান্ট, সিলভাস্টার ক্লার্ট, কলিন্স কিং প্রমূখ।

৪২৩২ বর্গমাইলের দ্বীপ জ্যামাইকা। দ্বীপটি স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৬২ সালে। বিশ্ব ক্রিকেটে জ্যামাইকার কালো মানিকরা দখল করে আছে অনেকটা অংশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে এই দ্বীপটির অবদান বিশাল। জ্যামাইকা উপহার দিযেছে কোর্টনি ওয়ালশ, প্যাট্রিক প্যাটারসন, মাইকেল হোল্ডিং, ডুজন, ব্ল্যাক ব্রাডম্যানখ্যাত হেডলি, গ্যারী আলেকজান্ডার, লরেন্স রো, অ্যালফÑএর মতো বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটারদের।

ত্রিনিদাদ ও টোবাগো প্রজাতন্ত্র দুটো দ্বীপ নিয়ে গঠিত। আয়তন ১৯৮১ বর্গমাইল। এই দ্বীপটি স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৬২ সালে। এই দ্বীপে জন্ম  নিয়েছেন বিশ্ব ক্রিকেটের রাজপুত্র ব্রায়ান লারা, লিয়েরী কনস্ট্যান্ট, কিল সিমন্স, ল্যারী গোমস, রফিক জুমাদিন, স্টলমেয়ার, ডেরক মারে, বার্নাড জুলিয়েন, গাসলোগি, ইয়ান বিশপের মতো নামকরা সব ক্রিকেটাররা।

দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের সাথে সরাসরি সংযুক্ত গায়ানা। ৮৩,০০০ বর্গমাইলের দ্বীপটি স্বাধীনতা পায় ১৯৬৬ সালে। গায়ানা বিশ্ব ক্রিকেটে উপহার দিয়েছে দু’বার বিশ্বকাপজয়ী বিশ্ব কাঁপানো অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড, রয় ফ্রেডরিকস, স্টিভ কামাচো, কালীচরন, রোহান চানহাই, ল্যান্স গিবস, জো সলোমন, ফুয়াদ বাক্কাস, কলিন ক্রফর্ড, কার্ল হুপার, চন্দরপল প্রমূখ ক্রিকেটার।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাকি দুটো অংশ হচ্ছে লিওয়ার্ড দ্বীপপুঞ্জ ও উইন্ডওয়ার্ড দ্বীপপুঞ্জ। লিওয়ার্ড দ্বীপপুঞ্জটি এন্টিগা, বার্মুডা, মন্টমেরাট, অ্যানগুইলা, সেন্টক্রিস্টোফার ও নেভিস (সেন্ট স্কীটস) দ্বীপগুলো নিয়ে গঠিত। এই দ্বীপগুলোর মধ্যে ক্রিকেটার জন্ম দেয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষে আছে এন্টিগা। এখান থেকে বিশ্ব পেয়েছে বহু স্বনামধন্য ক্রিকেটার। এদের মধ্যে আছেন কিং রিচার্ড বা ভিভিয়ান রিচার্ড, রিচার্ডসন, রবার্টস, এ্যামব্রোস, কেনেথ বেঞ্জামিন প্রমূখ। উইন্ডওয়ার্ড দ্বীপপুঞ্জটি গ্রেনাডা, জেমিনিকা, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রেনাডিনেস দ্বীপগুলোর সমন্বয়ে গঠিত। এখান থেকে কোনো বড় মাপের ক্রিকেটার না বেরুলেও ভালো মানের অনেক ক্রিকেটার বেরিয়েছে।

যুগে যুগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটাররা ক্রিকেটকে নব আলোকে উদ্ভাসিত করে তুলেেেছন। এর একদিকে যেমন রয়েছে শিল্পময়তা, অন্যদিকে ভয়ঙ্কর রূপ। বোলিং মার্কে কোনো কোনো বোলারের প্রান সংহারী ঘাতক-রূপ প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের কলজে শুকিয়ে ফেলতো। আবার কোনো কোনো ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং তান্ডবে একেবারে ভূ-লুন্ঠিত হতো প্রপিক্ষের বোলাররা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের তিন পেসার হল, গ্রিফিত ও গিলক্রাইস্ট এক সময় ব্যাটসম্যাদের পৃথিবীর স্বর্গীয় পরিবেশে বাস করার কথা ভুলিয়ে দিতেন। এই তিন বোলার এতোই দ্রুতগতিতে বল করতেন যে, ব্যাটসম্যানরা যখন তাদের বল খেলতেন তখন শুধু মৃত্যুর কথাই চিন্তা করতেন, এবং তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতো। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাইকেল হোল্ডিংকে কেউ কেউ টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে দ্রুততম ফাস্ট বোলার হিসেবে গণ্য করে থাকেন। অবশ্য বোদ্ধাদের অনেকেই এ দাবীকে সমর্থন করেন না। হোল্ডিং-এর বলের গতির সাথে শয়তানের গতির তুলনা করা হতো। ১৯৭৬ সালে ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার ওভাল টেস্টের কথাই ধরা যাক ঃ একটি নি¯প্রান উইকেট। যে উইকেটে উভয় দলের বোলাররাই উইকেট না পেয়ে হতাশ, যে উইকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাদের প্রথম ইনিংসে রান করেছিলো ৬৮৭। সেই উইকেটেই কিনা হোল্ডিং নিজের ঝুলিতে পুরেছেন একে একে ১৪টি উইকেট! এদের মধ্যে তিনি ৮ জনকে করেছেন বোল্ড আউট আর ৬ জনকে এলবিডব্লিউ। সাদা চামড়ার ক্রিটোরদের মুখে কালোদের প্রসংশা শোনা যায় কদাচিৎ।  যে সত্যটাকে কোনোভাবেই আাড়াল করা যায়না সেটাই শুধু তারা স্বীকার করেন। হোল্ডিং সম্পর্কে জিওফ বয়কট বলেছেন,‘আামি যতো ফাস্ট বোলারদের মোকাবিলা করেছি তাদের মধ্যে হোল্ডিংই সেরা।’

আশির দশকে যতো দ্রুতগতি সম্পন্ন বোলারের আবির্ভাব ঘটেছে তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ গতি সম্পন্ন বোলার হিসেবে যে দু’জনকে ধরা হয় এদের একজন হলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যালকম মার্শাল, অপরজন পাকিস্তানের ইমরান খান। এক কথায় মার্শাল হচ্ছেন সেই বোলার যার হাতে বল উঠলে ব্যাটসম্যানদের বুক কেঁপে উঠতো। তার বোলিং ছিলো নানা কারুকাজে সমৃদ্ধ। বোলিং করতে তিনি নয় প্রকারের কৌশল ব্যবহার করতেন। আর এ কারণেই কেউ কেউ তাকে ‘মার্শাল দ্য নিনজা’ নামে সম্বোধন করতো। ১৯৮৩ সালে কলকাতা টেস্টে মার্শালের প্রথম বলটি খেলে গাভাস্কার বলেছিলেন,‘এই বলটিই আমার জীবনে খেলা সব চাইতে দ্রুততম বল।’ ক্রিকেট ইতিহাসের এই ভয়ঙ্কর দ্রুততম বোলারটি আশির দশকে হারাম করে দিয়েছিলেন ব্যাটসম্যাদের ঘুম।

জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে সাদা-কালো সমস্যা অনেকদিনের। সে দেশের কালোরা ক্রিকেটে এতোটাই বঞ্চিত ছিলো যে, মাঠের কাছাকাছি দেখলেই সাদারা কালোদের তাািড়য়ে দিতো। স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে জিম্বাবুযে যখন রোডেশিয়া ছিলো তখন ক্রিকেট ছিলো পুরোপুরি শ্বেতাঙ্গদের দখলে। এ সময়টাতে শ্বেতাঙ্গরা কালোদের নানাভাবে নির্যাতিত ও বঞ্চিত করেছে। দেশটির টেস্ট স্ট্যাটার্স প্রাপ্তির পর কালোদের অবস্থার একটু একটু করে উন্নতি শুরু হয়। জাতীয় দলে তখন কালোদের আগমন ঘটতে শুরু করে। শ্বেতাঙ্গরা ব্যাপারটিকে ভালো চোখে না দেখলেও কিংবা বিদ্বেষী মনোভাবে কালোদের ছেঁটে ফেলার চেষ্টা করলেও কালোরা তাদের যোগ্যতা দিয়ে, নৈপুণ্য প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান সু-দৃঢ় করতে থাকে। হেনরি ওলোঙ্গা, হ্যামিল্টন মাসাকাদজা, টাটেন্ডা টাইবুরা যখন নিজেদের তুলে আনতে সচেষ্ট তখনই জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট ইউনিয়নের দায়িত্বে এলেন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যবসায়ী পিটার চিঙ্গোকা। আর চিঙ্গোকা দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই সোচ্চার হয়ে ওঠেন জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে কালোদের অধিকার প্রতিষ্টায়। তিনি কোটাভিত্তিক পদ্ধতি চালুর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আর এ সম্পর্কে কালোদের বক্তব্য হচ্ছে, দীর্ঘ আধিপত্যের কারণে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট শ্বেতাঙ্গদের এতোটাই দখলে চলে গিয়েছিলো যে, কোটা ছাড়া কালোদের আর কোনো বিকল্প নেই। আর পিটার চিঙ্গোকার এই কোটা পদ্ধতি চালুর উদ্যোগের কারণে শ্বেতাঙ্গদের মনে বিদ্বেষের আগুন জ্বলে ওঠে। চিঙ্গোকার এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কনে বসেন দলনায়ক হিথস্ট্রিকসহ ১৫ জন শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটার। উল্লেখ্য, এই বর্ণ-বিদ্বেষের কোপানলে পড়ে আগেই দেশ ছেড়েছেন সে দেশের বিখ্যাত ক্রিকেটার এন্ডি ফ্লাওয়ার ও উদীয়মান ক্রিকেটার হেনরী ওলোঙ্গা। কালোরা আগেই বয়স এবং অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ এড়িয়ে দলের সর্বকনিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় টাটেন্ডা টাইবুকে সহকারী অধিনায়ক করে রেখেছিলো। হিথস্ট্রিক তার শ্বেতাঙ্গ বাহিনী নিয়ে সরে দাঁড়ালে কালোরা টাইবুকে অধিনায়ক করে শ্বেতাঙ্গদের ছাড়াই দল গঠন করে এবং ৬ মে ২০০৪ তারিখে শুরু হওয়া টেস্টে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ও আর এক কালোর দেশ শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে লড়ায়ে অবতীর্ন হয়। এ টেস্টের মধ্য দিয়ে সোয়াশ’ বছরের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্ব কনিষ্ঠ অধিনায়ক হিেিসবে অভিষেক ঘটে কৃষ্ণাঙ্গ বালকবীর টাইবুর। বলা যায়, কালোদের আধিপত্য নিয়ে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট নতুন করে যাত্রা শুরু করে। বলাইবাহল্য বর্ণভিত্তিক এ লড়াইয়ে দেশটির ক্রিকেটের অসামান্য ক্ষতি সাধিত হয়েছে তবে সেই সাথে কালোদের সুদীর্ঘ বঞ্চনা ও নির্যাতনের অবসানও ঘটেছে। কালোরা দলে থাকলে সাদারা খেলবে না কিংবা কালোদের সমঅধিকারকে স্বীকার করবেনাথÑ সভ্য সমাজে নিশ্চয় এ বর্ণবাদ কারো কাম্য নয়। যদিও হিথস্ট্রিক বাহিনী বলেছেÑ ‘ইস্যুটাকে বর্ণভিত্তিক লড়াই হিসেবে প্রচার করা হলেও তা আসলে ঠিক নয়।’ আমাদের মতো নিরপেক্ষ ক্রিকেটামোদীরাও কখনো কামনা করেনা যে, বর্ণ-বৈষম্য, জাতিগত বিদ্বেষ, রাজতৈতিক প্রতিহিংসা বা অন্য কোনো অপশক্তির কাছে মহান ক্রিকেট কখনো মাথা নত করুক।

দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণ-বিদ্বেষের লেলিহান শিখায় সে দেশের ক্রীড়াঙ্গন যে কী পরিমান ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সেটা কমবেশী সকলেরই জানা। এই বর্ণবৈষম্যের কারণে দেশটি আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গন থেকে দীর্ঘ সময় বহিস্কৃত ছিলো। এ সম্পর্কে বর্ণবাদের অবসানের পর সে দেশের জাতীয় দলের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার মাখায়া এনটিনি একবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন,‘বর্ণবাদ দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রীড়াঙ্গনকে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত করেছে। ক্রিকেটও হয়েছে অনেক ক্ষতিগ্রস্থ। আজ সে সমস্যার সমাধান ঘটিয়ে আমরা মিলেমিশে খেলছি। এখন আমাদের এগিয়ে যাবার পালা। জাতীয় দলে আমার স্থান পাওয়া এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় উদীয়মান কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়রা অধিক উঃসাহিত হয়ে উঠেছে। আর সে কারণে আমার দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। আমাকে যেমন আমার অবস্থান ধরে রাখতে হবে তেমনি স্বগোত্রীয় সবাইকে অনুপ্রানীত করতে হবে। অপরদিকে আমার সাফল্য তাদের মাঝে আমার একটা অবস্থান তৈরী করেছে।’ এনটিনি সাংবাদিকদের সামনে যতোই বলুক ‘আমরা এখন মিলেমিশে খেলছি’ আসলে এই ‘মিলেমিশে’ শব্দটা উচ্চারণ করা যতোটা সহজ কার্যক্ষেত্রে বাস্তবায়ন অধিক কঠিন।

দক্ষিণ আফ্রিকা দলে মাখায়া এনটিনি আজ অপরিহার্য্য এক বোলার। ১৯৯৭-৯৮ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার অভিষেক ঘটে। প্রতিপক্ষ দল ছিলো শ্রীলঙ্কা। অভিষেক টেস্টে নিউল্যান্ডসে ১৫০০০ দর্শকের সামনে বিশ্বের অন্যতম আর এক কৃষ্ণবর্ণের ব্যাটসম্যান অরবিন্দ ডি সিলভার উইকেটটি নিয়ে তার ক্যারিয়ারের যাত্রা শুরু হয়েছিলো; আজও এগিয়ে চলছেন সমান তালে। কালোদের এই প্রতিনিধি শ্বেতাঙ্গ ডোনাল্ড ও শনপোলকদের মাঝে নিজেকে মেলে ধরেছেন সার্থকভাবে। দক্ষিণ আফ্রিকার ইস্ট লন্ডনের বর্ডার প্রদেশের এই কৃষ্ণ ক্রিকেটারের আদর্শ ক্রিকেটার হচ্ছেন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান গ্রেট ম্যালকম মার্শাল। সাদাদের ডিঙ্গিয়ে আপন কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০১ সালে তিনি লাভ করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ‘ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার এবং ২০০৩ সালে ‘প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ (সিলভার)। উল্লেখ্য, ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য দু’টি আলাদা ক্রিকেট বোর্ড ছিলো। ১৯৯০ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করার পর আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছিলো, এরপর  ’৯১ সালে বোর্ড দুটি ঐক্যবদ্ধ হয়। পরবর্তীতে তারা প্রতিটি সম্প্রদায়ের তরুণ ক্রিকেটারদের নিয়ে বিশাল কর্মসূচি গ্রহণ করে। আরো উল্লেখ্য যে, বর্ণবাদের অবসান ঘটার আগে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ছিলো সম্পূর্ন শ্বেতাঙ্গদের দখলে। সে সময় জাতীয় দলে একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার হিসেবে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন ডাঃ আলী বাখার। বর্ণবাদের অবসান ঘটার পর ইফসিবিএসএ বর্ণবাদী আমলে নিগৃহিত সম্প্রদায় গুলোর জন্য ক্রিকেটের দ্বার উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই নীতি অনুয়ায়ী ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রতিটি আসরে কমপক্ষে তিনজন, জুনিয়র ক্রিকেটে কমপক্ষে দু’জন এবং জাতীয় ক্রিকেটে কমপক্ষে একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারকে নেয়া হবে। আর এমন নীতির ফলে সে দেশের ক্রিকেটে চলছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। সাদারা এখনো মনের দিক থেকে কালোদের মেনে নিতে পারছেনা। সে দেশের সাদা চামড়াধারী প্রক্তন ক্রিকেটার ক্লাইভ রাইস, রে জেনিংস, প্যাট সিমকস্ক, অ্যাড্রিয়ান কুইপার, ফ্যানি ডি ভিলিয়াস বর্ণবাদ অবসান পরবর্তী সব সিদ্ধান্তের জোর প্রতিবাদ করেছেন, আর সে প্রতিবাদের ধারা আজও অব্যাহত আছে। বর্তমানে ইংল্যান্ডে বসবাসকারী ক্লাইভ রাইস তো শ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়দের বিদ্রোহ করার আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন এই বলে,‘এই মুহূর্তে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনীতিবিদরা। ক্রিকেটারদের ঐক্যবদ্ধভাবে এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা উচিত।’ আর এই বক্তব্যের জবাবে কৃষ্ণাঙ্গ কর্মকর্তা গ্রাহাম আব্রাহাম বলেছিলেন, ‘শ্বেতাঙ্গরা এখনো ক্রিকেটকে তাদের দখলে রাখতে চায়। এরা এখনো বর্ণবাদেরই সন্তান।’ তাহলে কি দক্ষিণ আফ্রিকাও সাদা-কালোর জের ধরে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জিম্বাবুয়ের পথে ধাবিত হচ্ছে? সময়ই দেবে সে প্রশ্নের উত্তর।

আমরা আবারো ফিরে আসি বিশ্ব ক্রিকেটে কালোদের দাপটের প্রসঙ্গে, বিশ্ব ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কার কালোদের দাপট সব সময়ই ঈর্ষনীয়। লঙ্কার ব্ল্যাক টাইগাররা ১৯৯৬ সালে ৬ষ্ঠ বিশ্বকাপ জয় করে বিশ্বকে চমকে দেয়। ক্রিকেটের এই কালো মানিকরা ক্রিকেটের আর এক কুলিন বর্ণবাদদুষ্ট অস্ট্রেলিয়াকে ৭ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করে কাপ ঘরে তোলে। ফাইনালে অরবিন্দ ডি সিলভা, দলনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা ও গুরুসিনহের ব্যাটিং তান্ডবে অস্ট্রেলিয়ান বোলাররা চোখে-মুখে সর্ষে ফুল দেখেছিলো আর ফিল্ডারদের তো বল কুড়ো কুড়োতে প্যান্টই ঢিলে হয়ে গিয়েছিলো। আর এই পরাজয়টাকে কুলিনরা সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। জন্মলগ্ন থেকেই প্রবল প্রতিহিংসা পরায়ন ও বর্ণবিদ্বেষী জাতি হিসেবে পরিচিত অস্ট্রেলিয়ানরা কালো চামড়ার প্রতি অশালীন আচরণ করে আসছিলো এই পরাজয যেনো তাদের সেই বিদ্বেষকে আরো প্রবল করে তোলে। এরপর তারা রীতিমতো বেপড়োয়াভাবেই শালীনতা বিবর্জিত আচরণ শুরু করে দেয় ।

ওদিকে ইংরেজরা তো সব সময়ই নাক উচু স্বভাবের। এই উপমহাদেশে তারা পেশী শক্তিবলে দুশ’ বছর রাজত্ব করেছে, সেই সাথে চালিয়েছে নির্যাতনের স্টীমরোলার। একে একে নিপীড়িত জাতিগুলো সংগ্রাম মুখর হয়ে উঠেছে, ফিরিয়ে নিয়েছে আপন স্বাধীনতা আর লেজগুটিয়ে নিজেদের ভূ-খন্ডে ফিরতে বাধ্য হয়েছে ইংরেজরা। তবে অবস্থান বদলালেও এদের-চরিত্র পাল্টায়নি। প্রখ্যাত ভারতীয় লেখক বিনয় মুখোপাধ্যায় ‘যাযাবর’ ছদ্মনামে লিখিত তাঁর ‘দৃষ্টিপাত’ বইয়ে ইংরেজদের কু-রুচিপূর্ণ উচ্ছৃঙ্খল মানসিকতার কঠোর সমালোচনা করেছেন। তাদো অমানবিক আচার¬Ñআচরণ, মনুষ্যত্ব বিবর্জিত কার্যকলাপের বিবরণ এমনিভাবে আরো বহু লেখক-সাহিত্যিক তাদের লেখনিতে তুলে ধওেছেন। আসলেই ইংরেজদের রুচি যে কতোটা বিকৃত হতে পারে তা ইংল্যান্ড দলের সাবেক ক্যাপ্টেন অ্যালেক স্টুয়ার্ট লিখিত ‘এ ক্যাপ্টেন্স ডায়েরী’ গ্রন্থটিতে পাওয়া যায়। অ্যালেক তার বইয়ের এক স্থানে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বেশ অহঙ্কার করে লিখেছেন,‘আমি একবার শ্রীলঙ্কার একজন ক্রিকেটারকে ‘নিতম্বের ছিদ’্র বলে গালি দিয়েছি।’- এ কেমন ভাষা? ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেট আর সেই ক্রিকেটের সূতিকাগার ইংল্যান্ডের এক ভদ্র(!) অধিনায়ক স্টুয়ার্ট,Ñ এ কোন্ ধরণের ভাষা তার কন্ঠে! আর শ্রীলঙ্কান ক্যাপ্টেন রানাতুঙ্গা এর জবাবটা দিয়েছেন এভাবে, ‘আদব-কায়দা কি জিনিস তা স্টুয়ার্ট জানেন না।’ একই বছর অস্ট্রেলিয়ান বোলার শ্যেন ওয়ার্ণও আক্রমন করেন রানাতুঙ্গাকে। তিনি রানাতুঙ্গা সম্পর্কে টাইমসের একটি কলামে ‘রানাতুঙ্গা ফুরিয়ে গেছে, সে অসংযত’-ইত্যাদী বাজে মন্তব্য করেন। তার এ অশালীন মন্তব্য সম্পর্কে বেশ ঠান্ডা ভাষায় রানাতুঙ্গা জবাব দেন,‘শ্যেন যা পারে আমি তো আর তা পারি না। আসলে ওয়ার্ণের বক্তব্যের মধ্যেই  অস্ট্রেলীয় সংস্কৃতির আসল চেহারা বেরিয়ে এসেছে। আর এ কথা তো সকলেরই জানা যে, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হচ্ছে আড়াই হাজার বছরের পুরনো আর ওদেরটা তো জন্ম নিয়েছে সেদিন।’ ’৯৯-তে এই শ্যেন ওয়ার্ণ স্কটল্যান্ডে গ্যালারীর দর্শকদের দেখিয়েছিলেন হাতের মাঝের আঙ্গুলটিÑ যার অর্থ খুবই খারাপ। ক্রিকেট মাঠে এমন অসভ্যতা কার কাম্য? অবশ্য এজন্য আইসিসি তার পঞ্চাশ শতাংশ ম্যাচ ফি কেটে নিয়েছিলো এবং দু’ম্যাচ তাকে বহিস্কার করেছিলো। এমনিতেই গায়ের চামড়া সাদা বলে তাদের অহঙ্কারের শেষ নেই তার ওপর ’৯৬-এর বিশ্বকাপের ফাইনালে কলজের ওপর ছুরি চালিয়েছে লঙ্কানরা,Ñ সে যন্ত্রণা ভুলতে পারছেনা অস্ট্রেলিয়ানরা। অন্যদিকে তিন তিনবার ফাইনালে উঠেও কাপ জয়ের স্বাদ পায়নি ইংল্যান্ড, আর প্রাক্তন এ উপনিবেশ-এর কালোরা কিনা তাদের আগেই কাপ জয় করলো! এ যন্ত্রণার কথা কি আর সহজে ভোলা যায়? আর তাইতো ডেইলি টেলিগ্রাফ, গার্ডিয়ান-এর মতো বিখ্যাত ইংরেজী পত্রিকাগুলোও কালোদের পিছু ছাড়ছে না। সুযোগ পেলেই এক হাত চালানোর চেষ্টা করে। মুরালীকে তো এরা শান্তিতেই থাকতে দিচ্ছেনা।

নিজস্ব ক্রিকেটের আলোকমালায় দিলিপ মেন্ডিস, অর্জুনা রানাতুঙ্গা, অরবিন্দ ডি সিলভা, সনাৎ জয়সুরিয়া, রুমেশ কালুভিথারানা, রোশন মহানামা, মারভান আতাপাত্তু, হাসান তিলকারতেœ, চামিন্ডা ভাস, মাহেলা জয়াবর্ধনে, এরিক উপাশান্তা, প্রমোদ্য ক্রিমাসিংহে, চন্ডিকা হাথুরুসিংহে, রুয়ান কালপাগে, উপুল চন্দনা প্রমূখ অনেক প্রতিভাধর ক্রিকেটার শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটকে আলোকিত করেছেন।

ধীরে ধীরে বিশ্ব ক্রিকেটে উঠে আসছে কালোদের আর এক দেশ কেনিয়া। বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেও কেনিয়ার রয়েছে আর এক পরিচিতি। এই কেনিয়াকে ফাইনালে পরাজিত করইে ’৯৭ সালে বাংলাদেশে আসিসি শিরোপা ঘরে তোলে। বাংলাদেশের পরে আসিসি ট্রফিতে আবির্ভাব ঘটলেও কেনিয়া ক্রিকেটকে নব্বই দশকের গোড়ার দিক থেকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে। বিশেষ করে ’৯২ সালে জিম্বাবুয়ে টেস্ট স্ট্যাটার্স পাবার ফলে কেনিয়ার ক্রিকেটে আরো উৎসাহ বেড়ে যায়। ৯৬’-এর বিশ্বকাপে প্রথমবার খেলতে নেমেই তারা শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে চমক সৃস্টি করে। এরপর থেকে তারা সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। কেনিয়ার ক্রিকেটকে যেসব ক্রিকেটার আলোকিত করেছেন তারা হচ্ছেন, আসিফ করিম, স্টিভ টিকোলো, মরিস ওদুম্বে, রবীন্দু শাহ, হিতেশ মোদী, টমাস ওডোয়ো, কেনেডি ওটিয়েনো, মার্টিন সুজি, টনি সুজি, সন্দীপ গুপ্তা, মোহাম্মদ শেখ, জোসেফ আঙ্গারা প্রমূখ। এরা সকলেই ইতিমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছেন ক্রিকেটানুরাগীদের মনে।

এ্যা থ লে টি ক্স

ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের রাজা কার্ল লুইস

ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের রাজা কার্ল লুইস

বিশ্ব এ্যাথলেটিক্সে কৃষ্ণাঙ্গদের আধিপত্য একচ্ছত্র। জেসি ওয়েন্স, কার্ল লুইস, বেন জনসন, মাইক পওয়েল, মাইকেল জনসন, গেইল ডেভার্স,  ফ্লোরেন্স গ্রিফিত জয়নার, মালিন ওটি, জ্যাকি জয়নার কার্সিদের নাম কার না জানা। এই সব কালো চামড়ার দাপট বিশ্বকে শুধুই চমকৃত করেনি, সেই সাথে বিশ্ব এ্যাথলেটিক্সকে করেছে সমৃদ্ধ । বিশ্ব এ্যালেটিক্সের সব রেকর্ড আজ তাদেরই দখলে। তবে এই সাফল্যের পথে উঠে আসতে তাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। অনেক বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে কালোদের বঞ্চনার ইতিহাস আরো গভীরতরো। কিন্তু দিনে দিনে কালোরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ অবস্থান তৈরী করে সাদাদের সমীহই শুধু আদায় করেনি, তাদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের নির্ভরশীল হতে বাধ্য করেছে। কালোদের কারণেই আজ আমেরিকার মতো দেশের ক্রীড়া তাবৎ বিশ্বে প্রশংসিত। কিন্তু এক সময় সাদারা কালোদের এতোটাই অপছন্দ করতো যে, ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকে কৃষ্ণাঙ্গ এ্যাথলেট জেসি ওয়েন্স ৪টি স্বর্ণ পদক জয় করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলেও কর্মকর্তারা কেউ তাকে তাৎক্ষনিক অভিনন্দন পর্যন্ত জানাননি। একজন পশ্চিমা ঐতিহাসিকের মতে, ‘সময়টা ছিলো সম্পূর্ন কালোদের প্রতিকুলে। আর এ সময়টাতে ওয়েন্স অসাধ্য সাধন করে সাদাদের শ্রদ্ধা আদায়ে বাধ্য করেছিলেন। মাঠে উপস্থিত এক লাখ দর্শককে বিমোহিত করে ওয়েন্স ১০০মিটার দৌড় শেষ করলেন । তার বিস্ময়কর সাফল্য অনেকটা জোর করেই যেনো আদায় করে নিলো সেই এক লাখ দর্শকের করতালি।’ আমেরিকার ব্লাক প্যান্থার কার্ল লুইস তো অলিম্পিকসহ বিশ্ব এ্যাথলেটিক্সে সুবিশাল এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় তৈরী করে রেখেছেন। গেলো শতকের সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে যে এগারো জনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে তার ছয় নম্বরে আছেন কার্ল লুইস। বিশ্ব অলিম্পিকে এই কৃষ্ণাঙ্গ ৯টি স্বর্ণ জয় করেন। এর মধ্যে ৬টি জিতেছেন লং জাম্পে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপে ৮বার জয় করেছেন শিরোপা। ১০০ মিটার ¯িপ্রন্টে ১৯৯১ সালে ৯.৮৬ সেকেন্ড সময় নিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন তিনি।

ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের রাজপুত্র মাইকেল জনসন

ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের রাজপুত্র মাইকেল জনসন

বিশ্ব এ্যাথলেটিক্সের আর এক কৃষ্ণ রাজকুমার হচ্ছেন মাইকেল জনসন। যাকে ৮০০ মিটার ও ২০০ মিটারের সর্বকালে সেরা হিসেবে চিহিৃত করা হয়। বোদ্ধাদের মতে, ট্র্যাকে সব চাইতে কঠিন দৌড় হচ্ছে ৪০০ মিটার। এতে প্রয়োজন গতি, শারীরিক সামর্থ্য ও অফুরন্ত ধৈর্যের। আর মাইকেল জনসন এমন একজন দৌড়বিদ ছিলেন যিনি সবাইকে পেছনে ফেলে যখন সামনে ছুটে চলতেন তখন তার শরীরের উধ্বাংশ, পা ও বাহু রেল ইঞ্জেনের পিষ্টনের মতো ওঠানামা করতো। এ এক অপূর্ব শৈল্পিক দৃশ্য। যারা তার দৌড় দেখতেন তারা ব্যাপারটি বেশ উপভোগ করতেন। ট্র্যাকের দৌড়কে জনসন দিয়েছেন শিল্পের আদল। উনিশ শতকের প্রথম নয় দশকে কোনো দৌড়বিদই একই সঙ্গে ২০০ ও ৪০০ মিটাওে সোনা জয় করতে সক্ষম হননি। মাইকেল জনসনই প্রথম ’৯৬-এর অলিম্পিক আসরে এই দুই ইভেন্টে সোনা জয করেন। তিনি একাধারে রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়েছেন, অলিম্পিকপদকসহ নানা পদক জয় করেছেন, এমনকি টানা ৫৮ রেস জয়ের নজিরও স্থাপন করেছেন। ৪০০ মিটারে তার গড়া ৪৩.১৮ সেকেন্ড এবং ২০০ মিটারে ১৯.৩২ সেকেন্ড বিশ্বরেকর্ড দুটো আজও কারো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। উল্লেখ্য, এথেন্স অলিম্পিকে ২০০ মিটারে ১৯.৭৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে স্বর্ণ জয় করেছেন শন ক্রফোর্ড। ১৯৯৬-এর অলিম্পিকে ২০০ ও ৪০০ মিটারে স্বর্ণ, ২০০০-এর অলিম্পিকে ৪০০ ও ৪ী৪০০ মিটার রিলেতে স্বর্ণ, ’৯২-এর অলিম্পিকে ৪ী৪০০ মিটার রিলেতে স্বর্ন, ৪০০ মিটারে চারবার, ২০০ মিটারে দু’বার, ৪ী৪০০ মিটার রিলেতে তিনবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, ৯বার ইউএস আউটডোর চ্যাম্পিয়ন, আউটডোরে ২০০, ৪০০ ও ৪ী৪০০ মিটার রিলেতে ও ইনডোরে ৪০০ মিটারে বিশ্ব রেকর্ডধারী মাইকেল জনসন পেয়েছেন একবার সুলিভান এ্যাওয়ার্ড ও তিনবার জেসি ওয়েন্স এ্যাওয়ার্ড। ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড নিউজ পত্রিকা জনসনকে ৪০০ মিটারে ১০বার এবং ২০০ মিটারে ৫বার বিশ্বের এক নম্বর নির্বাচিত করেছে। জনসন বলেন, ‘সব কিছুরই একটা ধারা আছে। যদি আপনি ২০০মিটার দৌড়ান তবে আপনি ১০০মিটারও পারবেন। আর যদি আপনি ৪০০মিটার দৌড়ান তবে আপনি সবগুলোতেই পারবেন।’

ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের রাজকন্যা গ্রিফিত জয়নার

ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের রাজকন্যা গ্রিফিত জয়নার

আমেরিকার কালোকন্যা, জগত আলো করা নাম ফ্লোরেন্স গ্রিফিত জয়নার। ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে জয়নার ছিলেন আকর্ষনীয় এক চরিত্র। ১৯৮৮ সালে সিউল অলিম্পিকে ১০০মিটার স্প্রিন্টে ১০.৪৯ সেকেন্ড নিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েন। আজো যে রেকর্ড অক্ষুন্ন। এছাড়া সিউল অলিম্পিকে একই দিনে দু’টি বিশ্ব রেকর্ড গড়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন। ২০০মিটারের সেমিফাইনালে ২১.৫৬ সেকেন্ড এবং ফাইনালে ২১.৩৪ সেকেন্ড সময় নিয়ে তিনি এ বিশ্ব রেকর্ড দু’টি করেন। সিউলে জয়নার জয় করেন ৩টি স্বর্ণ ও একটি রৌপ্য পদক। হরিণের গতি সম্পন্ন এই কৃষ্ণকন্যাকে বলা হয় সিউল অলিম্পিকের কুইন। তবে কালো চামড়া বলে এই কুইনকে নিয়েও কম ষড়যন্ত্র হয়নি। অযথা হেনস্থা করা হয়েছে তাকে অনেকবার। ১১বার তার ডোপ টেস্ট করা হয়েছে, কিন্তু একবারো পজেটিভ হয়নি। আর ডোপ সংক্রান্ত হেনস্থা-হয়রানী ও অভিযোগের প্রেক্ষিতে ১৯৮৮ সালে সেরা মার্কিন এ্যাথলেট হিসেবে সুলিভান পুরস্কার পাওয়া সত্ত্বেও অভিমান করে ১৯৮৯ সালে এই ট্র্যাকের রানী ট্র্যাক থেকে বিদায় নেন । এর নয় বছর পর লস এ্যাঞ্জেলসের শহরতলীতে নিজ বাসভবনে হৃদ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে জীবনের ট্র্যাক থেকেও বিদায় নেন এই ভুবনজয়ী কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীড়াবিদ।

অপ্রতিরোধ্য গেইল ডেভার্স

অপ্রতিরোধ্য গেইল ডেভার্স

মহিলাদের ১০০মিটার  স্প্রিন্টে এক অবিস্মরনীয় রেকর্ডের অধিকারী হচ্ছেন আর এক কৃষ্ণকন্যা গেইল ডেভার্স। আজীবন কঠিন সংগ্রামী এই কালো মেয়েটি ১৯৯২ সালে বার্সেলোনা অলিম্পিক গেমস এবং ১৯৯৬ সালে আটলান্টা অলিম্পক গেমসে উপর্যুপরি দু’বার সোনা জিতে গোটা দুনিয়াকে চমকে দেন এবং অবিস্মরনীয় এক রেকর্ডের অধিকারী হন। এ ছাড়া ১৯৯৩ সালে জার্মানীর স্টুটগার্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্ব এ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশীপের ১০০ মিটার  স্প্রিন্ট ও ১০০ মিটার হার্ডলসে তিনি সোনা জয় করেন। আটলান্টা অলিম্পিকে ৪০০ মিটার রিলেতে সোনা জয়ী দলের সদস্যও ছিলেন তিনি । যদিও ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিক ও ২০০৪ সালের এথেন্স অলিম্পিকে অংশ নিযে তেমন সফল হতে পারেননি, তবে ৩৭ বছর বয়সেও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতা কররা সামর্থ্য ক’জন নারীর থাকে। উল্লেখ্য, ১৯৯২ সালে এ্যাথলেটিক্স ট্র্যাকে সাফল্য প্রদর্শনের আগে দু’বছর ডেভার্সকে লড়তে হয়েছে কঠিন ব্যাধির সাথে। ১৯৯০-৯১-এ জীবন আর মৃত্যুর মাঝামাঝি পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। এ সময়টাতে তাকে হুইল চেয়ার পর্যন্ত ব্যবহার করতে হয়েছিলো। কিন্তু প্রবল ইচ্ছা শক্তির বলে রোগ-ব্যাধিকে জয় করে তিনি ট্র্যাকে ফিরে আসেন এবং রানীর আসন দখল করেন পরপর দু’টি অলিম্পিকে।

এবার আসা যাক হেপ্টাথেলনের ব্লাক কুইনের কথায়। এই রানীর নাম জ্যাকি জয়নার কার্সি। হেপ্টাথেলন হচ্ছে একটি অলরাউন্ডিং ইভেন্ট। এ ইভেন্টের মধ্যে আছে ১০০ মিটার হার্ডলস, ২০০ মিটার ও ৮০০ মিটার দৌড়, হাই জাম্প, লংজাম্প, জ্যাভলিন ও শটপুট। আর এই অলরাউন্ডিং ইভেন্টে বিস্ময়কর কৃতিত্ব প্রদর্শন করে রানীর আসনটি দখল করে নিয়েছেন। এখনো তার নামেই যেনো ধ্বনিত হয় সাহস আর সংকল্প। ময়দানে লড়াইয়ের সাথে সাথে তিনি লড়েছেন দুরারোগ্য ব্যাধি হাঁপানী আর বহু ইনজুরির সাথে। কিন্তু রোগকে পরাস্ত করে, ইনজুরিকে পরাভূত করে প্রতিদ্বন্দ্বীদের ধরাশায়ী করে এই ব্লাক ডায়মন্ড রচনা করেছেন এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।

এই অসামান্য প্রতিভাধর এ্যাথলেট হেপ্টাথেলনে ’৮৪-এর অলিম্পিকে  জয় করেন রৌপ্য। এরপর ’৮৮ ও ’৯২-এর অলিম্পিকে জয় করেন সোনা। ’৯৩ ও ৯৭-এর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন শীপেও তিনি সোনা জয় করেন। ইউএস খেতাব জয় করেছেন ’৮২,’৮৭,’৯১,’৯৩ ও ’৯৫ সালে। ’৮৬ থেকে ’৮৮ পর্যন্ত চারবার গড়েছেন বিশ্বরেকর্ড। ৭২৯১ পয়েন্ট নিয়ে আজও তিনি অম্লান এক রেকর্ডের অধিকারী হয়ে আছেন। এই কৃষ্ণকন্যা লংজাম্পেও ছিলেন সমান পারদর্শী। ’৮৮-এর অলিম্পিকে এই ইভেন্টে তিনি জয় করেছেন স্বর্ণ। ’৯২ ও ’৯৬-এর অলিম্পিকে জয় করেছেন ব্রোঞ্জ। ’৮৭ ও ’৯১-এর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপে জয় করেছেন স্বর্ণ। ’৮৭,’৯০ ও ’৯৬ সালে জয় করেছেন ইউএস  খেতাব। ক্রীড়াক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখার জন্য তিনি নানাভাবে সন্মানিত হয়েছেন। ১৯৮৬ সালে লাভ করেছেন ‘সুলিভান এ্যাওয়ার্ড’, ১৯৮৮ সালে ‘জেসি ওয়েন্স এ্যাওয়ার্ড’। এ ছাড়া ১৯৯৯ সালে নির্বাচিত হয়েছেন ‘শতাব্দীর সেরা মহিলা এ্যাথলেট।’ কার্সি ছিলেন একজন আদর্শ ও বিনয়ী এ্যাথলেট। এই কৃষ্ণবর্ণ নারী যে শুধু সোনার মেডেল আর রেকর্ডগুলোর জন্যই স্মরণীয় হয়ে আছেন তা নয়। হাঁপানী ও ইনজুরির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার বলিষ্ঠ অধ্যায়টি আজও তাবৎ বিশ্বের ক্রীড়াবিদদের মনে টনিকের কাজ করে। কার্সি বলতেনÑ‘আসলে মানুষের অসাধ্য কিছু নেই, শুধু থাকতে হবে প্রবল ইচ্ছে শক্তি, কঠোর সাধনা, আর অতীতকে মনে করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা।’ তার ভাষায়,‘আমি কখনো ভুলে যাইনি যে, কোথা থেকে আমি এসেছি। একটা ছোট্র মেয়ে হিসেবে আমি আমার চারপাশটাকে দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। অনেক লাঞ্চনা-বঞ্চনাই আমার মনে উচ্চ স্বপ্নের জন্ম দিয়েছে আর আমি পরবর্তীতে প্রানান্ত চেষ্টা করেছি সেই স্বপ্ন পূরণের। এবং একদিন একের পর এক বাধা অতিক্রম করে আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।’ এই কথাগুলোতে কালো নারী কার্সির বর্ণÑবৈষম্যের যাতাকলে পড়ার দীর্ঘশ্বাসও কি পাওয়া যায়না? কার্সি আরো বলতেন,‘আমি সব সময় মানুষের মনে সাহস যোগাতে চাই যেনো তারা নিজের জীবনটাকে আমূল বদলে ফেলতে পারে। তবে আমি তাদের এ কথাটাও বলি যে, আমার পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন না, নিজের পথেই চলুন।’

জ্যামাইকার মার্লিন ওটিকে বলা হয় বলা হয় অ্যাথলেটিক্স ট্র্যাকের ‘কৃষ্ণ সুন্দরী’। সাজ-সজ্জার বাতিকের কারণে আকর্ষনীয় ফ্যাশন গার্ল হিসেবেও তার একটা পরিচিতি ওয়েছে। কালো হলেও তার অপরূপ সৌান্দর্য মুগ্ধ কওে সকলকে। ওটি সব সময়ই সৌন্দর্য সচেতন। ট্র্যাকে নামার আগেও দীর্ঘক্ষণ তিনি তার সাজ-সজ্জা নিযে ব্যস্ত থাকেন তারপর মাঠে নামেন। ট্র্যাকে এই কৃষ্ন সুন্দরী বিস্ময়কর কিছু না করতে পারলেও সব মিলিয়ে সফল বটে।

সিউল অলিম্পিক গেমস ১৯৮৮। আসরের সেরা ইভেন্ট একশ’ মিটার দৌড়ে সকল প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে স্বর্ণপদক জয় করলেন কানাডার কালো চিতা বেন জনসন। তবে এই স্বর্ণপদক বেন জনসনের গলায় ঝুলতে না ঝুলতেই অলিম্পিক কর্তৃপক্ষ তা কেড়ে নিলো ও ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সকল প্রতিযোগিতা থেকে তাকে বহিস্কার করা হলো। বেনের অপরাধ হচ্ছে সে নিষিদ্ধ ড্রাগ গ্রহণ করে দৌড়ে অংশ নিয়েছিলো। তার মূত্রের সঙ্গে পাওয়া যায় স্টেরয়েড। ক্রীড়া আইনে প্রতিযোগিতায় এ জাতীয় ড্রাগ গ্রহণ একটি শাস্তিযোগ্য জঘন্য অপরাধ। সে আসরে বেনের স্বর্ণ পদকটি কেড়ে নিয়ে আর এক কালো মানিক এবং দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী কার্ল লুইসের গলায় ঝুলিয়ে দেন অলিম্পিক কর্তৃপক্ষ। বহিস্কারের খড়গ এ্যাথলেট বেনের জীবনাবসান ঘটালেও সে যে বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী ছিলো এ কথা বোদ্ধামহল একবাক্যে স্বীকার করে থাকে।

অলিম্পিক গেমসে একশ’ মিটার ¯িপ্রন্টকে বলা হয় ইভেন্টের রাজা।  আবার অন্যভাবে বলা যায়, একশ’ মিটার হচ্ছে অলিম্পিকের সবচেয়ে হিট, হট, গ্ল্যামারার্স এন্ড ইমপটেন্ট ইভেন্ট। আবার কেউ কেউ একে হার্টথ্রুব ইভেন্টও বলে থাকেন। অনেক ক্রীড়ানুরাগী বলে থাকেন, একশ’ মিটার ¯িপ্রন্ট শেষ হয়ে যাবার পর অলিম্পিকের আকর্ষণ তেমন আর থাকেনা। কাজেই এই ইভেন্টটিকে ঘিরেই থাকে যতো উত্তাপ আর উত্তেজনা। আসলে এ হচ্ছে ট্র্যাকে মাত্র দশ এগারো সেকেন্ডের এক প্রলয়ঙ্কারী তান্ডব। দীর্ঘ উত্তেজনা, আবেগ, উচ্ছ্বাস মুহুর্তের মধ্যে শেষ হয়ে আনন্দ-বেদনার ঢেউ আছড়ে পড়ে স্টেডিয়ামে।  আর এই আনন্দটা সব সময় করে আসছে কালোরা। ইভেন্ট রাজের মুকুটটি সব সময়ই শোভা পেয়ে আসছে তাদের মাথায়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মরণপণ লড়ায়ের এই ইভেন্টে কালো সন্তানদের কল্যানেই যুক্তরাষ্ট্র অলিম্পিকে একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করে আসছে যুগের পর যুগ।

এথেন্স অলিম্পিক ২০০৪-এও এ ধারা রয়েছে অক্ষুন্ন। ইতিহাসের সেরা ¯িপ্রন্ট জিতে গোটা দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন যে ব্লাক প্যান্থার তিনি হচ্ছেন মার্কিনীদের নতুন কালো মানিক জাস্টিন গ্যাটলিন। এথন্সে একশ’ মিটার দূরত্ব পার হতে সময় নিয়েছেন ৯.৮৫ সেকেন্ড। তবে ইতিহাসের সব চাইতে তীব্র এ লড়াইয়ে আর যারা গ্যাটলিনের পেছনে ছিলেন তারা সকলেই কালো চামড়ার অধিকারী। ৯.৮৬ সেকেন্ড সময় নিয়ে রূপা জয় করেন পর্তুগালের ওবিকওয়েলু, ৯.৮৭ সেকেন্ড সময় নিয়ে ব্রোঞ্জ বিজয়ী আমেরিকার মরিস গ্রিন ছাড়াও জ্যামাইকার আসাফা পাওয়েল, আমেরিকার ক্রুফোর্ড, কলিন পাওয়েল, বার্বাডোজের ওবাডেলে টমসনÑ, মোট কথা একশ’ মিটার ¯িপ্রন্টের চূড়ান্ত রাউন্ডে অংশ নেয়া সকলেই কালো।  আবার ২০০ মিটার ¯িপ্রন্টে  প্রথম থেকে তৃতীয় সব ক’টি পদক উঠেছে আমেরিকানদের ঘরে তাদের কালো সন্তানদের কৃতিত্বে। ১৯.৭৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে সোনা জিতেচেন শন ক্রফোর্ড, ২০.০১ সেকেন্ড সময় নিয়ে রূপা জিতেছেন বার্নাড উইলিয়ামস, আর ২০.০৩ সেকেন্ড সময় নিয়ে ব্রোঞ্জ জিতেছেন জাস্টিন গ্যাটলিন। ৪০০ মিটারেও আমেরিকার কালোদের ছিলো একচ্ছত্র আধিপত্য। যদিও মেয়েদের একশ’ মিটার ¯িপ্রন্টে আমেরিকার কালো মেয়েদের টানা বিশ বছরের আধিপত্য খর্ব করেছেন বেলারুশের সাদা মেয়ে ইউলিয়া নেস্টেরেঙ্কো তবে এবারের অলিম্পিকেও কালো মেয়েদের সাফল্য কম ছিলো না। আসলে অ্যাথলেটিক্স মানেই কালোদের জয়জয়কার। অলিম্পিক গেমস মানেই কালোদের সাফল্যে উদ্ভাসিত ক্রীড়া উৎসব। অলিম্পিকের মতো বিশাল আসরের এই সব সফল ক্রীড়াবিদদের নাম এই স্বল্প পরিসরে তুলে আনা অসম্ভব। তবে একটি কথা বরাবরের মতোই বলা যায়, প্রতিটি অলিম্পিকের মতো এথেন্স অলিম্পিকও ছিলো কালোদের আলোয় আলোকিত। সফল সাদাদেও আমেরিকা এবারের আসরেও যে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে তার বেশীরভাগ এসেছে কালো ক্রীড়াবিদদের কল্যানে।

বা স্কে ট ব ল

ম্যাজিক জনসন

ম্যাজিক জনসন

ঐতিহাসিকদের মতে, কৃষ্ণাঙ্গ এবং বাস্কেট বল- যেনো একে অপরের জন্য তৈরী হয়েছে। একে অপরকে করেছে আলোকিত। বাস্কেট বল কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো যে, ১৯১১ সালের দিকে সব হাই স্কুলেই বাস্কেট বল টিম গঠন করা হয়েছিলো। এবং এ সব দলের মধ্যে জমজমাট প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। ১৯৫১ সালে কৃষ্ণাঙ্গরাই প্রথম জাতীয়ভিত্তিক দল গঠন করে। কৃষ্ণাঙ্গ আবদুল করিম জব্বার, ইরাভিন জনসন, মাইকেল জর্ডানের মতো বাস্কেট বল তারকারা আপন নৈপুণ্যে বিশ্বকে শুধু বিমোহিতই করেননি, এ খেলার মাধ্যমে তারা অর্থ বিত্ত জনপ্রিয়তা সবই করায়ত্ত করেছেন। অবাক করা ব্যাপার ফুটবলার, ক্রিকেটারর সবাইকে পেছনে ফেলে পৃথিবীর সব চাইতে দামী তারকাতে পরিনত হয়েছেন এদের অনেকেই । ধরা যাক মাইকেল জর্ডানের কথাই, বিশ্লেষকদের মতে, জর্ডানের কারণেই এনবিএ বাস্কেট বল লীগের জনপ্রিয়তা আমেরিকার সীমানা ছাড়িয়ে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিলো। জর্ডানের অদম্য মনোভাব, মনের জোর, চারিত্রিক দৃঢ়তা সব কিছুই তাকে শীর্ষ তারকা বানিয়েছে। পরিনত করেছে জীবন্ত কিংবদন্তীতে। জর্ডান ছিলেন পৃথিবীর সব চাইতে দামী খেলোয়াড়। যার আয়ের পরিমান ছিলো ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রয়েছে ক্লাব প্রদত্ত পারিশ্রমিক, স্পন্সর, টিভি সত্বের অর্থ  ইত্যাদি। ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা এই কৃষ্ণাঙ্গ সুপার স্টার তার ১৪ বছরের ক্যারিয়ারে ৯৩০টি ম্যাচে স্কোর করেছেন ২৯,২৭৭ পয়েন্ট। এই জগতজয়ী তারকা ১৯৯৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাস্কেট বল থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পৃথিবীর অন্য সকল খেলোয়াড়কে টপকে জর্ডান তিনটি ক্ষেত্রে ছিলেন শীর্ষস্থানে, ১. খেলোয়ড়ী জীবনে সব সময়ই ছিলেন স্পট লাইটে, ২. নামের যশের ক্ষেত্রে সব সময়ই ছিলেন শীর্ষে, ৩. সব চাইতে বিত্তবান খেরোয়াড়। বিশ শতকের সেরা ক্রীড়াবিদ হিেেসবে যে এগারো জনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে তার পাঁচ নম্বরে আছেন জর্ডান।

মাইকেল জর্ডন

মাইকেল জর্ডন

বিশ্ব বাস্কেটবলের আর এক নামী-দামী কৃষ্ণাঙ্গ সুপারস্টার হচ্ছেন ম্যাজিক জনসন। ছ’ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতার এই বাস্কেটবল তারকা ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের অহঙ্কার। তার ‘ম্যাজিক’ সমৃদ্ধ নৈপুণ্যর কারণেই আমেরিকানদের ঘরে উঠেছে বিশ্ব শিরোপাসহ অনেক সাফল্য। আপন নৈপুণ্যের কারণে খুব অল্প সময়েই এই সুপারস্টার পরিনত হন বিশ্বের অন্যতম দামী খেলোয়াড়ে। অর্জন করেন বিস্ময়কর জনপ্রিয়তা। বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়ে যান তিনি। কিন্তু সাফল্যের শিখরে উঠে অত্যাধিক নারী সঙ্গের কারণে এই বরেণ্য ক্রীড়াবিদ এইডসে আক্রান্ত হন এবং অশালে তার ক্যারিয়ারে ধ্বস নামে।

আজও বিশ্ব বাস্কেট বলে সেরা অলঙ্কার হিসেবে শোভাবদ্ধন করছেন কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়রা। বলা যায় বাস্কেটবল খেলাটি তাদের দখলেই।

বে স ব ল

জ্যাকি রবিনসন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ যিনি ব্র“কলিন ডারস ক্লাবে যোগদানের মাধ্যমে প্রথম বিভাগ বেসবল খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তবে কালোদের বেসবল খেলার ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৯০৫ সালে নিউইয়র্কের অ্যারগাইল হোটেলের প্রধান পরিচারিকা ফ্রাঙ্ক ম্পসন তার ক’জন সহযোগী পরিচারিকাকে নিয়ে প্রথম নিগ্রো বেসবল টিম গঠন করেছিলেন। শ্বেতাঙ্গদের রক্তচোখের মুখে সে সময় এ ধরণের দল গঠন করা নিগ্রোদের জন্য ছিলো বিরাট চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। তাই তারা নিগ্রো পরিচয় আড়াল করে নিজেদের কিউবান বলে পরিচয় দিতো। এ কারণে তারা আফ্রিকী ভাষার বদলে স্প্যানিশ ভাষা রপ্ত করতো। ১৯২০ সালে চার্লিগ্রান্ট নামের একজন কৃষ্ণাঙ্গ বেসবল খেলোয়াড়  নিগ্রো পরিচয় ঢেকে নিজেকে ইন্ডিয়ান পরিচয় দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে খুব বেশীদিন কৃষ্ণাঙ্গদের বঞ্চিত থাকতে হয়নি। ১৯৬২ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিনিধি জ্যাকি রবিনসন বেসবল হল অব ফেম নির্বাচনে জয়ী হলে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিকুল পরিস্থিতি অনেকটা কেটে যায়। কৃষ্ণাঙ্গরা ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বেসবলে একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করেছিলো। তারা ন্যাশনাল লীগে ১১ বারের মধ্যে ৭ বার চ্যাম্পিয়ন হয়।

ঘো ড় দৌ ড়

ঘোড়দৌড় খেলাটি যেনো কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য সংরক্ষিতই ছিলো। এ খেলায় কালোদের যেনো কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো না। ১৮৭৫ সালে যখন প্রথম ক্যানটাকি ডারবি দৌড় অনুষ্টিত হয় তখন যে ১৪/১৫ জন খেলোয়াড় এতে অংশ নিয়েছিলো তাদের সকলেই ছিলো কৃষ্ণ। অবশ্য এর কারণও ছিলো, সে সময় কালোদের ব্যাপকভাবে আস্তাবলের কাজ-কর্মে নিয়োগ করা হতো। উনিশ শতকের প্রথম দিকে অবশ্য এদের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ১৯১১ সালের ক্যানটাকি ডারবি দৌড়ে  জেস কনলে ছিলেন একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়। উপনিবেশ আমলের অবসানের পর কালোদের ওপর ন্যস্ত আস্তাবলের কাজ-কর্মও হ্রাস পেতে থাকে। ঘোড়দৌড়ে কালোদের সংখ্যা কমতে থাকলেও যে কোনো প্রতিযোগিতায় যে ক’জন প্রতিযোগী অংশ নিতেন তারা বীরত্বের সাথেই কালোদের বিজয় ঝান্ডা তুলে ধরতেন। তবে কালোদের পক্ষে ইতিহাসের সব থেকে বড় কৃতিত্ব দেখান বর ম্যাককারডি। ১৯৬৩ সালে তিনি একশ’ সওয়ারকে পরাজিত করে বিস্ময়কর এক বিজয় অর্জন করেন। যা ঘোড়দৌড় ইতিহাসে কালোদের অবিস্মরণীয় অধ্যায়।

গ ল ফ

গলফের রাজা টাইগার উডস

গলফের রাজা টাইগার উডস

শুরুতে গলফ খেলাটি ছিলো কৃষ্ণাঙ্গদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। সে সময় এ খেলাটি শুধুমাত্র সাহেবদের খেলা হিসেবেই চিহিৃত ছিলো। কালোরা এর ধারে-কাছেও ঘেঁষতে পারতো না। অধিকাংশ গলফ ক্লাব ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ন্ত্রিত হতো বলে সেখানে শুধু মাত্র বিত্তশালীদেরই প্রবেশাধিকার ছিলো। গলফে কালোদের বঞ্চনার এ ধারা চলে অনেকদিন। ধীরে ধীরে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য গড়ে ওঠে দু’একটি ক্লাব। চার্লি সিফোর্ড ছিলেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ গলফ খেলোয়াড় যিনি পেশাজীবী গলফ খেলোয়াড়দের সমিতিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং ১৯৫৭ সালে ‘লং বীচ ওপেন’ জয়লাভ করে গলফ ওয়ার্ল্ডে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। এ ছাড়া এ খেলায় লি এল্ডার, পিট ব্রাইন আপন নৈপুণ্য গুণে কালোদের মর্যাদাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। আজকের দুনিয়ায় কালো চামড়ার টাইগার উড তো শীর্ষ খ্যাতি অর্জনকারী খেলোয়াড়। গলফ জগতে টাইগার উড মানেই এক বিস্ময়কর প্রতিভা। শুধু তাই নয় বিশ্ব ক্রীড়ার সব চাইতে দামী খেলোয়াড়ের মর্যাদাও তার দখলে। বিশ্বের সব চাইতে দামী ফুটবলার হচ্ছেন ডেভিড বেকহ্যামকে। বছরে তার আয় ১৮ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু শুনলে অবাক হবেন, টাইগার উডের আয়-রোজগারের কাছে ডেভিড বেকহ্যাম একেবারে ভিখেরীতুল্য। ২০০৪ সালের প্রথম দিকে ফোর্বস ম্যাগাজিন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী যে দশজন খেলোয়াড়ের নাম প্রকাশ করেছে তাতে স্থান পাননি বেকহ্যাম। অপরদিকে টাইগার উড রয়েছেন শীর্ষে। আয়-রোজগারে বিশ্বের এক নম্বর এই কৃষ্ণ গলফারের বাৎসরিক আয় দেখানো হয়েছে বছরে ৬৯ মিলিয়ন ডলার।

টে নি স

আর্থার অ্যাস

আর্থার অ্যাস

এক সময় টেনিসও ছিলো কালোদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।  সাদারা কালোদের টেনিস কোর্টের আশেপাশেই ভিড়তে দিতো না। এমনকি দর্শক হিসেবেও কালোরা ছিলো নিষিদ্ধ। ১৯৫১ সালের কথা। বিশ্ব টেনিসে কালোদের এক অভূতপূর্ব বিজয় অর্জিত হলো। বিশ্ব টেনিসের সেরা আসর উইম্বলডনে খেললেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অ্যালথিয়া গিবসন। এরপর তিনি ১৯৫৭ সালে তাবৎ বিশ্বকে চমকে দিলেন, জয় করলেন একই সাথে উইম্বলডনের সিঙ্গেলস এবং ডাবলস। বিশ্ব টেনিসে কৃষ্ণাঙ্গ আর্থার এ্যাসের নামটি চির স্মরনীয় হয়ে আছে। কালজয়ী এই কৃষ্ণাঙ্গ টেনিস খেলোয়াড় আজও টেনিসপ্রেমীদের হৃদয় জুড়ে আছেন।। তিনি উইম্বলডন, ইউএস ওপেন, অষ্ট্রেলিয়ান ওপেনসহ বিশ্বের সব ক’টি বড় টুর্নামেন্টের শিরোপাই শুধু জিতে নেননি, সেই সাথে ইউএস ডেভিসকাপ দলের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।

আশির দশক থেকে বিশ্ব টেনিসে কালোদের প্রভাব দারুণভাবে বেড়ে যেতে থাকে। ইয়ানিক নুহ, চিপ হুপার, লরি ম্যাকনিল, জিনা গ্যারিসন, মার্টিন ক্লাবম্যান, কে এ্যাডামস প্রমুখ টেনিস তারকারা বিভিন্ন সময়ে কৃষ্ণাঙ্গদের ঝান্ডা তুলে ধরেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব টেনিসে ঝড় তোলা দুই কৃষ্ণকলি হচ্ছেন উইলিয়ামস ভগ্নিদ্বয়। বিশ্ব টেনিসে সেরেনা উইলিয়ামস ও ভেনাস উইলিয়ামসের আলো টেনিসপ্রেমিদের চমকৃত করেছে। উইম্বলডন ২০০২-এর আসরে এক শতাব্দী পর একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখলো বিশ্ববাসী। ফাইনালে মুখোমুখি হলো দুইবোন ভেনাস ও সেরনা উইলিয়ামস। ১১৮ বছর আগে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিলো সেবার উইম্বলডনের ফাইনালে প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হয়েছিরেন দুই বোন মাউড ওয়াটসন ও লিরিয়ান। ২০০০ সালে এই দই বোনের দখলেই ছিলো টেনিস অঙ্গন।

সেরেনা উইলিয়ামস

সেরেনা উইলিয়ামস

এ কথা তো বলা যায় যে, বিশ্বে এমন কোনো খেলা নেই যাতে কৃষ্ণাঙ্গদের আধিপত্য নেই বা ছিলোনা। তবে অপ্রিয় হলেও সত্যি যে অন্য আলোকে আলোকিত কৃষ্ণাঙ্গদের কেউ কেউ শীর্ষস্থানে অবস্থান করে কালোদের জাতীয় জীবনে কালিমাও লেপন করেছেন। এদের মধ্যে মাইক টাইসন অন্যতম। পেলের মতো বিশ্ববরেণ্য তারকারও রয়েছে নারী কেলেঙ্কারীর বদনাম। আর আর্থার এ্যাশ তো এইডসেই মারা গেলেন। ম্যাজিক জনসন আক্রান্ত হযেছেন এইডসে। বিশ্ব ক্রিকেটের রাজকুমার লারার নারীঘটিত বদনামও কম নেই। পোশাক বদলানোর মতোই নাকি লারা নারী বদলান। শোনা গিয়েছিলো অতিরিক্ত নারীসঙ্গের কারণেই লারা কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। বঞ্চনা, অভাব, দারিদ্রপূর্ণ জীবন থেকে উঠে আসা কৃষ্ণাঙ্গদের কেউ কেউ বিপুল অর্থ-খ্যাতি আর যশের সন্ধান পেয়ে বিগড়ে যান। আর এদের দ্বারাই কিছু কালিমা ছড়িয়ে পড়ে কালোদের শরীরে, কিন্তু তা সুবিশাল আলোর সমুদ্রে এক ফোটা কলঙ্কের মাত্র।

এ জাতীয় লেখার কাজ বেশ কষ্টসাধ্য। পত্রিকা, পুস্তক, ইন্টারনেট বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে দীর্ঘ সময় ও পরিশ্রমে কার্পন্যহীনভাবে তুলে আনা যথাসম্ভব নির্ভূল তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে লেখাটিতে। সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরও যদি কোথাও কোনো ত্রুটি ঘাপটি মেরে বসে থাকে; তবে বিজ্ঞ পাঠক,  খোঁচা মেরে ত্রুটিটাকে ঘায়েল করতে চেস্টা করবেন আশা করি।

দৈনিক ইত্তেফাকের গোলটেবিল বৈঠক ‘ঢাকা মহানগরীতে শিক্ষার পরিবেশ’

এই নগরী, দৈনিক ইত্তেফাক-ক্যামব্রিয়ান কলেজ, বিএসবি গোলটেবিল বৈঠক

গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেয়া আলোচকবৃন্দ

গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেয়া আলোচকবৃন্

১ এপ্রিল, ২০০৮  গুলশানের অভিজাত রেস্টুরেন্ট স্টেক হাউজে  ইত্তেফাক-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আরশাদ হোসেনের উদ্যোগে দৈনিক ইত্তেফাক-এর সাপ্তাহিক আয়োজন ‘এই নগরী’ ও ক্যামব্রিয়ান কলেজ, বিএসবি-যৌথভাবে আয়োজন করে “ঢাকা মহানগরীতে শিক্ষার পরিবেশ” শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক। এ গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও শিল্পী। এতে সভাপতিত্ব করেন দৈনিক ইত্তেফাকের এই নগরী বিভাগের বিভাগীয় সম্পাদক মাহাবুবুল হাসান নীরু। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ এম এম শফিউল্লাহ। বৈঠকের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিএসবি ফাউন্ডেশন ও ক্যামব্রিয়ান কলেজের চেয়ারম্যান এম কে বাশার। বৈঠকের সঞ্চালক ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. করুণাময় গোস্বামী।  অন্যান্য বক্তারা হলেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. রোখসানা হাফিজ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য অধ্যাপক তাজুল ইসলাম, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ময়েজউদ্দিন আহমেদ, কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলন, উপস্থাপক আবদুন নূর তুষার,  কন্ঠশিল্পী মেহরীন,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. এ কিউ এম মাহবুব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার বজলুল হক, ইবাইস ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. জাকারিয়া লিংকন, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের স্থাপত্য বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আবু সাঈদ, অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. কবীর হোসেন তালুকদার, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, ঢাকা ইম্পেরিয়াল কলেজের অধ্যাপক মাহফুজুল হক শাহীন ও গ্রীন ইউনিভার্সিটির ভাইস চেয়ারম্যান ড. মকবুল আহমেদ । নিচে তাঁদের উপস্থাপিত বক্তব্য সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-

niru[1]

মাহাবুবুল হাসান নীরু

সভাপতি ॥ বিভাগীয় সম্পাদক, এই নগরী,  দৈনিক ইত্তেফাক

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, আর যে জাতি তার মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না; সে জাতি কোনো ক্ষেত্রেই রাখতে পারে না সাফল্যের স্বাক্ষর। অপরদিকে ঢাকা হচ্ছে বাংলাদেশের রাজধানী। কেউ কেউ বলে থাকেন, ‘মেগাসিটি’। আসলেই কি তাই? প্রশ্নটা থেকেই যায়। কেননা একটি রাজধানী শহর বা মেগাসিটির যে সকল গুণগত মান থাকা অপরিহার্য, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, ঢাকার তার কোনোটিই নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে একসময় শিক্ষাক্ষেত্রে এই শহরটির ব্যাপক সুনাম সুবিস্তৃত ছিলো। আজ তার কতটুকু অবশিষ্ট আছে? বর্তমান ঢাকার সার্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি শিক্ষার জন্য কতটুকু সহায়ক? রাজধানী হিসেবে ঢাকা জাতির মেরুদণ্ডকে সোজা রাখতে কতটুকু ভূমিকা পালন করতে পারছে? ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার মান কেমন? তা কি সন্তোষজনক? এমনি অনেক প্রশ্নকে সামনে রেখে এদেশের ঐতিহ্যবাহী ও সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাকের সাপ্তাহিক আয়োজন ‘এই নগরী’ ও স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “বিএসবি ফাউন্ডেশন এন্ড ক্যামব্রিয়ান কলেজ” যৌথভাবে “ঢাকা মহানগরীতে শিক্ষার পরিবেশ” শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছে। আজ এ বৈঠকে উপস্থিত আছেন দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, পরিবেশবিদ এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বগণ। আমরা তাদের কাছে শুনবো আমাদের আজকের বিষয়টি সম্পর্কে মূল্যবান মতামত। আশা করি, তাদের এ মতামতের মধ্য দিয়ে মিলবে নগরের শিক্ষার পরিবেশের উন্নয়ন, উত্তরণের প্রকৃত পথ। আমার বিশ্বাস, এ গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনা থেকে উঠে আসবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা। আমি বৈঠকের কার্যক্রম শুরু করার জন্য শিক্ষাবিদ ও গবেষক করুণাময় গোস্বামীকে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।

korunamoy[1]

ড. করুণাময় গোস্বামী

সঞ্চালক  ॥  বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ

ধন্যবাদ আজকের সভার স্নেহভাজন সভাপতি নীরুকে, সে সাথে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি আজকের বৈঠকে উপস্থিত অতিথিদের। এবার আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে এ গোলটেবিল বৈঠক শুরু করতে পারি। ‘গোলটেবিল বৈঠক’ কথাটা আমরা বলে থাকি, কিন্তু সব গোলটেবিল বৈঠকের টেবিলের আকার গোল হয় না। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলি, কিছুদিন আগে প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত হয়ে বাংলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক মনসুর মূসা টেবিলের আকৃতি দেখে বৈঠকে বসতে অস্বীকৃতি জানালেন, তিনি বললেন, এ টেবিলের আকৃতি গোল নয়, আগে টেবিলের আকৃতি গোল করা হোক তবেই আমি বসবো। এ সময় আমি তাকে বললাম, ‘গোলটেবিল’ এটা একটা পরিভাষা। গোলটেবিলটা এখন পারিভাষিক হয়ে গেছে। আসলে এটার আয়োজন হয়ে থাকে মতবিনিময়ের জন্যে। শুরুতে এ মতবিনিময় সভার টেবিলের আকৃতি গোলই ছিলো, কিন্তু নানা কারণে পরবর্তীতে টেবিলের আকৃতি পরিবর্তন হলেও কথাটা রয়ে গেছে। যা হোক, শুরুতে আমি বিএসবি ফাউন্ডেশন ও ক্যামব্রিয়ান কলেজের চেয়ারম্যান লায়ন এম.কে বাশার, এমজেএফ কে অনুরোধ করছি স্বাগত বক্তব্য রাখার জন্য।

dsc_0011[1]

লায়ন এম.কে বাশার এমজেএফ

চেয়ারম্যান, বিএসবি ফাউন্ডেশন ও ক্যামব্রিয়ান কলেজ

ইত্তেফাক এবং বি.এস.বি গ্লোবাল ও ক্যামব্রিয়ান কলেজের যৌথ আয়োজনে আজকের এই গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রিত সকলকে স্বাগত জানাই। আপনারা জানেন আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় ঢাকা মহানগরীতে শিক্ষার পরিবেশ। ঢাকা শহরে বর্তমানে প্রায় দেড় কোটি লোক বাস করছে। আগামী ২০২১ সালের মধ্যে এই শহরের লোকসংখ্যা প্রায় আড়াই কোটিরও বেশি হতে পারে। এ শহর যেমন অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে একইভাবে এই শহরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও অপরিকল্পিতভাবেই গড়ে উঠেছে। শুধুমাত্র ধানমন্ডিতেই ২১টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। কমার্শিয়াল একটি এলাকা বনানী। সেখানে প্রায় ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এইকভাবে যদি এ রকম অপরিকল্পিতভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সারা শহরে গড়ে ওঠে তাহলে সেখানে একটি সুন্দর শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখা যাবে না, বিঘি¦ত হবেই। আমাদেরকে এদেশে আগামী আরো ১শ বছর বা আরো বেশি সময়কে টার্গেট করে যে পরিমাণ লোকসংখ্যা এই শহরে বৃদ্ধি পেতে পারে, তার ভিত্তিতে কি পরিমাণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তার পরিকল্পনা এখন থেকেই নেয়া দরকার।

mahabub[1]

ড. এ.কিউ.এম মাহাবুব

চেয়ারম্যান, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। এই জায়গা থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। অন্যান্য বিভাগ, জেলা এবং উপজেলা এমন কি গ্রাম পর্যায়ে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আমাদেরকে গুরুত্ব দিতে হবে। ঢাকায় ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকবে কিন্তু সেটি শুধুমাত্র ঢাকাকেন্দ্রিক যেন না হয়। আজকে ঢাকার যে সমস্ত ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলো বর্ধিত হতে হতে শুধুমাত্র শিক্ষা নয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপলাভ করছে। আমরা যদি ভিখারুন্নিসা নুন স্কুলের কথা ধরি তবে দেখতে পাবো ভিখারুন্নিসা নুন স্কুল ধানমণ্ডি আজিমপুর, সিদ্ধেশ্বরী মানে ১, ২, ৩-এ রকম বাড়তে বাড়তে যে অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে তাতে এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুণগত মান কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। একটা স্কুল যখন ভালো হয় তখন তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করতে থাকে তখনই এই ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা নয়, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এটি রোধ করা দরকার। প্রয়োজনে ভালো ভালো অনেক স্কুল হবে। ভালো স্কুলের আদলে আরো ভালো স্কুল হবে। শাখা-প্রশাখা নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাণিজ্যিকিকরণ নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ যেন বিরাজ করে। আর একটি দিক, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সেই গ্রামের স্কুল-কলেজ পর্যন্ত শিক্ষকদের মূল্যায়নের ঘাটতি রয়েছে। আমার মনে হয়, এখনও জাতি এদেশে শিক্ষকদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারেনি। আর এজন্য স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার মান খারাপ হয়ে যাচ্ছে। হয়তো মনে হতে পারে যে, শিক্ষকরা তো ভালোই আয় করে থাকেন। একথা কিছুটা সত্য কিন্তু কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে সত্য, তা আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে। শিক্ষার মান ধরে রাখতে হলে সঠিক শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আমি ইউজিসির চেয়ারম্যান স্যারকে একসময় বলেছিলাম যে, পিএসসির মাধ্যমে যারা চাকরিতে আসে তাদেরকে অনেকগুলো পরীক্ষা, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আসতে হচ্ছে, অথচ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আজ বিকালে পরীক্ষা হলো, কালই আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অথবা ‘আমার অমুক আছে সরকারের উচ্চ মহলে, তার জোরেই আজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হয়ে গেলাম, আমাকে কেন পরীক্ষা দিতে হবে?’ শিক্ষক মানেই যে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট থাকতে হবে তা-না শিক্ষকের কতগুলো গুণগত মান থাকতে হবে। একজন শিক্ষক ছাত্রদেরকে সুন্দর আগামী নির্মাণের স্বপ¦ দেখাবেন। জাতিকে স্বপ¦ দেখাবেন। সঠিক শিক্ষক যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ করা না হয় তবে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড- আমরা যে বলি তা কিন্তু ভেঙ্গে পড়বে। সুতরাং সঠিক শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে, শিক্ষককে সম্মান করতে হবে। তার বেতন ভাতা সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। তবেই শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ ফিরে আসবে। আর একটি দিক তা হল, এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৫/৫৬টি ডিপার্টমেন্ট আছে। অথচ বাংলাদেশের মতো একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশে কমপ্রিহেন্সিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বা ডিজাস্টার স্টাডি পড়ানো হয় এ রকম কোনও ডিপার্টমেন্ট নেই। হয়তো কোনও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে থাকতে পারে কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতূল।

আমাদের দেশে যে সকল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে সেগুলোর অধিকাংশই কমার্শিয়াল। পড়াশোনাও হয় কমার্শিয়াল বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে। এগুলো হাইলি ইনব্যালেন্স। এজন্য আমি বলবো, ব্যালেন্স আনতে। জাতির জন্য যা প্রয়োজন সে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এছাড়াও স্কুল-কলেজ এরপর ইউনিভার্সিটি- এই ধাপগুলোতে সিলেবাসের কোনও সামঞ্জস্যতা নেই, এটিও বিবেচনায় আনতে হবে। আমাদের স্কুলকে টার্গেট করতে হবে জাতি গঠনের জন্য। কারণ, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে শতকরা ৫ জনও পড়ার সুযোগ পায় না। আর একটি দিক হলো, সারা পৃথিবীতে স্কুল পর্যায়ে ৫টি মৌলিক বিষয় পড়ানো হয়। তা হলো, গণিত, মাতৃভাষা, ইতিহাস, ভূগোল আর সাধারণ জ্ঞান। আমরা আমাদের দেশের স্কুলগুলোতে গেলে দেখতে পাই ইতিহাস এবং ভূগোল পড়ানো হয় না সেভাবে। হলেও একের ভিতরে ৬ বা ৬ এর ভিতরে ১ এভাবে পড়ানো হচ্ছে। এগুলো এখন অপশনাল হয়ে গেছে। যে জাতি ইতিহাস জানে না, ভূগোল জানে না সে জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। সুতরাং, আমাদেরকে এ সকল বিষয়কে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় এনে সংস্কারের মাধ্যমে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আর একটি দিক, হলো কোটা সিস্টেম। একজন ভালো শিক্ষার্থী যখন ভালো রেজাল্ট করেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, তখন সে হতাশ হয়ে পড়ে। সুতরাং কোটা সিস্টেম উঠিয়ে দেয়া উচিত।

rukhsana[1]ড. রোখসানা হাফিজ

বিভাগীয় প্রধান, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ,  বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

আমাদেরকে প্রথমেই চিন্তা করতে হবে যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কোন কোন লেবেলে রয়েছে। প্রাইমারি, হাইস্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা যদি কলেজকে হাইস্কুলের সাথে মিশিয়ে চিন্তা করি তাহলে ৩টি ধাপ। প্রাইমারি পড়তে আসছে ৩ বছরের শিশুরা। এই যে শিশুরা স্কুলে আসছে, সে কিন্তু একা আসতে পারছে না। মা অথবা বাবার সাথে আসছে। এখানে আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে যে, যে অভিভাবক তার শিশুকে স্কুলে নিয়ে আসছে সে যেন হেঁটেই আসতে পারে। টাউন প্ল্যানটা সে রকমই হওয়া উচিত। ওয়াকিং ডিসটেন্সের মধ্যে স্কুল হতে হবে। অথচ আমাদের বর্তমান চিত্রটি কি? অনেক দূরে স্কুল। মা অথবা বাবাকে বাচ্চার সাথে যেতে হচ্ছে। যদি মা যায় তবে বাচ্চার দূরে স্কুল হওয়াতে মাকে কিন্তু বসেই থাকতে হচ্ছে। সে কিন্তু অন্য কোনও কাজ করতে পারছে না এ সময়ে। এই যে বসে থাকা, এটি কিন্তু আমাদের জাতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর যে, একটা প্রোডাক্টিভ মানুষকে বসিয়ে রাখা। সে অন্য কাজে যেতে পারছে না। হাইস্কুল লেভেলে যারা আছে ৬ষ্ঠ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত এরা নিজেরাই যেতে পারে। সে হেঁটে হোক, বাসে বা অন্য কোন বাহনে হোক। এখানে যে পাড়ার মধ্যেই স্কুল হতে হবে- এমন কথা নেই। এ ধরনের স্কুল ৩/৪টি পাড়া মিলে হতে পারে। আর বিশ্ববিদ্যালয়টা হলো-এর সাথে নগরের কোন সম্পর্ক না থাকলেও চলে। মানে দূরেও হতে পারে, আবাসিকও হতে পারে। যেমন ধরুন, ক্যামব্রীজ ইউনিভার্সিটি। একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই শহর। আর কিছু নেই সেখানে। আর আমাদের এখানে দেখুন শুধু বনানীতেই কতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু ধানমন্ডিতেই কতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়। একটি পাড়া বা মহল্লার মধ্যে কি এতগুলো ইউনিভার্সিটি প্রয়োজন আছে? এতে করে পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। যানজট তৈরি হচ্ছে। সুতরাং, এগুলো যদি নেভারহুণ্ড থেকে একটু দূরে হয় তাহলেই ভালো স্কুলের জন্যেই। আজকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বসার কোনও জায়গা নেই। ছেলে মেয়েরা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত, অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আমাদেরকে ভাবতে হবে, ইউনিভার্সিটির পরিবেশটা কি? শুধুমাত্র ক্লাস নির্ভর, একটা দু’টা লাইব্রেরি নির্ভর আর এডিমিনিস্ট্রেটিভ সেকশন নির্ভর না কি উন্মুক্ত জায়গাও থাকতে হবে? এই যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা সারাক্ষণ রাস্তার ওপরই ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। ভালো পরিবেশ পাচ্ছে না। এর একটা নেতিবাচক প্রভাব কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের মানসিকতার ওপর, তাদের রেজাল্টের ওপর এবং সর্বোপরি সমাজের ওপর কোনও না কোনভাবে পড়ছেই। আর একটি বিষয় ভাবতে হবে তা হলো, এই যে বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে তাদের মনমানসিকতাও আমাদেরকে বিবেচনায় আনতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেন আনন্দের জায়গা হয়। আতঙ্কের জায়গা না হয়। আমরা দেখি, শিক্ষকরা অত্যন্ত কঠোর আচরণ ছাত্রছাত্রীর সাথে করে থাকেন। সামান্য ভুল হলেই পেটান এবং অপমানজনকভাবে মাঠে বা বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখেন। এতে করে কিন্তু তাদের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। আমরা বিদেশে দেখতে পাই, বাচ্চারা লাফিয়ে লাফিয়ে মজা করে স্কুলে যেতে চায়। কারণ, তাদের সার্বিক পরিবেশ ভালো। শিক্ষকদের ব্যবহার বন্ধুর মতো। সেখানে তারা কি বাচ্চাদের না পিটিয়ে, খারাপ ব্যবহার না করে লেখাপড়া করাচ্ছে না? অবশ্যই করাচ্ছে। তাহলে আমরা কেন সে রকম হই না? আমার মনে আছে ছোটবেলায় আমি যখন স্কুলে পড়ি এক শিক্ষক প্রতিদিন একটা গাছের ডাল নিয়ে স্কুলে প্রবেশ করতেন এবং ঐ ডালটি প্রতিদিনই কারো না কারো পিঠে ভাঙতেন। এই যে শিক্ষার পরিবেশ এর রেশ কিন্তু এখনও আছে। এ জায়গা থেকে আমাদেরকে বের হয়ে আসতে হবে।

???????????????????????????????                                                                            দৈনিক ইত্তেফাক গোলটেবিল নিয়ে দু’পৃষ্ঠার বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে

শিক্ষার্থীদেরকে শেখার আগ্রহ থাকে এমন শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার পরিবেশ থাকতে হবে, আমরা কিভাবে শেখাবো সেটি, কারিকুলাম কি হবে, ফ্যাসিলিটিজ ইকুইপমেন্টস থাকতে হবে, যেটা আমার লার্নিং প্রসেসকে ফ্যাসিলিটেড করবে। এই জিনিসগুলোর জন্যে বিভিন্ন ধরনের স্পেস লাগে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নানা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় স্পেস আমাদেরকে দিতে হবে। সে যখন ক্লাস করবে তার জন্যে একটা স্পেস, টিফিন টাইম হলো তার জন্য স্পেস ইত্যাদি বিষয়গুলোর জন্যে স্পেস রেখেই তবে স্কুল-কলেজ, ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আজকে সরকারি স্কুলগুলো বেসরকারি স্কুলগুলোর তুলনায় অনেক ভালো। কারণ, অনেক ওপেন স্পেস আছে। অথচ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একটি বাড়ির মধ্যে, ফ্ল্যাটের মধ্যে, কোনও ওপেন স্পেস নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা আরো খারাপ। তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশটা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরী। আর এই পরিবেশটাই শেখার আগ্রহ বাড়াবে। আর একটি দিক হল, আজকে আমরা বাচ্চাদের ক্লাস ওয়ানেও ভর্তি করতে গেলে এডমিশন টেস্ট নিয়ে থাকি। নানা ধরনের প্রশ্ন করি। না পারলে নেই না। এটা কেন? সে তো সবে শুরু করলো। একটি বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি না হয়েই পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এই কোমলমতি শিশুদেরকে যেসব প্রশ্ন করা হচ্ছে তা কতটুকু সমীচিন সেটি বিবেচনা করা দরকার। যদি তাকে প্রশ্ন করা হয়, দেশের রাষ্ট্রপতির নাম কি? তার কি এটি জানার দরকার আছে? না কি সে তখন অক্ষর শিক্ষবে, ছড়া শিখবে গল্প বলা শিখবে, মানে ধীরে ধীরে সে স্কুলের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াবে? তারপরে তো এসব বিষয়। সুতরাং এ পদ্ধতিটির ও পরিবর্তন হওয়া উচিত। আমরা বিভিন্ন সময় পত্রিকায় দেখি স্কুলে ভর্তিযুদ্ধের চিত্র। কোমলমতি এসব শিশুকে স্কুলে ভর্তি করতে বাচ্চাসহ অভিভাবককে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়। এর অবসান হওয়া উচিত। আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সামাজিক, প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক কিছু বিষয়ে শিক্ষাদান করাও জরুরী। আজকে বন্যা হলে, ঝড় হলে, ভূমিকম্প হলে এবং আগুন লাগলে কিভাবে বাঁচতে হবে, কি কি পদক্ষেপ নিতে হবে- সে বিষয়গুলো নিয়েও প্রশিক্ষণ বা শিক্ষাদান করা প্রয়োজন। আমাদেরকে ভালো মানুষ হওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবকিছুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা দেয়া উচিত ছেলেমেয়েদেরকে। আর শুধুমাত্র ঢাকা নয়, সারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এক হওয়া উচিত। শুধুমাত্র কিছু কিছু ক্ষেত্রে আলাদা করা উচিত তা হলো গ্রামের একটি ছেলেকে গ্রামীণ পরিবেশে কাজের ক্ষেত্রে সহায়ক কি হতে পারে, সে বিষয়ে গুরুত্বারোপ আর শহরের ছেলেটি শহরের জন্য কি সার্ভিস দিতে পারে সে রকম। কিন্তু মূল বিষয়টি এক থাকা উচিত। আজকে স্কুল বন্ধ থাকলেও একগাদা হোম ওয়ার্ক ধরিয়ে দেয়া হয় তাহলে স্কুল বন্ধ করে লাভ হলে কি? যখন স্কুল বন্ধ হচ্ছে তখন সে রিল্যাক্স করুক, তখনও তার ওপর চাপ কেন? বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে, ভালো পরিবেশ পাচ্ছে, খেলার মাঠ পাচ্ছে, সুন্দর ব্যবহার পাচ্ছে তার স্কুলের প্রতি আগ্রহ আরো বাড়ছে। পাশাপাশি উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষকরা বাচ্চাদের দিয়ে রিসার্চ করাচ্ছেন। খুব স্বাভাবিক বিষয়। আমাদের এই শহরে অনেকগুলো হেরিটেজ সাইট আছে। তার কোনও একটি সম্পর্কে তুমি লেখ। শিক্ষক তাকে প্রয়োজনে লাইব্রেরিতে নিয়ে যাচ্ছেন বা নানাভাবে সহায়তা করছেন। এতে সে জানতে আগ্রহী হচ্ছে এবং তার মেধার বিকাশ হচ্ছে। সুতরাং এটিও দরকার এবং লাইব্রেরির সংখ্যাও বাড়ানো দরকার।

মাহাবুবুল হাসান নীরু

আজকের গোলটেবিল বৈঠকের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, ‘ঢাকা মহানগরীর শিক্ষা ব্যবস্থা’। আমি আশা করি, আমাদের সম্মানিত বক্তারা বিষয়টির মধ্যেই থাকতে চেষ্টা করবেন। কেননা, গোটা বাংলাদেশের শিক্ষার পরিবেশ কিংবা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আলোচনা করার বৃহৎ পরিসর বা সময় আমাদের হাতে নেই।

tajul[1]

অধ্যাপক তাজুল ইসলাম

সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন

প্রসঙ্গটা মনে করিয়ে দেবার জন্য মাহাবুবুল হাসান নীরুকে ধন্যবাদ যে আজকে আমরা ঢাকার শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে কথা বলবো। তবে আমি ঢাকার বাইরে থেকে শুরু করতে চাই। সেটা এভাবে, শুধু ঢাকা কেন, ছোট শহর, বড় শহর- সব শহরের সব বিষয় নিয়েই আলোচনা হওয়া উচিত; আর ঢাকা তো মেগাসিটি। এরও একেকটি সমস্যা নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা হতে পারে। সমস্যা হলো এই যে, ঢাকার আলোচনা করার আগে প্রত্যেকবারই আমি মনে করিয়ে দিতে চাই যে, সারা দেশের আর ঢাকার মধ্যে বিরাট এক তফাৎ রয়েছে। ঢাকায় যদি একশ’টা সমস্যা থাকে তো সারা দেশে আছে এক হাজারটা সমস্যা। আমরা যেনো আলোচনা করার সময় এ ব্যাপারটা ভুলে না যাই। আমরা যে সময়টাতে ঢাকায় পড়াশোনা করতাম, স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সময় ঢাকার লোকসংখ্যা ছিলো যদ্দুর মনে পড়ে পাঁচ লাখ, তবে ছয় লাখের বেশি হবে না। আর ঢাকার সীমানাটা ছিলো, অর্থাৎ সে সময় মূল ঢাকা বলতে বোঝাতো আউটার সার্কুলার রোড, তেজগাঁও শিল্প এলাকা একটু একটু ছিলো, মহাখালী হচ্ছে শুনেছি, ৬ নম্বর বাস আসতো মহাখালী পর্যন্ত কিছুটা মনে পড়ে। তেজগাঁও ঢাকার বাইরে ছিলো। এদিকে সাধারণত আসা হতো না। হয়তো প্লেন দেখার জন্য বা কাউকে সি-অফ করতে আসতে হতো। ঢাকায় ক’টা স্কুল ছিলো? আমি নওয়াবপুর সরকারি স্কুলে পড়তাম। সব মিলিয়ে ৩০ অথবা ৪০টির বেশি স্কুল ছিলো না মনে হয়। পাঁচ লাখ লোকের জন্য যদি ৩০/৪০ টা স্কুল দরকার হয় তাহলে আজকে দেড় কোটি মানুষের জন্য ক’টা স্কুল দরকার? আমি একটি ঐকিক নিয়মে হিসাব করে দেখেছি যে, পনের’শ থেকে দু’হাজার স্কুল দরকার। নওয়াবপুর স্কুলে ভর্তি হতে ছয়টা সিটের জন্য ছয়’শ জন টেস্ট দিয়েছিলাম। সেই ঢাকায় এখন তার দ্বিগুণ বা তিনগুণ স্কুল দরকার ছিলো। আর আজকে ঢাকায় ঐটুকুতে যেতেই দেড় থেকে দুই হাজার স্কুল দরকার। আমি জানি না ঢাকায় কতগুলো স্কুল আছে। অতএব ঢাকার পরিবেশ যদি বলি পরিবেশটা এখান থেকেই শুরু। পড়াশোনার গুণগত দিক নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। আমি বলবো, গুণগত দিকের পরেই সংখ্যাগত দিক দিয়ে ঢাকা ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে। যদি এই অবস্থা চলে তাহলে ২০২১ সালে যখন ঢাকায় জনসংখ্যা আড়াই কোটি হবে তখন এ শহরের অর্ধেকের বেশি মানুষকে অশিক্ষিত থাকতে হবে। এ অবস্থার জন্য ঢাকা নিজেই দায়ী। ঢাকাকে বাড়তে বলেছে কে? আজকে এ শহরের লোকসংখ্যা তো এতো বাড়ার কথা ছিলো না। উচিত ছিলো না যে এখানে এতো লোক আসবে। আজকে সারা দেহ থেকে রক্ত এনে ঢাকা মুখে জমা করেছে, সুতরাং ঢাকাকে ভুগতে হবেই। এখন ঢাকাকে যদি বাঁচাতে হয় তবে আমার মনে হয়, একটি বড় ধরনের বিপ্লব ঘটাতে হবে। আমাদের শিক্ষার ম্যানেজমেন্টে এবং ঢাকায় পৌর কর্মকর্তাদের তাদের অঞ্চল প্ল্যানিং ও এর ম্যানেজমেন্টে। আমার প্রস্তাবনা থাকবে, ইউনিভার্সিটিগুলো দ্রুত ঢাকার চারদিকে ছড়িয়ে দেয়া জরুরী। কারণ, চারদিকে ল্যাণ্ড প্ল্যানিং হচ্ছে। সময় চলে গেলে কিন্তু আর জমি পাওয়া যাবে না। এখানে যদি সরকার এখনই পরিকল্পনা করে কাজ শুরু না করে তবে পিছিয়ে পড়তে হবে এবং জোন করে এগুলো ভাগ করে দিতে হবে। আজকে ৫১টি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকাতে আছে। যদি এটি বেড়ে ১০০টি হয় তখন আসলেই পরিবেশের জন্যে তা ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে ঢাকাকে জনগণের জন্য আরও সহায়ক, উপযোগী করে তুলতে হলে অর্থনীতিকে গ্রামমুখী করতে হবে। এটাই হলো আসল সমাধান।

mehrin[1]

মেহরীন

কন্ঠশিল্পী

প্রথমেই আমি দৈনিক ইত্তেফাককে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি, আমাকে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ গোলটেবিল বৈঠকে ডাকবার জন্য, যেখানে এত বোদ্ধা মানুষ উপস্থিত হয়েছেন। এটা আমার জন্য সৌভাগ্য। আজ যে বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনায় বসেছি তা আমার মাথায় এমন পোঁকার মতো ঢুকেছে যা নিয়ে আমি গত ফেব্রুয়ারিতে ‘শহীদ মিনারের আত্মকথা’ নামে একটা গান বানিয়েছি। যেখানে শহীদ মিনার বলছে, আমায় ফুল না দিয়ে তোমরা নিজেদেরকে রঙিন করো। কারণ, তোমরা আমাকে শুধু বছরের একটা দিন মনে করো। ঢাকার বর্তমান শিক্ষার পরিবেশের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে আমি আমার স্কুলের একটি চিত্র তুলে ধরছি। আমি যে স্কুলে পড়েছি সেখানে একসময় বিশাল একটা মাঠ ছিলো। একতলা দু’টো বিল্ডিং ছিলো। আমরা মন খুলে সে মাঠে ছুটোছুটি করতাম, খেলাধুলা করতাম। এখন সেখানে ব্যাংক হয়েছে, অডিটোরিয়াম হয়েছে। স্কুলটা বেড়ে তিন, চারতলা হয়েছে। মাঠ বলতে আর কিছুই নেই এবং আমি ৫০ টাকায় পড়তাম, এখন সেখানে কতো বেতন দিতে হয়- সেটা আমার জানা নেই। আমার মেয়ে যেখানে পড়ছে, আমি বেতন দিতে গিয়ে মারা যাচ্ছি, আমি অতো দামী স্কুলে আমার মেয়েকে পড়াতে চাচ্ছি না এবং স্কুলটা ইংলিশ মিডিয়াম। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, আমার মেয়ে, যাকে ইংরেজি ভাষায় পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে, আমি চাচ্ছিলাম প্রথমে আমার মেয়ে নিজের ভাষা শিখে বড় হোক। কিন্তু যখন সে ক্লাস ওয়ানে উঠলো তখন সহপাঠীদের সাথে পেরে উঠছিল না। কারণ, বাসায় আমি তাকে বাংলা ভাষায় গড়ে তুলেছিলাম। আজ আমি ও আমার মেয়ে- দু’জনেই মারা যাচ্ছি ইংরেজি ভাষার পারদর্শিতা অর্জন করার জন্য। আমার মেয়ে বাংলায় গুণতে পারে না; নামতা গুণে ইংরেজিতে, যা আমার অসহ্য লাগে। এজন্য বেচারাকে আমার কাছে বকা খেতে হয়। বকা খেয়ে মন খারাপ করে সে। আমার কথা হচ্ছে, কেন আমরা সন্তানদের আজ ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে বাধ্য হচ্ছি। কেন এমন একটা বাংলা মিডিয়াম স্কুল নেই, যেখানে মায়েরা নিশ্চিন্ত মনে সন্তানদের দিতে পারে। আমরা যারা বেশি পয়সা দিয়ে বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাচ্ছি তারা কি বিদেশীদের বলছি এসো আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে যাও? প্রশ্নটি সকলের কাছেই রাখছি। কেন আমাদের দেশে এখনো কোনো কারিকুলাম নেই, যেটাতে কি না আজকের নিজের দেশকে পূর্ণাঙ্গভাবে জানতে পারে। ইংলিশ মিডিয়ামে ৬টি নদীর নাম পড়ানো হয়। কিন্তু নদীগুলো কোনটি কোথায়, তা পড়ানো হয় না। ঘটা করে একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, নজরুল, রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করা হলেও আমি জানি তা নিয়ে অহঙ্কার করা যায় না। আমার আজ একটাই আবেদন আপনাদের কাছে, আপনারা যখন কারিকুলাম বানাবেন তখন যেনো মনে থাকে, আমরা বাংলাদেশী নাগরিক। বিদেশ আমাদের অনেকভাবে শোষণ করেছে। এখন নতুনভাবে শোষণ করছে, যা আর সহ্য করতে পারছি না। অনেক ধন্যবাদ।

kabir[1]

ড. কবির হোসেন তালুকদার

রেজিস্ট্রার, অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে এখনই বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হবে। নইলে আজকে সারা বিশ্বে যেমন পরিবেশ মানুষের অবিচার অবিবেচনার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঢাকার শিক্ষাব্যবস্থাও সে রকম হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। শিক্ষাই যদি জাতির মেরুদণ্ড হয় তবে অন্য সব মন্ত্রণালয়ের চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দ রাখতে হবে আরো বেশি। আজকে কিন্ডারগার্টেন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ফার্মের মুরগির মতো আমাদের ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে। তারা লেখাপড়া করছে। তাদের খেলাধুলার সুযোগ একেবারেই নেই। আজ তারা কম্পিউটার আর মোবাইল ফোন সেটে খেলতে আগ্রহী। এতে করে কিন্তু তাদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। মেধা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ভবিষ্যতে ঢাকা শহরের শিক্ষাব্যবস্থা কী হতে পারে, তার রূপরেখা এখনই তৈরি করা দরকার যা হবে অন্তত আগামী ১০০ বছরের জন্যে। আজকে যে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সে সরকারি বা বেসরকারি যাই হোক সকলের শিক্ষা পদ্ধতি এক হওয়া উচিত। কোর্স কারিকুলাম এক হওয়া উচিত। উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে যদি আমরা উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকাই দেখতে পাবো টুয়েলভ পর্যন্ত লেখাপড়া করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এরপর মাত্র ১২ থেকে ১৫ শতাংশই কিন্তু হায়ার এডুকেশনে যায় না। কারণ, তারা প্রয়োজন মনে করেন না। এরপরই তারা কেউ কারিগরি শিক্ষায় চলে যায়। ভালো কাজ পেয়ে যায় বলে তারা আর লেখাপড়া করার প্রয়োজন মনে করে না। শুধু মেধাবী যারা তারাই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে। আজকে আমাদের দেশেও যারা মেধাবী তাদের জন্যে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা থাকা উচিত। যারা কম মেধাবী তাদের জন্য উন্নত কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা থাকা উচিত। দু’টো সার্ভিসই কিন্তু আমাদের দেশের জন্যে প্রয়োজন। আবার কারিগরি শিক্ষায় তাদেরকে শিক্ষিত করতে পারলে এরা কিন্তু দক্ষ জনশক্তি হিসেবে বিদেশে গিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছি অথচ সরকার সে পরিমাণ চাকরির ব্যবস্থা করতে পারবে কি না সেটি বিবেচনা করছি না। অথচ একটি ছেলে বা মেয়ে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে কিন্তু নিজে স্বাবলম্বী হতে পারে, অপরের জন্যে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং এ সকল বিষয়গুলোও কিন্তু আমাদের বিবেচনায় এনে ভবিষ্যত পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার।

zakaria[1]

ড. জাকারিয়া লিংকন

উপাচার্য, ইবাইস ইউনিভার্সিটি

ঢাকা একটি মেগাসিটি। সেখানে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি এবং বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে তার মধ্যে সামঞ্জস্যতা কতটুকু, সেটা চিন্তা করতে হবে। এই মহানগরীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে যে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার সেগুলো বিদ্যমান আছে কি’ না এ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করার জন্য যথাযথ রিসোর্স পার্সন আছে কি না এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাস আউট করার পরে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার সুযোগ আছে কি না, মাধ্যমিক পর্যায় থেকে পাস আউট করার পর কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ আছে কি না, সেগুলো দেখতে হবে। এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেসব সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার, তা নেই। উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে এই সুযোগ-সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে হবে। আমি মনে করি, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত ভালো অবস্থানে আছে এবং সব ধরনের শিক্ষাব্যবস্থাই আমাদের রয়েছে। একইভাবে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন রিসোর্স পার্সনও আমাদের রয়েছে। এছাড়া মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বা জাতীয় পর্যায়ের কোম্পানীতে হাতে কলমে কাজ করার সুযোগও রয়েছে, যা বিশ্বের অনেক শহরেই হয়তো নেই। সুতরাং অন্যান্য শহরের মতো ঢাকা সিটিতেও অনেক সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান। আমি বলবো, ইন ফ্যাক্ট ঢাকা সিটি পরিবেশের জন্য সহায়ক। এর মধ্যে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। সেগুলো আলোচিত হয়েছে। তার মধ্যে যোগাযোগের ব্যবস্থা অন্যতম বলা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি একটু ডিসেন্ট্রালাইজড হতো, ঢাকার মধ্যে না হয়ে যদি একটু দূরে হতো তাহলে ভালো হতো। আমার মনে হয়, এগুলো ওভারকাম করা সম্ভব। আমরা যদি এ সকল বিষয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেই, আমরা যদি চেষ্টা করি যে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মূল শহর থেকে একটু বাইরে নিয়ে যাব, তবে সেটা অনুচিত হতে পারে না। কিন্তু সেটা করতে হলে আইন করে বসে থাকলে চলবে না। তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন, প্রয়োগ প্রয়োজন। আর একটি বিষয় হলো যে, আমরা একই জায়গায় অনেকগুলো ইউনিভার্সিটি বলে যানজট হচ্ছে বলছি কিন্তু আসলে কি তাই? সাধারণত এসব ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা কিন্তু পাবলিক ট্রান্সপোর্টেই যাতায়াত করছে, সুতরাং যানজট হওয়ার কিন্তু কারণ থাকতে পারে না। আবার যদি দেখি যে, একটি বাচ্চাকে তার মা-বাবা বা অন্য কেউ সকালে দিতে আসছে ঐ একটি বাচ্চার জন্য আরো ১/২জন লোক আসছে, একটি গাড়ি আসছে সেক্ষেত্রে যানজট হতে পারে। এটি বিবেচনা করতে হবে আমার মনে হয়। তবে আমি আশাবাদী, সমস্যা যখন আমাদের আছে তার সমাধানও আমাদের কাছে আছে। আমার বিশ্বাস, একটু চিন্তা করে পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আশা করা যায় কাংখিত লক্ষ্যে আমরা পৌঁছতে পারবো। তবে শুরু করতে হবে এখনই। ধাপে ধাপে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

ড. করুণাময় গোস্বামী

আজকে আমরা দেখি প্রাইমারি স্কুলগুলোতে বাথরুমের ব্যবস্থাও নেই। আমি একটা স্কুলে জিজ্ঞেস করেছি যে, বাথরুম কোথায়? বলে যে, স্যার বাথরুম আছে, তালা দেয়া। কারণ, ব্যবহার করতে দিলে নোংরা হবে, পরিষ্কার করার বাজেট নেই। এই তো অবস্থা। আবার লাইব্রেরির কোন স্পেস প্রাইমারি স্কুলগুলোতে নেই। অথচ এটা স্কুলের পরিবেশ ও শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত জরুরী বিষয়।

sayeed[1]

ড. আবু সাঈদ

চেয়ারম্যান,  স্থাপত্য বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক

আজকের আলোচনার বিষয়টি আমাকে খুবই আনন্দিত করেছে যে, ঢাকা মহানগরীতে শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষাব্যবস্থা নয়। আমার মনে হয়, একটা স্কুল বলেন, কলেজ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় বলেন, এগুলোর জন্যে একটা হলো বাহ্যিক পরিবেশ, একটা অভ্যন্তরীণ পরিবেশ। স্কুল-কলেজও আমরা দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। একটা সরকারি, একটা বেসরকারি। সরকারি স্কুলকে আমি ধরবো না এ কারণে যে সরকারি স্কুল যেভাবে গঠিত হয় সেটি সরকারের মহাপরিকল্পনার আওতাধীন। আর যারা এটি পরিচালনা করেন তাদের কোন কন্ট্রিবিউশন নেই এটাকে ইমপ্রুভ করার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা যদি বলা হয় এখানকার পরিবেশ ভালো, এসি রুমে ক্লাস হয়, বিউটিফুল খাবার, তিতুমীর হলের মতো পোঁকাযুক্ত খাবার খেতে হয় না। ছেলে বেশি পয়সা দেয়, বেশি ভালো খাবার খায়। কিন্তু আসলে কি এদের স্বাস্থ্য ভালো? না, আসলে এদের চোখগুলো সবার নষ্ট হচ্ছে এবং দিন দিন তা আরো নষ্ট হচ্ছে। ছেলেমেয়েগুলোর মধ্যে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশের চোখে চশমা। আমরা তো স্কুলে চশমা দেখিনি? তাহলে আজকালকার বাচ্চাদের চশমা লাগছে কেন? প্রথম কারণ, এরা থাকে বদ্ধঘরে, এসি রুমে, যেখানে সুন্দর পরিবেশ, সুন্দর টয়লেট, টিস্যু পেপার- সবই আছে, তারপরও একটু সবুজের ছোঁয়ার অভাবে এই বাচ্চাদের চোখগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে, আবার ফাস্ট ফুড খেয়ে অধিক মোটা হয়ে যাচ্ছে। আমরা ছোটবেলায় বাবার কাছে শুনেছি সবুজে হাঁটলে, সবুজে তাকালে চোখ ভালো থাকে, শরীর মন ভালো থাকে। কিন্তু আজকে পরিবেশের কারণেই সে ঘাস আমরা পাচ্ছি না, খোলা জায়গা আমরা পাচ্ছি না। দিন দিন বদ্ধঘরে বদ্ধ হয়ে পড়ছি আমরা। আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, ঢাকা শহরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য কোন জায়গা বরাদ্দ নেই সরকারি ছাড়া। বেসরকারি উদ্যোগে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করার আইন নেই, জায়গা বরাদ্দ নেই। যদি করতে হয় স্পীড মানি দিয়ে টি,আই এ্যাক্টের মাধ্যমে জমিটাকে ইউজ ট্রান্সফার করতে হবে এবং এ প্রক্রিয়াও অত্যন্ত জটিল ও ব্যয়বহুল ব্যাপার, যা কোন শিক্ষাবিদ বা শিক্ষানুরাগীর পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, একট বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে হলে ৫ কোটি টাকা জমা দিতে হবে। কোন শিক্ষকের পক্ষে কি তা সম্ভব?

৫ কোটি টাকা জমা দিয়ে অনুমোদন নেয়া, এরপর অন্যান্য খরচ তো রয়েছেই। সুতরাং ব্যবসায়ীরা এগিয়ে আসছে। তাদের বিশাল বিনিয়োগ এখানে কাজ করছে। তারা তো লাভের চিন্তা করবেই। আসলে এখানে একটা মহা-পরিকল্পনা দরকার। পরিকল্পনা করতে হবে সরকারকে, আমরা তো করতে পারি না, করার রাইট নেই। কিন্তু সরকার কি করছে? যে ৫ কোটি টাকা নেয়া হচ্ছে-কেন সরকার থেকে বলা হয় না যে তুমি ৫ কোটি টাকা জমা দাও, তোমাকে পর্যাপ্ত জায়গা দিচ্ছি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য। সরকারের তো অনেক জায়গা পড়েই আছে। সেখানে হাউজিং-এর চিন্তাভাবনা চলছে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্যে। আজকে ঢাকায় ৫১ টা ইউনিভার্সিটি, ২৫৫ কোটি টাকা সরকারের ঘরে জমা আছে। এই টাকা দিয়ে ৫টি ব্যাংক চালানো যায়। সরকার টাকা নিলো কিন্তু সার্ভিসটা দিলো কোথায়? আজকে ঢাকা শহরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য কোন জায়গা নেই। শুধুমাত্র টিআই এ্যাক্ট-এর মাধ্যমে একমাত্র রাজউকের চেয়ারম্যানই পারেন যেকোন জায়গায় রেসিডেন্সকে কমার্শিয়াল করতে আবার কমার্শিয়ালকে হাসপাতাল করতে। একজন ব্যক্তির হাতে যদি এই দায়িত্ব থাকে তাহলে কি অবস্থা হতে পারে বুঝে দেখুন। সুতরাং এ সকল বিষয়গুলো বিবেচনা করা দরকার। শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারকে সহায়ক ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, শিক্ষানুরাগীদেরকে উৎসাহ, সহযোগিতা প্রদান করতে হবে কাজ করার জন্য। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে অবশ্যই আমরা ভালো কিছু করতে পারবো।

milon[1]

ইমদাদুল হক মিলন

কথাশিল্পী

এতোক্ষণ যে আলোচনাটা হলো, আমার ধারণা যে আমরা শুরু থেকেই আলোচনাকে ঠিক শিক্ষার পরিবেশের মধ্যে না রেখে শিক্ষার অন্যান্য বিষয়গুলোর ওপরই বেশি জোর দিয়েছি। শিক্ষার পরিবেশটা এ রকম হওয়া উচিত সেটি যদি আমি এভাবে বলি যে, এখানে একজন আলোচক বলেছেন তার ছেলেবেলার নবাবপুর স্কুলের কথা, আমি সে আঙ্গিকেই দু’একটি কথা বলতে চাই। আমার ছেলেবেলা কেটেছে গেন্ডারিয়া এলাকায়। এ এলাকার গেন্ডারিয়া হাই স্কুল বলে একটা স্কুলে আমি পড়েছি। এ এলাকার বাড়ি-ঘরগুলো ছিলো খুব সুন্দর। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সেখানে থাকতো। সেখানে একটা খুব বড় মাঠ ছিলো। একাত্তর সালের আগে পর্যন্ত এ অবস্থা আমি দেখেছি। লোকসংখ্যা খুব কম ছিলো। ধূপখোলা মাঠটির কথা আমি বিশেষভাবে বলছি, কিন্তু এখন যদি আপনি সেখানে যান তো মাঠটি খুঁজে পাবেন না। মাঠের চারদিকে মার্কেট হয়েছে, আমার ধারণা কয়েক হাজার দোকান। ঐ এলাকায় গেলে আজ আর কিছু চেনার উপায় নেই। যেখানে একটি বাড়ি ছিলো সেখানে এখন পনেরটি বাড়ি হয়েছে। যে গেন্ডারিয়া স্কুলটিতে আমি পড়েছিলাম সে স্কুলে ভেতরে যে আঙিনাটা ছিলো সেটা যেকোনো একটি মাঠের চাইতে বড় ছিলো। আজ সেই আঙিনাটুকুও আর নেই। আশেপাশে যে মাঠ ছিলো কিংবা অন্যান্য যে খোলা জায়গাগুলো ছিলো এখন কিছুই আর নেই। এটার কারণ আমরা খুব সহজেই বুঝি যে, স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমান্বয়ে মানুষের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ঢাকা শহরের আজকের এই চেহারা হয়েছে। আজ কোনো স্কুলের ভেতোর আর তেমন মাঠ খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন আমার মেয়ে দু’টো ভিকারুন্নিসা স্কুলে পড়তো, মেহ্রীনও সে স্কুলের ছাত্রী, সে কিছুটা বুঝবে, স্কুলে যে মাঠটি ছিলো সেটিও কিন্তু নেই। আমরা একসময় যে পরিবেশ পেরিয়ে এসেছি, সকাল দশটায় স্কুলে যেতাম, স্কুল থেকে ফিরে মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করতাম, এরপর বাড়ি ফিরে পড়াশোনা করে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। যে জীবনটা আমরা পেরিয়ে এসেছি সেখানে একটা স্বাস্থ্য চর্চার ব্যাপার ছিলো, পাঠাগারের ব্যাপার ছিলো। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় পাঠাগার ছিলো, আমরা যদি পরিবেশের অধঃপতনের কথা বলি তো আমি বলবো অধঃপতনটা এখান থেকেই শুরু হয়েছে। সেই নির্মল পরিবেশ কিন্তু এখন ঢাকার কোথাও নেই। এখনকার বাচ্চারা তো স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য কোনো পরিবেশ পাচ্ছে না। পাচ্ছে না সবুজ একটি মাঠ; যা দেখে তারা খুশি হবে, সেখানে ছুটোছুটি বা খেলাধুলা করতে পারবে। একটি দেশ সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে যে পরিকল্পনার দরকার, আমি বলবো শিক্ষা শুধু নয়, কোনো ক্ষেত্রেই তা ছিলো না। শুরু থেকেই ছিলো না। এখন বলা হচ্ছে, ঢাকা শহরে দেড় কোটি লোক বসবাস করছে, তো শহরটির অবস্থা তো এ রকমই হবে। মানুষ যাবে কোথায়? শহর তো আর চারদিকে সেভাবে বাড়েনি। এখন থেকে বিশ বছর পর ঢাকার লোকসংখ্যা যখন আড়াই কোটি হবে তখন শহর আর কতোটা বাড়বে। আর একটি ব্যাপারে আমি সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই, যে বিষয়টি নিয়ে আমরা ভাবি না, তা হচ্ছে শহরের বস্তি। এখানে বস্তির কথা একজন আলোচক বলেছেন, ঢাকার বস্তিতে এখন কমপক্ষে ৩৫ লাখ লোক বসবাস করছে। কুড়ি বছর পর এ চিত্র আরো ভয়াবহ হবে, আড়াই কোটি লোকের মধ্যে হয়তো সোয়া কোটি লোকই হবে বস্তিবাসী। এদের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের সংখ্যা কিন্তু সেভাবে বাড়ছে না। মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের যে পরিবারগুলোর সন্তানরা স্কুলে যাবার সুযোগ পাচ্ছে তাদের জন্ম হার তো সে পর্যায়ে নেই। শহরে বলুন আর গ্রামেই বলুন বাড়ছে তাদের সংখ্যা যারা শিক্ষার আলোই পাচ্ছে না। সুতরাং আগামী বিশ বছর পরে আমার তো ধারণা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোই কমে যাবে। সুতরাং আমি মনে করি, এটাও একটি ভাববার বিষয় যে, আমাদের দেশটি আসলে কোন দিকে যাচ্ছে। এখন যদি আমরা বড় বড় কিছু সাজেশন দেই যে, আমরা পরিকল্পিত নগর গড়ে তুলবো, রাস্তা অনেক চওড়া ইত্যাদি। যদি ইউনিভার্সিটির কথা বলি তো বলবো, পৃথিবীর অনেক বড় শহরের পাশে ইউনিভার্সিটির জন্য আলাদা সিটিই থাকে। কোনো কোনো শহরে ইউনিভার্সিটি নেই, পাশে আর একটি শহর করে সেখানে ইউনিভার্সিটি, কলেজ, স্কুল গড়ে তোলা হয়েছে। এমন চিন্তা তো আমরাও করতে পারি; পরিকল্পনাও তো আমরা করতে পারি। কিন্তু কতোটা সেটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে কথা। যদিও হতাশা আমাদের চারদিকে আছে, আজ স্বাধীনতার সাইত্রিশ বছর পরও আমরা আমাদের জনসংখ্যার চাপটাই সামলাতে না পারি, আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার পাশাপাশি খাদ্য-চিকিৎসা,ক্রীড়া-বিনোদনসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। সবকিছু মিলিয়েই আমরা একটা বিপর্যয়ের মধ্যে আছি। কাজেই শুধু শিক্ষার ব্যাপারটি দেখলেই চলবে না, যদি আমরা গোড়া থেকেই ভাবি, যদি নতুন করে এই দেশটাকে নিয়ে ভাবি তাহলে হয়তো আমরা আশার আলো দেখতে পাবো। আজ আমার কাছে চারদিকটা খুবই অন্ধকার মনে হয়।

tusar[1]

আব্দুন নূর তুষার

টিভি উপস্থাপক

আমাদের আজকের বিষয় ‘ঢাকা মহানগরীতে শিক্ষার পরিবেশ’। আমার কাছে মনে হচ্ছে, আমরা সরাসরি মূল বিষয়ে না গিয়ে এর আশেপাশেই ঘোরাফেরা করছি। শিক্ষার মান নিয়ে কথা বলেছি। বাংলাদেশে শিক্ষার মান নিয়ে অভিযোগ আছে। কারণ, বিশেষ করে ইতিহাস শিক্ষার ব্যাপারে অনেক অভিযোগ রয়েছে। প্রতিবাদ হয়েছে বারবার ইতিহাসের বই পরিবর্তন নিয়ে। শিক্ষার মান নিয়ে যে অভিযোগ আছে তা থাকবে, হয়তো আরো কিছুদিন থাকবে। কিন্তু আজকে আমার ধারণা যে, ঢাকা মহানগরীতে শিক্ষার ভৌত সুবিধাদি এবং শিক্ষার যে পরিকাঠামোগুলো রয়েছে, এটাই হচ্ছে আলোচনার মূল বিষয়বস্তু। এখানে একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমরা এক কাপ কফি এখানে বসে খাচ্ছি, আবার এক কাপ কফি আমরা চাইলে রমনা পার্কেও বসে খেতে পারি। এই কফি খাওয়ার পরিবেশের সম্পর্কে আমরা যদি আলোচনা করতে যাই তবে বলতে হবে এখানকার কফি খাওয়ার পরিবেশ রমনা পার্কের কফি খাওয়ার পরিবেশের চাইতে ভালো। ঐ একইভাবে যদি ঢাকা শহরের শিক্ষার পরিবেশের কথা বলেন তাহলে আমি বলবো যে, ঢাকা মহানগীতে শিক্ষার পরিবেশ বিরাজ করছে না। আমি এটি উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি। প্রথমত প্রস্তাব চেয়েছেন সবাই। একটি বিষয় আজও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি যে, প্রাইমারি স্কুলের জন্য আসলে কতোটুকু জায়গা প্রয়োজন। ইউনিভার্সিটি মঞ্জুরী কমিশনের প্রতিনিধি এখানে আছেন, তারা শুরুতে ঠিক করেছিলেন যে, একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির জন্য পাঁচ একর জায়গা প্রয়োজন। কিন্তু কিছুদিন আগে সেটাকে ছেঁটে এক একরে নিয়ে আসা হয়েছে। হয়তো আরো কিছুদিন পর তারা বলবেন, এক একরের দরকার নেই, পাঁচ কাঠা জমির ওপর বিশতলা বিল্ডিং তুললেই হবে। এটা খারাপ। আমরা আমাদের সমস্ত নিয়ম-কানুনকে কম্প্রোমাইজ করি এবং এটা করতে গিয়ে যেটি করেছি, আমরা আসলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বঞ্চিত করছি। একটি স্কুলের জন্য আসলে কতোটুকু জায়গা প্রয়োজন, এটাই কিন্তু কোথাও নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। ফলে ঢাকা শহরে দোতলা বাড়িতে স্কুল আছে, দশতলা বাড়িতে স্কুল আছে, স্কুল নিজের মতো করে গড়ে তোলা হয়েছে। অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল নামে একটি স্কুল আছে যেটা দেখে মনে হয়, হ্যারি পটার স্কুল। এটা একটা বাক্সের মতো। দেখলে মনে হয়, এটা একটা জেলখানা। একটা ছেলে স্কুলে যাবে। প্রাইমারি স্কুলে যেতে হলে তাকে হেঁটে যেতে হবে এবং হাই স্কুলে যাবার জন্য তার স্কুল বাসের দূরত্ব থাকা উচিৎ। একসময় ঢাকার অনেক স্কুলে স্কুল বাস ছিলো। সে বাসগুলো আজ উঠে গেছে। শুধু তাই নয়, স্কুল ছাত্রদের জন্য একসময় বাসে হাফ ভাড়ার প্রচলন ছিলো, সেটা এখন আর নেই। এখন দেখা যায়, মুরগীর খাঁচার মতো ভ্যানে করে প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে যাতায়াত করে। এটা একটা অস্বাভাবিক চিত্র। একটা খাঁচার মধ্যে বন্দী করে বাচ্চাদের এভাবে স্কুলে আনা-নেয়া করা ঠিক না। আমি তো বলবো বাচ্চাদের স্কুলে যাবার পরিবেশটাই নেই। শহরের বাচ্চারা স্কুলে যাবার আগেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তারপর চালু করা হয়েছে দুই শিফট্। এটা একই সঙ্গে শিক্ষকদের শোষণ ও ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি অবিচারের শামিল। কেননা যে ছেলেটি ১২টার সময় স্কুলে প্রবেশ করে সে বিকেল বেলাটা স্কুলের ভেতোরেই থাকে। সে খেলাধুলা করে কখন, কখন সে বিকেল বেলার নাস্তা খায়- এটা কিন্তু ঠিক করা নেই। স্কুলে দুই শিফট্ চালু করা যাবে না- এটা সরকারকে বলতে হবে। স্কুল দু’টো বানাতে হবে। একই স্কুলের একই শিক্ষক, উনি সকালের শিফটেও পড়ান, বিকেলের শিফটেও পড়ান-এটা শিক্ষকদের ওপরও একটা অবিচার। এজন্য তো তাদের বেতন ডাবল হয়নি। ফলে শিক্ষকরা পাঠদানে আগ্রহীও হন না, পাঠের মানও কমে যায়। ঢাকা শহরে থাকতে হলে মধ্যবিত্ত মানসিকতা আমাদের পরিত্যাগ করতে হবে। ঢাকা শহরে যে স্কুলগুলো আছে সেগুলোও কিন্তু বিভিন্ন জায়গাতে একোমোলেটেড। আমি কিছু নাম বলি আপনাদের, আপনারা যদি নিউমার্কেট এলাকা থেকে বকশীবাজার এলাকা পর্যন্ত যান সেখানে আছে উদয়ন স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাবরেটরী স্কুল, ল্যাবরেটরী স্কুল, নবকুমার ইন্সটিটিউট, ওয়েস্টার্ন স্কুল, ইডেন, হোম ইকোনমিক্স, বদরুন্নেসা, আজিমপুর গার্লস স্কুল- এতোগুলো স্কুল ঐ জায়গাতেই! গভঃ ল্যাবরেটরী স্কুল পার হয়ে আপনি যদি আসাদগেট পর্যন্ত আসেন এর মাঝামাঝি একটি ছাড়া আর কোনো সরকারি স্কুল নেই। সেটি হচ্ছে ধানমন্ডি গভঃ বয়েজ হাই স্কুল। ধানমন্ডি গভঃ বয়েজ হাই স্কুল পার হয়ে রেসিডেনসিয়াল মডেল হাই স্কুল ও মোহাম্মদপুর গভঃ বয়েজ হাই স্কুল হচ্ছে একই জায়গায়, তারপর সে জায়গা থেকে শুরু করে সোজা যদি চলে যান আমিনবাজার পর্যন্ত, এর মাঝে একটা সরকারি প্রাইমারি স্কুল আছে, তার মানে ঢাকা শহরে সরকারি স্কুলগুলো সঠিকভাবে ডিস্ট্রিবিউটেড না। এলাকাভিত্তিক ডিস্ট্রিবিউশন হয়নি। অপরদিকে পাশাপাশি ভালো এবং খারাপ স্কুলের মধ্যে একটা বৈষম্য তৈরি হয়েছে। সেটা ঢাকাতেও হয়েছে, ঢাকার বাইরেও হয়েছে।

এবার আমি আমার সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব তুলে ধরছি, ১. স্কুল কলেজ ও ইউনিভার্সিটি কোনটার জন্য কতোটুকু জায়গা দরকার, এসব প্রতিষ্ঠানে কি রকম ভৌত সুবিধাদি অর্থ্যাৎ কতোটা ল্যাবরেটরি থাকতে হবে, কয়টা লাইব্রেরি থাকতে হবে, কতোজন শিক্ষক থাকতে হবে, কোন কোন বিষয়ে তাদের পাঠদানের ব্যবস্থা থাকবে, সেখানে গেম টিচার, গানের টিচার থাকবেন কি না, সেটা নির্দিষ্ট করতে হবে এবং মানতে বাধ্য করতে হবে। ২. একেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একেক নিয়ম থাকলে চলবে না, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই নিয়ম থাকতে হবে। ৩. কোনো স্কুলেই ডাবল শিফট্ ক্লাশ নেয়া যাবে না। . ৪. প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলাধুলার ব্যবস্থা রাখতে হবে। যদি স্কুলের ভেতোরে মাঠের ব্যবস্থা করা না যায়, তবে দু’তিনটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে একত্রিত করে এলাকার কোনো মাঠকে তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। এই মাঠে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছেলেমেয়েরা বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে খেলাধুলা করবে। ৫. ঢাকা শহরের জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ঢাকা শহরে থাকতে চাইলেই থাকা যায়, ঢুকতে চাইলেই ঢোকা যায়-এই ধারা পাল্টাতে হবে। ৬. যারা গাড়িতে করে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাবেন তাদেরকে সারচার্জ দিতে হবে। কেননা গাড়ির কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দেখা যায় গাড়িওয়ালা ভদ্রলোকদের একটা বাচ্চা ঢোকার জন্য দশটা বাচ্চা ঢোকার পথ বন্ধ হয়ে যায়। ৭. ঢাকা শহরকে যদি আমরা মহানগরী হিসেবে চিন্তা করি তবে এই শহরে যারা থাকবেন তাদের ‘মহানগরীতে বসবাস করছি’ এই মানসিকতা নিয়েই থাকতে হবে। ৮. ঢাকা শহরের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গড়ে উঠেছে মূল যেসব এলাকায় বড়লোকদের বাস সেসব এলাকায়। ফলে গোটা মিরপুর খুঁজে কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া না গেলেও ধানমন্ডি-গুলশানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছড়াছড়ি। এটা রোধ করতে হবে। ৯. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে পুরো শহরে। মিরপুরে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ লোকের বসবাস, সেখানে ভালো স্কুল আছে দশ থেকে বারোটা, আর আজিমপুর, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আছে ত্রিশটির মতো। এখান থেকেই বোঝা যায়, ঢাকা শহরে আসলে শিক্ষার পরিবেশ বিরাজ করছে না। ছাত্র-ছাত্রী স্কুল কলেজে নিরাপদে যাতায়াতের পরিবেশ নেই এবং স্কুলের ভেতোরে ঢুকবার পর সেখানকার পাঠদানেও আশানুরূপ পরিবেশ নেই। শিক্ষার মান আসলে অন্য বিষয়।

mahfuzul[1]

মাহফুজুল হক শাহীন

অধ্যাপক, ঢাকা ইম্পেরিয়াল কলেজ

একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য যে সকল নিয়ামকগুলো রয়েছে তার মধ্যে আমার মনে হয় ‘মানুষ ও মানসিকতা, অবকাঠামোগত উপাদান, প্রকৃতিগত বা পরিবেশগত উপাদান, ভাবগত বা আদর্শগত উপাদান স্টক হোল্ডারস এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎসহ ইন্টারনেট সুবিধা আছে কি না, যা আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল শর্ত। সর্বোপরি প্রতিষ্ঠানের সকল পর্যায়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দৃষ্টিভঙ্গি। এই উপাদানসমূহের সবগুলো যে প্রতিষ্ঠানে আছে সেটি একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে পারে। আমরা মানসিকতার কথা বলেছি। একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি-আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়। একবার জনৈক এমপি আমাকে ডেকে বললেন, এখানে জাতীয় সঙ্গীত বাজাবার প্রয়োজনটা কী? এটি তো মানসিকতার ব্যাপার। কোন কর্তৃপক্ষের যদি এমন মানসিকতা থাকে তাহলে সেটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে পারে না। অবকাঠামোগত দিকটি যদি বলি আজকে ঢাকায় অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে। শুধুমাত্র ভিকারুন্নিসা নূন স্কুলের কথাই যদি ধরি যে, একটি ক্লাসে একসাথে ১৭৫ জনকে পড়ানো হচ্ছে, সেখানে আর যাই হোক ভালো লেখাপড়া হতে পারে না-এটা সবাই বুঝবেন আশা করি। তারপরও ভিকারুন্নিসা নূন স্কুলের রেজাল্ট ভালো কেন? কারণ, সবগুলো জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রীই সেখানে পড়ে। কিছু কিছু ফ্ল্যাট বাড়িতে স্কুল হয়েছে। দেখা যায়, ক্লাস হচ্ছে পাশের বাসার রান্না ঘর থেকে খাবারের গন্ধ আসছে বা গান বাজছে, সে শব্দ ক্লাসরুমে চলে আসছে। এই তো পরিবেশ। আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে শিক্ষা বোর্ড এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বন্ধ রাখা দরকার। শিক্ষার্থীর সংখ্যানুপাতভেদে পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের ব্যাপারে চিন্তা করা দরকার।

ড. করুণাময় গোস্বামী

জাতীয় সঙ্গীতের কথা এসেছে। আমি অনুরোধ জানাব যে, জাতীয় সঙ্গীত মাইকে না বাজিয়ে যদি প্রত্যেক ছেলে-মেয়ে নিজ মুখে জাতীয় সঙ্গীত গায় সে স্কুল কলেজের যেখানেই থাকুক না কেন সেখানে দাঁড়িয়েই যাক। সেই প্র্যাকটিসটা আমাদের করা উচিত।

ইমদাদুল হক মিলন

আমি মাঝে মাঝে গ্রামের কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাই। সেখানে ছাত্র-ছাত্রীরা তো দূরের কথা অনেক শিক্ষকরাও জাতীয় সঙ্গীত জানেন না, এমন কি কথাটিও ঠিকমত বলতে পারেন না তারা। আজকে আমরা অনেক প্রতিষ্ঠানগুলোতেই দেখি অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করে রাখা হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত এসব শিক্ষকরা নিজেরাই তো জানে না, শেখাবে কি করে? ঢাকা শহরের বাইরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তো তাকানোই যায় না। খুবই করুণ অবস্থা। আমার মনে হয় শুধু ঢাকা নয়, পুরো দেশটাকে নিয়ে ভাবা উচিত। শুরু থেকে আবার শুরু করা উচিত।

moazzm[1]

প্রফেসর ময়েজউদ্দীন আহমেদ

অধ্যাপক ময়েজউদ্দিন আহমেদ, সাবেক চেয়ারম্যান, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড

আমাদের দেশে শিক্ষার কারিকুলাম নেই-এ কথাটি বোধ হয় ঠিক নয়। আমার মনে হয়, যা আছে আমাদের তার সঠিক বাস্তবায়ন আমরা করতে পারছি না। আমি বলবো, আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্প্রসারণ হয়েছে অত্যন্ত অপরিকল্পিতভাবে। দেশে যেমন জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটেছে সাংঘাতিকভাবে তেমনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও বিস্ফোরণ ঘটেছে সাংঘাতিকভাবে। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমরা স্থাপন করেছি। ঢাকা শহরের কথা যদি বলি, আমার মনে হয়-যদি এ শহরে দেড় কোটি লোক থাকে তাহলে আমাদের জন্য কতগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দরকার? বোর্ডের একটা নীতিমালা আছে যে ১০ হাজার পপুলেশনের জন্যে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকবে। তাহলে বড়জোর ২০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকবে এবং সেটাই উচিত। অথচ ঢাকা শহরে শুধুমাত্র মাধ্যমিক স্তরেই সাড়ে পাঁচশ’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে এবং শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্যে যে প্রচেষ্টা আমাদের থাকা দরকার তার বাস্তবায়ন করতে পারছি না। কারণ, অধিকাংশ অর্থ অর্থ্যাৎ ৭০ থেকে ৮০ ভাগ চলে যাচ্ছে বেতন বাবদ। এতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এর বেশি সংখ্যক শিক্ষক কর্মচারী যে এদের বেতন দিতেই সিংহভাগ অর্থ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে, সে কারণেই মূলত শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তনের জন্য আমরা কোন অর্থ ব্যয় করতে পারছি না। আমরা সবাই চাই ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ভালো শিক্ষাব্যবস্থা, ভালো শিক্ষা। কিন্তু তার জন্য ভালো শিক্ষক দরকার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে, যারা শিক্ষকতা করছেন তাদের গুণগত মান নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। যে ধরনের পরিশ্রম এবং মেধার দরকার ভালো শিক্ষা দেবার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিন্তু আমাদের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তা নেই। যে কারণে গুণগত পরিবর্তন আনতে মাধ্যমিক স্তরে যে সকল পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা যাতে ভালো শেখে, তাদের লেখাপড়ার মান যাতে ভালো হয়, সেজন্য যে সমস্ত সংস্কার করা হয়েছে তার মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার। মাঝে মাঝেই দেখা যায় যে, কিছু শিক্ষক এবং অভিভাবক এই সংস্কার বাস্তবায়ন চাচ্ছে না। উদ্দেশ্যটা আমার মনে হয় ভিন্ন। আমি যদি আমার বাচ্চাকে ভালো শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে চাই তবে আমাকে এ সংস্কার মেনে নিতে হবে এবং তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে হবে।

nasea[1]

আবু নাসের খান

চেয়ারম্যান, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন

ধন্যবাদ দৈনিক ইত্তেফাক ও বিএসবিকে এমন একটি সুন্দর পরিবেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়োপযোগী গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনের জন্য। একটু অন্যভাবে আমি আমার বক্তব্য শুরু করতে চাই। নিউ ইস্কাটনে বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের একটি স্কুল আছে। ঐ স্কুলে বেশ খোলামেলা অনেকটা জায়গা আছে। একদিন শুনলাম, জায়গাটার ওপর বিল্ডিং তোলা হবে। কর্তৃপক্ষ এ কাজের দায়িত্ব একটি হাউজিং কোম্পানিকে দিয়েছে। সচেতন এলাকাবাসী ব্যাপারটিকে সমর্থন করেনি, তারা এ ব্যাপারে আমাদের সংগঠন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সহযোগিতা চাইলো। আমরা এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করলাম এবং এ জাতীয় কর্মকাণ্ড থেকে তাদের বিরত রাখতে সমর্থ হলাম। আমি মনে করি, শিক্ষার পরিবেশের জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা সামগ্রিকভাবে। ভাবতে অবাক লাগে যেখানে হাজী সেলিম ও নাসিরউদ্দিন পিন্টুর মতো লোকেরা স্কুল ও কলেজের চেয়ারম্যান হয় সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কি হতে পারে, সেটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর একটি ব্যাপার লক্ষ্যণীয়, আমাদের দেশের অভিভাবকরা আমার মনে হয় সম্পূর্ণ আলাদা। তারা চায় তাদের ছেলেমেয়েরা ভালো একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সার্টিফিকেট অর্জন করুক। বাচ্চারা পড়াশোনা কতোটুকু শিখলো-সেটা নিয়ে মনে হয় তাদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। অভিভাবকদের এই সার্টিফিকেট সংগ্রহের প্রতিযোগিতা তাদের সন্তানদের যে কতোটা ক্ষতি সাধিত করছে, সেটা তারা ভেবে দেখছেন না। নগরীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ মোটেও ভালো নেই। আর একটি ব্যাপার লক্ষ্যণীয় যে, আমাদের দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে দারুণ বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। ইংলিশ মিডিয়াম, বাংলা মিডিয়াম ও মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার দিকে এবং এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি নজর দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়। একেক স্কুলের শিক্ষার পরিবেশ, নিয়ম-কানুন একেক রকম। আমি মনে করি, এদিকে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের বিশেষভাবে নজর দেয়া দরকার। আর একটি তথ্য এখানে তুলে ধরা হয়েছে যে, আগামীতে ঢাকা শহরে আড়াই কোটি, তিন কোটি লোকের বসবাস হবে। আমি পরিবেশ নিয়ে কাজ করি, আমার যেটা বিশ্বাস এবং যারা নগর পরিকল্পনাবিদ তারাও নিশ্চই আমার সাথে একমত হবেন, তিন কোটি মানুষ যদি ঢাকা শহরে হয় তবে সে শহরকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। এই বিশাল নগরবাসীর পানি, স্যুয়ারেজের ব্যবস্থা কি হবে, শিক্ষার অবস্থা কি হবে, ছেলে-মেয়েরা খেলাধুলা কোথায় করবে-এসবের নিশ্চয়তা কে দিতে পারবে? সুতরাং ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন যাতে হতে না হয়, সে ব্যাপারে সকলের সতর্ক থাকা দরকার। আমি মনে করি, কোনভাবেই ঢাকার জনসংখ্যা আর বাড়তে দেয়া উচিত না। আর বস্তি উচ্ছেদের কথা চিন্তা করলেই শুধু চলবে না। বস্তির লোকজনই কিন্তু নগরবাসীকে গুরুত্বপূর্ণ সার্ভিস দিয়ে থাকে-এ কথাটিও মাথায় রাখতে হবে। তারা যদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের সার্ভিস না দেয় তাহলে কিন্তু আমরাও ঢাকা শহরে থাকতে পারবো না। সুতরাং আমি মনে করি, একটি নগরে সব ধরনের লোকজনেরই প্রয়োজন রয়েছে। তবে সবকিছুই করতে হবে পরিকল্পিতভাবে, পরিবেশ রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে মাথায় রেখে। আমি এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে আহবান করবো, প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা এবং তাদের শিক্ষার পরিবেশ সম্পর্কে সকলকে বিশেষ সচেতন হবার জন্য। নানা কারণে দিনে দিনে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বাড়ছে। এদের প্রতি আমাদের দায়িত্বটা যেনো আমরা যথাযথভাবে পালন করতে পারি। কাগজে-কলমে প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা সম্পর্কে অনেক কথা বলা থাকলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যায় না। এই নগরেই অনেক অভিভাবক আজ তাদের প্রতিবন্ধী সন্তানকে নিয়ে বিপদে আছেন। এদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এমন অনেক অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। এদের প্রতি সকলের বিশেষ সহানুভূতিশীল হতে হবে।

shafiullah[1]

ড. এ.এম.এম শফিউল্লাহ

উপাচার্য, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

আজকের আলোচনা থেকে আমরা সবাই একমত, ঢাকায় যে শিক্ষার পরিবেশ, তা কোনভাবেই অনুকূল নয়। তাহলে এখন আমরা কি করবো? আমার মনে হয়, ঢাকা মহানগরীতে সবচাইতে বড় সমস্যা অপরিকল্পিত নগরায়ণ। আমরা ঢাকাকে একটি বদ্ধ নগরীতে পরিণত করেছি। ঢাকার আনকন্ট্রোল গ্রোথ, আনকন্ট্রোল ডেভেলপমেন্ট এখানকার শিক্ষার পরিবেশের জন্য মারাত্মক অন্তরায়। আজকে আমরা যদি পেছন দিকে তাকাই, মোঘল আমলে চলে যাই তবে দেখতে পাবো, সে সময় ঢাকায় ১ লাখ লোকের বসবাস ছিলো। এটি কিন্তু কম নয়, অনেক বড় ব্যাপার। সে সময় বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ঢাকার জনসংখ্যা অনেক বেশিই ছিলো বলতে হবে। তবু সমস্যা হয়নি। কারণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিলো। তখন নদী বা খাল যা ছিলো, বেগুনবাড়ি খাল বা অন্যান্য নদী খাল থাকায় নৌকায় সহজেই কম খরচে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় মানুষ চলাচল করতে পারতো। মালামাল বহন সহজ ছিলো। ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবেও ঢাকার সুখ্যাতি ছিলো যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায়। ঢাকার মসলিনের কথা আমরা জানি। এটিও বড় সুখ্যাতি এনে দিয়েছিলো আমাদেরকে। এই যে সুখ্যাতিগুলো এগুলো কিন্তু পরবর্তী সময়ে হারিয়ে গেছে। এরপর যদি চলে আসি ১৯৫৪ সালের দিকে যখন আমি স্কুলের ছাত্র ছিলাম। আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। তখন ঢাকায় বাসা ভাড়া পাওয়া যেত না। আমার বাবা বাধ্য হয়ে ভূতের গলিতে একটি জায়গা কিনলেন। এখানে একটি টিনের ঘর করার জন্য আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে একটা টিনের ঘর ভাজ করে সোজা নদী পথে বজ্রা নৌকায় সোনারগাঁর পেছনে যে খাল আছে সে খাল দিয়ে একেবারে ভূতের গলি পর্যন্ত নিয়ে আসলেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যে সেই ঘর দাঁড় করিয়ে ফেললেন। আমরা যখন এখানে থাকতাম রাতে শেয়ালের ডাক শুনেছি। বর্ষার সময় আমাদের সেই বাগানবাড়ির একপাশে দাঁড়ালে অনেকদূর পর্যন্ত বিল দেখা যেতো। এ বিলে অনেক পাখি আসতো। সেই ঢাকা আজ কি হয়ে গেছে তা তো আমরা সবাই-ই জানি। কেন হলো সেটি এখন আমরা দেখি। আমরা ঢাকাকে সমস্ত দেশের সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু করলাম। ঢাকায় আসার জন্য সব থেকে ভালো ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো রেল লাইন। আমি যখন বুয়েটে পড়াশোনা করি তখন আমাদের পাশ দিয়ে রেল লাইনটি চলে যেত। টঙ্গী থেকে ১৫ মিনিটে ট্রেন ফুলবাড়িয়া স্টেশনে চলে আসতো। আবার ফুলবাড়িয়া থেকে নদী পথে লঞ্চ-স্টীমারে চড়ে দেশের যেকোন জায়গায় চলে যাওয়া যেত। ঢাকা শহর তখন ছিল এই রেল স্টেশনের দক্ষিণ পার্শ্বে। আর উত্তর পার্শ্বে ছিলো গ্রাম। যেখানে আমি ভূতের গলির কথা বললাম। একদিকে শহর গড়া শুরু হলো আর আমরা মনে করলাম রেল লাইন তুলে ফেলতে হবে। চিন্তাভাবনা না করেই রেল লাইন তুলে ফেললাম, রাস্তা করে দিলাম। আমরা যদি এই রেল লাইনটা মাটির নীচে করে দিতাম, আজ তা এই নগরবাসীর জন্য কত কাজে লাগতো, তা চিন্তা করে দেখুন। ঢাকার মূল সকল জায়গাগুলো এই রেল টাচ করতে পারতো। আমরা সেটিকে উঠিয়ে দিয়ে চিন্তা করলাম কমলাপুরে রেল করা হোক। কারণ, ঢাকা এর বাইরে আর বাড়াব না। এখন কি হয়েছে কমলাপুর হয়ে গেছে হার্ট অব দ্য সিটি। এখন আমরা বলছি এই রেল লাইনও রাখা যাবে না। অথচ আমি ছাত্রাবস্থায় ট্রেনে চড়েই দু’ঘন্টায় ময়মনসিংহ চলে যেতাম। সুযোগ পেলেই বাড়িতে যেতাম। কারণ, যাতায়াতের জন্য উন্নত রেলব্যবস্থা ছিলো। আমরা বাংলাদেশ হওয়ার পরে হাজার হাজার কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করেছি। রেলের কথা এজন্য বলছি যে রেলের সাথে শহরের উন্নয়ন সম্পৃক্ত। আমাদের জন্য কলিকাতাই একটি উদাহরণ হতে পারে। আজও সেখানকার মতো কমিউটার ট্রেন আমরা করতে পারিনি। পারলে ঢাকায় বস্তি থাকতো না। মানুষ সহজে আসতে পারলে দূর থেকেই আসতো। খোলামেলা জায়গায় নিরিবিলি পরিবেশে থাকতো। ঢাকায় আসতো কাজ সেরে চলে যেতো। ইণ্ডিয়াতে কৃষক পণ্য উৎপাদন করে সহজেই ট্রেনে করে শহরে এনে সরাসরি বিক্রি করে আবার ফিরে যাচ্ছে। আমাদের সব কিছু যদি ঢাকাকেন্দ্রিক না হতো তাহলে শিক্ষাব্যবস্থাও উন্নত হতো। ভালো পরিবেশ থাকতো। এ বিষয়গুলো আমাদেরকে ভাবতে হবে। এরপর আমাদেরকে ভাবতে হবে একটি স্কুলে যদি ৫০০ ছাত্র থাকে সে স্কুলের আর্কিটেকচারাল ডিজাইন কেমন হবে। যেখানে শিক্ষার সঠিক পরিবেশ বিরাজ করবে। আমরা বিল্ডিং কোড-এর মতো একটি স্কুলেরও কোড তৈরি করতে পারি, যে এই-ই একটি আদর্শ স্কুলের মডেল। কিন্তু সেটা কি বাস্তবায়ন করতে পারবো? মনে হয় না পারবো! কারণ, সে জায়গা ঢাকা শহরে নেই। আজকে ঢাকাতে বেশিরভাগ স্কুলে ম্যানেজমেন্টের সমস্যা। যে বিজ্ঞ লোকগুলো এখানে থাকার কথা তারা নেই। যে লোকগুলো শিক্ষা দেয়ার কথা তারা নেই। কেন নেই, কেন আমরা ভালো শিক্ষককে আগ্রহী করতে পারছি না, সেটি ভাবতে হবে। আমরা শিক্ষকদেরকে ভালো সুযোগ-সুবিধা দিতে পারছি না, শিক্ষককে সম্মান করছি না। আমার একজন স্কটিশ শিক্ষক ছিলেন যিনি একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ছিলেন কিন্তু তিনি তা ছেড়ে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করলেন। কারণ, তাকে সবাই সম্মান করতো। ইংল্যাণ্ডে প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মনে করলে যে কাউকে সাথে সাথে অ্যারেস্ট করাতে পারেন যদি কেউ তার ছাত্রদের ক্ষতি করে। কোন অভিভাবক ৪ বছর বয়স হওয়ার পরও স্কুলে বাচ্চাকে না পাঠালে তাকে জেল খাটাতে পারেন। আর আমাদের এখানে স্কুল কলেজের শিক্ষকদের থ্রেট করা হয় ভর্তির জন্য, রেজাল্ট ভালো করানোর জন্য ইত্যাদি নানা কারণে। আমার মনে হয়, সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা দরকার। পদ্ধতির পরিবর্তন দরকার, যাতে করে মেধাবী ছাত্ররা মেধার মূল্যায়ন পায় সর্বত্র আর কম মেধাবীরাও যাতে উপেক্ষিত না থাকে, তাদেরকে নিয়েও ভাবতে হবে, কিভাবে কম মেধাবীদের কাজে লাগানো যায়। তবে হতাশার কিছু নেই। ভালো কিছু অবশ্যই আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। আমরা নিশ্চয়ই পারবো। আমি সবশেষে দৈনিক ইত্তেফাকের এই নগরী ও বিএসবি ক্যামব্রিয়ান কলেজকে ধন্যবাদ জানাই শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে এ গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করার জন্য।

মাহাবুবুল হাসান নীরু

প্রধান অতিথি মহোদয়ের বক্তব্য শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে এ গোলটেবিল বৈঠকের সমাপ্তি ঘোষণা করছি। উপস্থিত সকল অতিথিকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

গোলটেবিল বৈঠকের ছবিগুলো তুলেছেন ইয়াসিন বাবুল ও মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর

গোলটেবিল বৈঠক নিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকের রিপোর্ট 

ঢাকায় শিক্ষা ব্যবস্থা চরম সংকটের সম্মুখীন গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা

।। ইত্তেফাক রিপোর্ট ।।

দৈনিক ইত্তেফাকের ‘এই নগরী’ বিভাগ ও বিএসবি গ্লোবাল নেটওয়ার্কের উদ্যোগে মঙ্গলবার গুলশানের অভিজাত রেস্টুরেন্ট স্টেক হাউজে আয়োজিত ‘ঢাকা মহানগরীতে শিক্ষার পরিবেশ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেন, ঢাকা শহরে শিক্ষা ব্যবস্থা চরম সঙ্কটের মুখোমুখি। শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষাদানের মান এবং দ্বিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের গণ্ডিবদ্ধ মানুষে পরিণত করে তুলছে। স্কুলগুলোতে খেলার পরিবেশ নেই, যাতায়াতের অব্যবস্থা, শহর জুড়ে অবিন্যস্ত ও অপরিকল্পিতভাবে স্কুল গড়ে ওঠায় শিক্ষার্থীদের মেধায় পূর্ণ বিকাশ ঘটছে না। এই অচলাবস্থা দূর করতে বক্তারা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে সরকারের প্রতি দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা গ্রহণের সুপারিশ করেন। তা না হলে এই সঙ্কট দিন দিন বাড়বে আর জাতি আধুনিক, মুক্তমনের ভবিষ্যৎ নাগরিক গড়ে তুলতে ব্যর্থ হবে।

এই গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও শিল্পী। তারা প্রত্যেকেই ঢাকা মহানগরীতে শিক্ষার পরিবেশ উন্নয়নে নানামুখী প্রস্তাব রাখেন। বৈঠকের শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিএসবি ফাউন্ডেশন ও ক্যামব্রিয়ান কলেজের চেয়ারম্যান এম কে বাশার। তিনি বলেন, ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে ২১টির বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। আর বনানিতে ১৭টি। অপরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থার এটি শুধুমাত্র একটি দিক। এরকম বহু সমস্যা রয়েছে যার দিক নির্দেশনা আলোচনার মাধ্যমে উঠে এলে আমরা সরকারকে সমস্যা নিরসনে প্রস্তাব দিতে পারবো। এতে সভাপতিত্ব করেন দৈনিক ইত্তেফাকের এই নগরী বিভাগের বিভাগীয় সম্পাদক মাহাবুবুল হাসান নীরু। বৈঠকের সঞ্চালক ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. করুণাময় গোস্বামী। এ গোলটেবিল বৈঠকের প্রধান অতিথি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ এম এম শফিউল্লাহ বলেন, ঢাকা শহরের শিক্ষার পরিবেশ সন্তোষজনক নয়। তিনি প্রস্তাব করেন স্কুলগুলোর জন্য একটি অবকাঠামোগত মডেল তৈরি করে তা সারাদেশে গড়ে তুলতে হবে। সেই সঙ্গে স্কুলগুলোতে পাঠাগার, বিজ্ঞানাগার, খেলার সরঞ্জাম গড়ে তুলতে সরকারের ফান্ড বাড়াতে হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. রোখসানা হাফিজ বলেন, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীরা বাবা-মায়ের সঙ্গে আসে তাই এই স্কুলগুলোর বিন্যাস এমনভাবে করতে হবে যাতে তারা হেঁটে স্কুলে যাওয়া আসা করতে পারে। এছাড়া প্রতিটি ক্যাম্পাসে পঠন পদ্ধতি পরিবর্তন জরুরি। শিক্ষার্থীরা যেন তাদের ভয় না পায়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য অধ্যাপক তাজুল ইসলাম বলেন, মানুষের অনুপাতে ঢাকায় স্কুলের সংখ্যা কমছে। ফলে শিক্ষার্থীর চাপে শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে। এ অবস্থা কাটাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সিটি কর্পোরেশন সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সঙ্গে তিনি ঢাকার বাইরে ১০/১২টি জোনে বিশ্ববিদ্যালয়কে ছড়িয়ে দেয়ার প্রস্তাব করেন। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ময়েজউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রতি ১০ হাজার মানুষের বিপরীতে ১টি প্রাইমারী স্কুল, ৭৫ হাজার মানুষের বিপরীতে ১টি কলেজ থাকবার কথা- সেটা রাজধানীতে নেই। প্রয়োজনীয় কাঠামো যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জরুরি সেখানে শিক্ষকদের বেতনেই বরাদ্দের টাকা শেষ হয়ে যায়। এর ফলে অন্যান্য খাতের উন্নতি হয় না। এগুলো কাটিয়ে উঠবার ব্যবস্থা সরকারকেই নিতে হবে।

কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলন বলেন, স্বাধীনতার পর যে পরিকল্পনা নিয়ে একটি দেশের গড়ে উঠবার কথা কোন বিষয়েই সেই অগ্রগতি ঘটেনি। শিক্ষার ক্ষেত্রেও তাই। সেই অধঃপতনের গতি প্রতিদিনই বাড়ছে। উপস্থাপক আবদুন নূর তুষার বলেন, দেশে আর কোন বই বদল না হলেও ইতিহাসের বই বদল হতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন প্রথমে ঠিক করেছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৫ একর জমি লাগবে। পরে তা ১ একর নির্ধারণ হয়। আর এখন তো দেখা যায়, ৫ কাঠায় ২০ তলা বিল্ডিংয়ের কয়েকটি ফ্লোর নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। তিনি বলেন, সবকিছুতে আপোষ করছি। যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রতিনিধিদের বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

কন্ঠশিল্পী মেহরীন বলেন, স্কুলগুলোতে এমন কারিকুলাম ও ব্যবস্থাপনা দরকার যাতে আমার সন্তানকে বিনা দ্বিধায় বাংলা মাধ্যমে ভর্তি করাতে পারি। ক্লাস ওয়ানে যে ভর্তিযুদ্ধ হয় এটা ভীতিকর।

এ বৈঠকে আরো বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. এ কিউ এম মাহবুব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার বজলুল হক, ইবাইস ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. জাকারিয়া লিংকন, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের স্থাপত্য বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আজ সাঈদ, অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. কবীর হোসেন তালুকদার, পরিবেশ বাঁচা ও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, ঢাকা ইম্পেরিয়াল কলেজের অধ্যাপক মাহফুজুল হক শাহীন ও গ্রীন ইউনিভার্সিটির ভাইস চেয়ারম্যান ড. মকবুল আহমেদ ।

জাতীয় শিক্ষানীতি ও বিদেশে উচ্চশিক্ষা

এই নগরী, দৈনিক ইত্তেফাক-ক্যামব্রিয়ান কলেজ, বিএসবি গোলটেবিল বৈঠক

গোলটেবিল বৈঠকের একটি মুহূর্ত

গোলটেবিল বৈঠকের একটি মুহূর্ত

২৬ মে, ২০০৮, সোমবার গুলশানের স্টেক হাউজে দৈনিক ইত্তেফাকের এই নগরী ও বিএসবি ফাউন্ডেশন এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের সঞ্চালনায় বৈঠকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. জসিম উদ্দিন, বাংলাদেশ শিশু একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক জুবাইদা গুলশান আরা, ক্যাম্ব্রিয়ান কলেজের অধ্যক্ষ ড. করুনাময় গোস্বামী, কলেজ অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজীর অধ্যক্ষ অধ্যাপক এম এ কাশেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. একে মনোওয়ার উদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক ড. মো: শফিকুল ইসলাম, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, ফেড-ক্যাবের সেক্রেটারী জেনারেল একেএম নাজমুল হক জামালী, নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক ড. রোকেয়া কবীর, আইইডির নির্বাহী পরিচালক নুমান আহম্মদ খান, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ফাস্ট এসিসটেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট হুমায়রা চিনু প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিএসবি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান লায়ন এম কে বাশার এবং সভাপতিত্ব করেন এই নগরীর বিভাগীয় সম্পাদক মাহাবুবুল হাসান নীরু।

নিচে তাঁদের উপস্থাপিত বক্তব্য সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো-

niru4[1]

মা হা বু বু ল  হা সা ন  নী রু

সভাপতি ॥ বিভাগীয় সম্পাদক, এই নগরী, দৈনিক ইত্তেফাক

স্টেক হাউসের এই চমৎকার মনোমুগ্ধকর সন্ধ্যায় আপনাদের সবাইকে জানাচ্ছি শুভেচ্ছা। আমাদের আজকের গোলটেবিল বৈঠকের বিষয় হচ্ছে,‘জাতীয় শিক্ষানীতি ও বিদেশে উচ্চশিক্ষা’। দৈনিক ইত্তেফাকের সাপ্তাহিক আয়োজন এই নগরী এ বিষয়টি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনের তাগিদ অনুভব করেছে মূলত জাতীয় শিক্ষার দুরবস্থা, শহরমুখী শিক্ষার বিরূপ প্রসার, শিক্ষায় গ্রাম-শহর, নারী-পুরুষ ও উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত শ্রেণী বৈষম্য-ইত্যাদি নানা অনিয়ম, অব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করে। রাজধানী শহর ঢাকার শিক্ষার পরিবেশ মোটেও সুখকর নয়, যা নিয়ে আমরা ইতিপূর্বে একটা গোলটেবিল বৈঠক করেছি। এই ঢাকা মহানগরীতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বলা যায় যার একটা বাড়ি আছে সে-ই উৎসাহিত হচ্ছে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে, কেননা আজ এটা একটা লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। নগরের অভিজাত এলাকাগুলো জুড়ে তো এখন বাড়িতে বাড়িতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ধানমণ্ডি এলাকা রীতিমতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডিপোতে পরিণত হয়েছে। এই এলাকায় যে কতো ধাঁচের কতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, তা বোধকরি গুণে শেষ করা যাবে না। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রদান করা হচ্ছে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আবার বিদেশে উচ্চশিক্ষারও বন্দোবস্ত করে থাকে। এক্ষেত্রে কতোটা নিয়ম মানা হচ্ছে? কি শিক্ষা দেয়া হচ্ছে নগরীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে? এজন্য একটি প্রকৃত ও সমৃদ্ধ শিক্ষানীতি কতোটা জরুরী? পাশাপাশি আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিদেশে উচ্চশিক্ষাটা কতোটা যৌক্তিক? এই উপলব্ধি থেকে সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বিএসবি ফাউণ্ডেশনকে সাথে নিয়ে ‘এই নগরী’র যৌথ আয়োজন। আমার বিশ্বাস, আজকের গোলটেবিল বৈঠকের মধ্য দিয়ে এমন কিছু বক্তব্য, পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা উঠে আসবে, যা একটি সুন্দর সমৃদ্ধ শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। আমি আজকের বৈঠকের সঞ্চালক জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শ্রদ্ধাভাজন ইমদাদুল হক মিলনকে আলোচনা পর্ব শুরু করার জন্য অনুরোধ করছি।

milon[1]

ই ম দা দু ল  হ ক  মি ল ন

সঞ্চালক ॥ কথাসাহিত্যিক

শুভ সন্ধ্যা, প্রিয় সুধীমণ্ডলী। দৈনিক ইত্তেফাক এবং ক্যামব্রিয়ান কলেজ বিএসবি আয়োজিত আজকের এই গোলটেবিল বৈঠকে আমি আপনাদেরকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমাদের আজকের বিষয় ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ও বিদেশে উচ্চশিক্ষা’। আপনারা যারা এখানে উপস্থিত আছেন, আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি যে, এই মানুষগুলো শিক্ষার সঙ্গে জড়িত এবং আমাদের দেশ যতটা এগিয়েছে বা আরও যতদূর এগিয়ে যাবে তার পেছনে আপনাদের অবদান অনস্বীকার্য। আমি শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য রাখার জন্য লায়ন এম.কে. বাশারকে অনুরোধ করছি।

bashar[1]

লা য় ন  এ ম. কে. বা শা র  পিএমজেএফ

চেয়ারম্যান, বিএসবি ফাইন্ডেশন ও ক্যামব্রিয়ান কলেজ

আমরা জানি, স্বাধীনতার ৩৭ বছর পরও বাংলাদেশে জাতীয় কোন শিক্ষানীতি ঘোষণা করা হয়নি এবং একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের ব্যাপারে আমাদের দেশের সরকারগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কমিশন গঠন করেছিল, বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিল কিন্তু আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সুধীজনদের মতামতগুলোকে একসাথে করে একটি সুপারিশমালা প্রস্তুত করতে চাই।

যা জাতীয় শিক্ষানীতি তৈরির ক্ষেত্রে একটি গ্রাউণ্ড ওয়ার্ক হতে পারে।

আমরা জানি, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ১০/১৫ হাজার শিক্ষার্থী স্ব-অর্থায়নে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে গমন করে থাকে প্রায় ২০০টি কনসাল্টিং ফার্মের মাধ্যমে। আর এসব ছাত্র-ছাত্রীদের বিদেশে যাওয়ার সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করে স্টুডেন্ট কনসাল্টিং ফার্মগুলো।

ইতোমধ্যে বিদেশে পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে সরকার প্রতিবছর ১২ কোটি টাকার অধিক রাজস্ব পাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে এই রাজস্বের পরিমাণ আরও বাড়বে। বিদেশে যারা পড়তে যায় তাদের নিকট থেকে যেসব খাতে যে হারে রেভিনিউ পেতে পারে সরকার তাহলো-

নো অবজেকশন সার্টিফিকেটের জন্য ১০০০ টাকা। সার্টিফিকেট, মার্কশিট ভেরিফিকেশন এবং এ্যাটাসটেশনের জন্য ১০০০ টাকা। স্টুডেন্ট ব্যাংক ফাইল ওপেনের সময় ব্যয় করতে হয় ৩৫০০ টাকা। ভ্যাট ও ট্যাক্স নেয়া হয় ৫২৫ টাকা। রেমিটেশন ট্রান্সফারের ক্ষেত্রে ২০০০ টাকা।

সরকার যদি একটা নীতিমালার আওতায় এসব স্টুডেন্ট কনসাল্টিং ফার্মগুলোকে নিয়ে আসে সেক্ষেত্রে প্রতিটি ফার্মের জন্য ১০ লাখ টাকা সিকিউরিটি মানি নির্ধারণ করে দিলে এ খাত থেকে ২০ কোটি টাকা সঞ্চয় করা সম্ভব। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, পরোক্ষভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখছে বিদেশে পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা। বিদেশে যেয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা শুধু উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে না, এরা খণ্ডকালীন সময়ে চাকরি করে প্রতিবছর প্রায় একশত কোটি টাকা উপার্জন করে থাকে। এরাই আবার পড়া শেষে প্রতিমাসে দুই থেকে তিন লাখ টাকা বেতনে চাকরি করে বিদেশে। এই সামান্যতম পরিসংখ্যান থেকে যে চিত্রটি পরিষ্কার হয়ে দাঁড়ায় তা হচ্ছে, স্টুডেন্ট কনসাল্টিং ফার্মগুলো জাতির উচ্চ শিক্ষার পথকে শুধু উন্মুক্ত করেই দিচ্ছে না দেশকে অর্থনীতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য চ্যালেঞ্জিং বিশাল দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এছাড়া এই পেশায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মরত রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। এতে বেকার সমস্যাও লাঘব হচ্ছে। বর্তমানে বিদেশে প্রায় ২ লাখ বাংলাদেশী ছাত্র রয়েছে। গড়ে যদি প্রতি ছাত্র ৫০ হাজার টাকা আয় করে তবে মাসে তারা উপার্জন করছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। বছরে এর হিসাব এসে দাঁড়ায় ১২শ কোটি টাকা। এমন অনেক ছাত্র-ছাত্রী উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত যারা বিদেশে চাকরি করছে যাদের মাসিক উপার্জন কম করে হলেও ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। এমন ছাত্র সংখ্যা হবে প্রায় লক্ষাধিক। তারাও উপার্জন করে থাকে প্রায় ২ শত কোটি টাকা। বছর শেষে আয় করে প্রায় ২৪শত কোটি টাকা। অর্থাৎ সরকারের কোন ধরনের বিনিয়োগ ব্যতিরেকে প্রতিবছর প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা উপার্জন হচ্ছে এই খাত থেকে। সরকার এই খাত থেকে প্রতিবছর যে পরিমাণ রেমিটেন্স পেয়ে থাকে তা যদি উচ্চশিক্ষার জন্য স্ট্যাডি লোন হিসেবে আবার ছাত্র-ছাত্রীদের প্রদান করা হয়, তাহলে একদিকে দেশ যেমন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবে অন্যদিকে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরাও বিদেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাবে।

গোলটেবিল বৈঠক নিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকের দু'পৃষ্ঠার বিশেষ ক্রোড়পত্র

গোলটেবিল বৈঠক নিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকের দু’পৃষ্ঠার বিশেষ ক্রোড়পত্র

শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহ এ ব্যাপারে পজেটিভ ভূমিকা নিলে পোশাক শিল্প খাত থেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসে সরকারের শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগের বিনিময়ে তার চেয়ে বেশি আসবে আমাদের এই শিক্ষা খাত থেকে।

বিদেশী ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির বিষয়টি একটি আইনের আওতায় এনে জবাবদিহিতার মধ্যে রাখা দরকার। এ ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত। যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্টুডেন্ট কনসাল্টিং ফার্মগুলো সঠিক এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে।

বিদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংকগুলো যাতে শিক্ষার্থীদের জন্য স্টাডি লোন প্রদান করে সে ব্যাপারে সরকারের নির্দেশনা থাকা দরকার। এডভান্স ডিপ্লোমা কোর্সে পড়তে যাওয়ার ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স সুবিধাসমূহ বন্ধ রয়েছে। তা পুনরায় চালু হওয়া দরকার। সারা বিশ্বে আমাদের দূতাবাস রয়েছে। এসব দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে বিদেশে উচ্চশিক্ষার পথকে আরও সম্প্রসারিত করা যায়। এছাড়া বহির্বিশ্বে আমাদের দূতাবাসগুলো নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে বিদেশের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রকে আরও বাড়ানো যায়। এজন্য এসব দূতাবাসগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আরো সক্রিয় করার ব্যাপারে এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। বিদেশে উচ্চশিক্ষার পথকে আইন করে বন্ধ করা যায় না। এতে কেবলমাত্র একশ্রেণীর লোক উপকৃত হবে। আর অন্যদিকে সবশ্রেণীর মানুষের জন্য বিদেশে উচ্চশিক্ষার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের দেশে বহু শিক্ষিত ব্যক্তি রয়েছেন যাদের পেছনে বহু বিদেশী ডিগ্রী রয়েছে। এরা হয় ধনী শ্রেণীর কিংবা সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ের কোন আমলা, বুদ্ধিজীবী শ্রেণীভুক্ত। কিন্তু আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এমন নীতিমালা অনুসরণ করা দরকার, যেখানে উচ্চশিক্ষার পথ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে।

বিদেশ থেকে ডিপ্লোমা কিংবা উচ্চতর ডিপ্লোমা কোর্সগুলোতে অধিকমাত্রায় লেখাপড়ার সুযোগ থাকলে দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। আর এসব ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে এমন কিছু করা উচিত নয়।

zasim[1]

প্র ফে স র  ড.  জ সি ম  উ দ্দী ন  আ হ মে দ

সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আমরা বর্তমানে এক নতুন সহস্রাব্দ অর্থাৎ মিলেনিয়ামের উষালগ্নে রয়েছি। এ সময়টায় চলছে বিশ্বব্যাপী জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের প্রতিযোগিতা। যে দেশ বা জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞানে যত উন্নত, তারাই প্রতিযোগিতায় শীর্ষে রয়েছে। এই নতুন মিলেনিয়ামে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য উচ্চ শিক্ষায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাকে সবিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা প্রদানের জন্য বর্তমানে ২৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৫৪টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, ১৪টি সরকারী মেডিকেল কলেজ (ডেন্টালসহ), ২৭টি বেসরকারী মেডিকেল কলেজ এবং ৭০টি আইন কলেজ এবং ৩১৫০টি সাধারণ কলেজ (উচ্চ মাধ্যমিকসহ) রয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৯৮৩ সালে যেখানে ৩৭,০৭৮ জন ছাত্র-ছাত্রী ছিল, ২০০৫ সালে তা বেড়ে ১০,৭৩,৭২৬ জনে পৌঁছে। তবে এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজে বেশিরভাগ অর্থাৎ ৭,৫৫,৫৮৮ জন এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ২,৩১,৭৪১ জন ছাত্রছাত্রী। তাই অন্যান্য সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৫ সালে মোট ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১,১৬,৩৯৭ জন। অন্যদিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একই সালের মোট ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৮,৪৭৪ জন। ২০০৫ সালে দেশের সবগুলো শিক্ষা বোর্ড থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ২,৬৩,৪৫৮ জন ছাত্র-ছাত্রী উত্তীর্ণ হয়। এদের ভেতর প্রায় ৩০ হাজার বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে (সাধারণ, প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) এবং প্রায় ২ হাজার বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পায় (২০০৩ সালের তথ্য অনুযায়ী)। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয় (তথ্যসমূহ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ-২০০৬ থেকে নেয়া হয়েছে)। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার খরচ কয়েকশ’ গুণ বেশি বলে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সন্তানদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া প্রায় অসম্ভব। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ২ লক্ষেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রীকে তাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন কলেজে ভর্তি হতে হয়। কলেজগুলোতে শিক্ষক স্বল্পতা ও ল্যাবরেটরী যন্ত্রপাতি এবং বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণের অপ্রতুলতার কারণে শিক্ষার মান তত উন্নত নয় বলে অনেকেই স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে কলেজে ভর্তি হতে চায় না। তারা দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ভর্তি হতে না পারলে অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানেরা বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য যেতে চেষ্টা করে। এদের বেশিরভাগই প্রতিবেশী দেশ ভারতে যায়। ভর্তির বেশি সুযোগ, ইউরোপ, আমেরিকার তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম খরচ এবং ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে কম কড়াকড়ি, এসব কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক ছেলেমেয়ে ভারতে পড়াশোনা করতে যাচ্ছে। আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশেও স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করার জন্য প্রতি বছর কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রী যায়। এদের অধিকাংশই উচ্চ মধ্যবিত্ত বা ধনী পরিবারের সন্তান এবং তুলনামূলকভাবে অধিক মেধাসম্পন্ন। ঐসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ভর্তি হতে হলে ছাত্র-ছাত্রীদের ইংরেজী দক্ষতার জন্য কৃএঋী বা অঋীকও কর্ণ্র এ ভাল স্কোরসহ স্নাতক পর্যায়ের জন্য ওইক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের জন্য ঐৗঋ/ঐুইক এ ভাল স্কোর থাকতে হয়। তাই উন্নত বিশ্বে দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা আণ্ডার গ্রাজুয়েট পর্যায়ে পড়াশোনা করতে যায় তারা মেধাবী এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এ পর্যায়ে স্কলারশীপের তেমন কোন ব্যবস্থা না থাকায় ৪/৫ বছরের লেখাপড়ায় জনপ্রতি প্রায় ৫০ লক্ষের মত টাকা খরচ হয়। এদের বেশিরভাগই দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান ও পরিবেশের কারণে উন্নত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যায় ছাত্ররা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তার কারণ হলো এদের সিংহভাগই শিক্ষা সমাপান্তে দেশে ফিরে আসতে চায় না। আর সত্যিকথা বলতে গেলে এরা দেশে ফিরে আসলে ওদের মেধা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর তেমন সুযোগ আমরা দেশে সৃষ্টি করতে পারছি না। অন্যদিকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশোনা ও গবেষণার জন্যও প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী বিদেশে যাচ্ছে। এরা উন্নত দেশের গবেষণাগারগুলোতে গবেষণার সুযোগ পায়। এই পর্যায়ে পড়াশোনার জন্য স্কলারশীপ, এসিট্যান্টশীপ ইত্যাদির বেশ সুযোগ রয়েছে। অতীতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে যারাই উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে যেতেন তাদের বেশিরভাগই শিক্ষা সমাপান্তে দেশে ফিরে আসতো। কিন্তু বর্তমানের অবস্থা ভিন্ন। এখন বেশিরভাগ বিদেশেই থেকে যেতে চায়। এভাবে আমাদের দেশের মেধা পাচার হচ্ছে। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে শিক্ষক ও গবেষণাকর্মীরা তাত্ত্বিক ও প্রয়োজনীয় উভয় ধরনের গবেষণা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে যেতে পারছে না। তাই উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবধান ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলেছে। এর ফলেও উন্নত দেশগুলোতে মেধা পাচারের প্রক্রিয়া বেগবান হচ্ছে।

বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য জাতীয় শিক্ষানীতিতে সুস্পষ্ট প্রস্তাবনা থাকা অপরিহার্য। যেসব ক্ষেত্রে দেশে পর্যাপ্ত শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে বিদেশে উচ্চশিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। আণ্ডার গ্রাজুয়েট পর্যায়ে বিদেশে শিক্ষাকেও নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। তবে এজন্য দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ্য সব ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষার ব্যবস্থা এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেশনজট নিরসনের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং অঙ্গসংগঠনভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষক রাজনীতির কারণে যেন শিক্ষা ব্যবস্থা বিপর্যস্থ না হয় সে দিকটাও খেয়াল রাখতে হবে।

উচ্চশিক্ষার জন্য প্রয়োজনে অবশ্যই উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেতে হবে তবে এক্ষেত্রে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা ও গবেষণাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিক্ষাজীবন শেষ করে ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে দেশে ফিরে আসতে উৎসাহিত হয় জাতীয় পর্যায়ে সে ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। তাহলে উন্নত দেশগুলোর শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে ক্রমে ক্রমে আমাদের দেশের শিক্ষা ও গবেষণা মানে যে ব্যবধান হচ্ছে, তা ঘুচে যাবে। একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় শিক্ষানীতিতে অবশ্যই এ ব্যাপারে সঠিক দিক-নির্দেশনা থাকতে হবে।

ইমদাদুল হক মিলন

আমরা প্রফেসর ড. জসিম উদ্দীন আহমেদের আলোচনা থেকে বেশ কিছু বিষয় জানতে পারলাম। আপনি মোটামুটি একটা পরিসংখ্যানও দিয়েছেন। তবে আমি আপনাদের সকলকে একটু অনুরোধ জানাবো আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি- এই নীতিটা কেমন হওয়া উচিত, তার চেহারা কেমন, এখন প্রচলিত যে নীতি রয়েছে তার পরিবর্তে আমরা আরও ভালো কি পেতে পারি, সেদিকটির ওপরে জোর দেবেন।

rokeya[1]

রো কে য়া  ক বী র

নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ

আমরা পাকিস্তান আমল থেকেই দেখেছি যে, শিক্ষানীতি নিয়ে আন্দোলন হয়েছে তখন যে শিক্ষানীতি ছিলো তার বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশ হওয়ার পরও। এক সরকার আসে এক ধরনের শিক্ষানীতি দেয়, আরেকজন তা পরিবর্তন করে আরেক ধরনের শিক্ষানীতি দিতে চেষ্টা করে। কতগুলো জিনিস হচ্ছে-পলিসি গাইড লাইন আছে, আর কতগুলো হলো প্র্যাকটিক্যাল সাজেশন। প্র্যাকটিক্যাল সাজেশনগুলো কিন্তু শিক্ষানীতিগুলোতে থাকে না। সঠিক শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষাবিদেরা যে কাজগুলো করছেন সেক্ষেত্রে আশানুরূপ সাফল্য আমাদের আসেনি। এখানে শিক্ষানীতির ভিত্তিটা কি হবে? কন্সটিটিউশনে দেয়া আছে। সেটার ওপর ভিত্তি করে কিন্তু হতে হবে। আজকাল ইংলিশ মিডিয়াম বলেন, পাবলিক ইন্সটিটিউশনগুলো বলেন, প্রত্যেকটাতে একই অবস্থা। ইংলিশ মিডিয়ামগুলোতেও আমি দেখেছি মুখস্ত করে টিচাররা শেখাচ্ছে। এদেশে বেশিরভাগ টিচাররা বাসায় বইগুলো মুখস্ত করে ছাত্রছাত্রীদেরকে তা-ই শেখাচ্ছে। আমি অনেক অভিযোগ পেয়েছি যে, টিচাররা যেভাবে বলছে ছাত্ররা যদি একটু এদিক সেদিক করে উত্তর দেয় তবে তারা ছাত্রছাত্রীদেরকে নাম্বার কেটে দেয়। এই অবস্থা আমাদের। আজকে শহর এবং গ্রামের শিক্ষা পদ্ধতিতে পার্থক্যের কথা এসেছে। ঠিক আছে, কিছু পার্থক্য আছে। সেখানে কিন্তু টেকনিক্যাল জিনিস নেই। টেকনোলজির অভাব। কিন্তু আমরা যদি শিক্ষানীতিটা এরকম করি যে শহরে বা গ্রামে যেখানেই হোক যে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করবে তাদের যদি কতগুলো বেসিক জিনিস ঠিক করতে পারি মানে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়লে তারা কি দক্ষতা নিয়ে বের হবে, ইন্টারমিডিয়েটে তারা কোন ধরনের দক্ষতা নিয়ে বের হবে এটার একটা দিক-নির্দেশনা আমরা যদি ঠিক করি তারপরে আমরা ব্যাক ক্যালকুলেশন করে সাবজেক্টগুলো সাজাতে পারি। একই সাথে আমাদের লাইফ স্কিল্ড সম্পর্কে একটা ওরিয়েন্টেশন থাকা দরকার। মুখস্ত বিদ্যা না যে ‘সকালে ও রাতে দাঁত মাজতে হবে’ বা ‘পানি ফুঁটিয়ে বিশুদ্ধ করে খেতে হবে’। কিন্তু কী কারণে দাঁত মাজতে হবে আর কেনই বা পানি ফুঁটিয়ে খেতে হবে সেটি কিন্তু আমাদেরকে বুঝতে হবে-এভাবে লজিক দিয়ে কথাগুলো বোঝাতে হবে। তাদেরকে আশপাশের উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে হবে যে মিথ্যা কথা বললে কি ক্ষতি হতে পারে, দুর্নীতি করলে কি ক্ষতি হতে পারে-এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীদেরকে ধারণা দিতে হবে। ঢাকা শহরে বসবাস করবে, কিভাবে ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট করবে, চলাফেরা করার ক্ষেত্রে ট্রাফিক রুলস রেগুলেশন কি হবে- সেসব বিষয়ে সম্যক ধারণা তাদেরকে দিতে হবে। গ্রামে যে ছেলেটি পড়ছে শহরের ছেলেটির মতো সেও জিওগ্রাফী সম্পর্কে জানবে, সংবিধান সম্পর্ক জানবে, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী সম্পর্কে সম্যাক ধারণা রাখবে, সয়েল সায়েন্স সম্পর্কে জানবে, ফিজিওলজি হেলথ এণ্ড হাইজিন সম্পর্কে বেসিক ধারণা রাখবে। সুতরাং, এগুলো সম্পর্কে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত সকল ছাত্রছাত্রীকে অবশ্যই ধারণা দিতে হবে। তাদের থেকেই শিক্ষাবঞ্চিত শ্রেণীর মাঝে এসব বিষয়ে সচেতনতামূলক ধারণা জন্মানো সম্ভব হবে। আর একটি বিষয় হচ্ছে, একজন ছাত্রের মধ্যে সেই ব্যাপারটি ঢোকাতে হবে, যাতে সে যে বিষয়েই কথা বলুক না কেন, তার কথায় যেন বাস্তবিক অর্থে যুক্তি থাকে এবং সেও যেন বোঝে যে আমার কথা যুক্তিসঙ্গত কি’না, সে ভাবনাটি তার মধ্যে জাগ্রত করে দিতে হবে। তবেই একটা কাঙিক্ষত ফল আমরা পাবো।

ইমদাদুল হক মিলন

আপা, আপনি ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত একটা বেসিক নলেজের কথা বললেন যে, প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে এটলিস্ট ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত একটা লেবেল করে দেয়া উচিত কিন্তু এক্ষেত্রে কি আপনার মনে হয় তার আগে শিক্ষকদেরকে তৈরি করবার কোন ব্যাপার আছে? এ বিষয়টির অবতারণা আমি এ জন্যেই করলাম যে, বিভিন্ন কারণে আমাকে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়াতে হয়। স্কুল কলেজগুলোর সাথে আমার একটা যোগাযোগ রয়েছে। আমি লক্ষ্য করছি যে, দুঃখজনকভাবে ঐ লেবেলের শিক্ষকদের মধ্যেও একটা বড় রকমের ত্রুটি রয়ে গেছে। আমার মনে হয় যে, তৃণমূল পর্যায় থেকেই বিষয়টি আসা উচিত। প্রাইমারী লেবেলের চেহারাটা আসলে কেমন- সে বিষয়টি যদি আলোকপাত করেন-

রোকেয়া কবীর

আমাদেরকে প্রথমেই মেথোডলজীর কথা চিন্তা করতে হবে। এর সাথে কিন্তু টিচারদের স্কিল্ড, ক্যাপাসিটি, নলেজ, ইনফরমেশন-এই চারটি জিনিস বেসিক্যালি জড়িত। সুতরাং, এগুলোও কিন্তু আমাদের শিক্ষকদের সাথে জড়িত। এ কারণে এটিও একই সাথে চিন্তা করতে হবে। আর একটি দিক হচ্ছে, সামাজিক বিষয়াবলী এবং সে সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের ধারণা। যেমন, আমরা যদি ট্রাফিক আইন শেখানোর জন্য ট্রাফিক পুলিশকে প্রাইমারী স্কুলে এনে কোন ক্লাসে বা সব ক্লাস এক করে একটা সময় তাদেরকে নিয়ে যদি আলাপচারিতায় যাই তবে উভয়ের মধ্যে কিন্তু একটা দাযিত্ব বোধ তৈরি হবে। পুলিশের মধ্যেও ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটা রেসপন্সিবিলিটি গ্রো করবে এবং ছেলেমেয়েদের মধ্যেও এক একটা বিষয়ে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হবে। সামাজিক এমন নানা বিষয়গুলো সম্পর্কে একই পন্থায় একটা যোগসূত্র স্থাপন এবং শিক্ষাদান সম্ভব। সুতরাং, শিক্ষকদের ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাদেরকেও ট্রেইন্ডআপ করা প্রয়োজন।

ইমদাদুল হক মিলন

ড. করুণাময় গোস্বামী স্যার, আপনার কাছে জানতে চাইছি আমাদের যে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ আছে, সেখানে যারা কাজ করছেন, টিচারদের দক্ষতা বাড়াতে তাদের ভূমিকা কতটুকু, তাদের শিক্ষাদান পদ্ধতিটা কতোটা কার্যকর?

karunamoy[1]

ড. ক রু ণা ম য়  গো স্বা মী

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, অধ্যক্ষ, ক্যামব্রিয়ান কলেজ, ঢাকা

আমি অনেক সময়ই দেখেছি যারা বি.এড, এম.এড ট্রেনিং পাননি তারাই ট্রেনিংপ্রাপ্তদের থেকে ভালো করছে। ফলে আমার মনে হয়েছে, এই শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কেন? কি তাদের টার্গেট এটি আমার কাছে স্পষ্ট নয়। আমি যেসব শিক্ষকের কাছে পড়েছি তারা কেউ কোনদিনও বি.এড, এম.এড করে যাননি এবং বি.এড, এম.এড করেছেন এমন অনেক শিক্ষককে দেখি তারা সাধারণ প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারে না। আমি যে লোকটাকে ট্রেনিং দিচ্ছি-কেন ট্রেনিং দিচ্ছি, কি ট্রেনিং দিচ্ছি, সে এই ট্রেনিং শেষ করে কি ডেলিভার করবে, তা কিন্তু ভাবতে হবে। নায়েমে এক ধরনের ট্রেনিং দেয়া হয়-নিয়ে যায়, ব্যায়াম করায়-এ করায় তা করায়। এভাবে এক মাসের একটা ট্রেনিং করায়, কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়-যা সম্পুর্ণ অর্থহীন। তাই আমার মনে হয় শিক্ষানীতির মধ্যে টিচার্স ট্রেনিং প্রসঙ্গে একটা পরিপূর্ণ দিক নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। যে যে সাবজেক্ট পড়াবেন তাকে সে সে বিষয়ে পারদর্শী করে তোলা দরকার। তা না হলে আমরা আমাদের কাঙিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো না। আমাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষিতের হার বাড়ছে কিন্তু কর্মসংস্থানের সুযোগ তেমন সৃষ্টি হচ্ছে না। এখন একটি ছেলে বা মেয়েকে যদি অস্ট্রেলিয়ায় কাজ করতে হয়, ইংল্যাণ্ডে কাজ করতে হয়, কানাডায় কাজ করতে হয় তবে তাকেতো সেখানকার মতো করে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলে তবেই না সেখানে পাঠাতে হবে। তারপরও যেটুকু বাকী থাকে সেটুকু সে ওখানে গিয়ে বুঝে-শুনে শিখে নিতে পারবে। অর্থাৎ এখন আমাদেরকে সে বিষয়ের প্রতিও নজর দিতে হবে। শিক্ষানীতির যে কথাটা উঠেছে, শিক্ষানীতিতে সে বিষয়টির দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। বিদেশে যে ছেলেমেয়েরা যাবে এটি ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু সরকার কতটুকু ফ্যাসিলেটেট করতে পারবে সেটি নির্ধারণ করা দরকার। আজ যে কথা আসছে বিদেশে শুধু উচ্চবিত্তের ছেলেমেয়েরাই পড়াশোনা করতে যেতে পারছে। এখন প্রশ্ন-উচ্চবিত্ত শ্রেণীর লোক সংখ্যা কত বাংলাদেশে? নিশ্চয়ই খুব বেশি নয়? তাহলে বৃহৎ অংশ হচ্ছে নিম্নমধ্য বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কোটি কোটি মানুষ। তাদের ছেলেমেয়েরা যদি বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য যেতে না পারে তবে তো দেশ পিছিয়ে পড়বে। দেশ সামগ্রিকভাবে জাগতে পারবে না। আমরা চাই, সমাজটা পুরোপুরি ভাবেই জাগবে। সব মানুষ জাগবে। তার জন্য সরকারকেই সাপোর্ট দিতে হবে। এছাড়া সরকার যদি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে এমন একটা চুক্তিতে আসতে পারে যে, ‘এই পরিমাণ’র আয়ের পরিবারের ছেলেমেয়েরা যদি বিদেশে লেখাপড়া করতে যায় তবে তাদেরকে ‘এই পরিমাণ’ অর্থের সংস্থান তোমরা করবে। যাতে ভিসার জন্য তাদেরকে না আটকায় বা অন্যান্য সমস্যা না হয়। একটি কথা আসতে পারে যে, বিদেশে না পাঠিয়ে আমাদের এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করা যায় কিনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান বাড়ানো যায় কি না, শিক্ষার পরিবেশ সুষ্ঠু করা যায় কি না এবং উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায় কি না? তা করতে পারলে ভালো এবং তা আমাদের জন্য প্রয়োজন, অবশ্যই প্রয়োজন। তবে একটি বিষয় হচ্ছে যে, যে শিক্ষার্থী বিদেশে গিয়ে পড়তে চাইবে আমরাতো তাকে বাঁধা দিতে পারি না। আর একটি দিক হলো, আমাদের দেশে কোন ভালো কোম্পানিতে বা সরকারী কোন প্রতিষ্ঠানেও যদি কোন চাকরিতে বিদেশ থেকে ডিগ্রী নেয়া কোন ছেলেমেয়ে এবং দেশ থেকে ডিগ্রী অর্জন করা কোন ছেলে/মেয়ে একই সাথে এপ্লাই করে খুব স্বাভাবিকভাবেই বিদেশ থেকে ডিগ্রী অর্জিত ছেলেমেয়েটি এগিয়ে থাকবে। এই মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। আমাদেরকে যোগ্যতার মাপকাঠিতে বিচার করতে হবে। আরেকটি দিক হলো কমশিক্ষিত ছেলেমেয়েকে কারিগরী দক্ষতা ও ইংরেজী শিখিয়ে বিদেশে কাজের জন্য পাঠানো যেতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারকেই নিয়মনীতি করে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আর এতেই দেশের লাভ হবে বেশি। কারণ, একটা উচ্চশিক্ষিত ছেলে কিছুদিন বিদেশে থাকার পর সে সেখানে একটা গাড়ি কিনবে, বাড়ি কিনবে, তারপর এদেশের বাড়িঘর বিক্রি করে সে টাকাও ওখানে নিয়ে গিয়ে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকেও নিয়ে সেখানেই বসবাস শুরু করবে। এই তো আমাদের দেখা। সুতরাং, গরীব ঘরের ছেলেমেয়েদের সাপোর্ট করা দরকার। তাতে দেশও লাভবান হবে।

ইমদাদুল হক মিলন

ডঃ করুণাময় গোস্বামীর আলোচনা থেকে আমরা একটি বিষয়ের ওপর জোর দেয়া দরকার এমন একটি ধারণা পেলাম-তাহলো, সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষেরই শিক্ষার জন্য সরকারী ব্যবস্থাপনাটাও এমন হওয়া দরকার যাতে তারাও যেন বিদেশে গিয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে এবং তাতে করেই দেশ অধিক লাভবান হবে।

monwar3[1]

ড. এ. কে ম নো ও য়া র  উ দ্দী ন  আ হ মে দ

অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমাদের এমন একটি শিক্ষানীতি থাকতে হবে, যেটি বস্তুনিষ্ঠ, বিজ্ঞানভিত্তিক একটা রেসনাল শিক্ষা ব্যবস্থা হয়। তার মধ্যে গ্রাম এবং শহরের একটা সামঞ্জস্য থাকতে হবে। আগে একটা গ্রামের ছেলে বোর্ডে ফার্স্ট হতো। এখন কেন হয় না? আবার নারী-পুরুষের চ্যালেঞ্জ থাকতে হবে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক-এদেশের একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বলেছেন, জন্মসূত্রেই হচ্ছে এদেশের মেয়েরা কম বুদ্ধিসম্পন্ন। যখন কি না আমাদের উচ্চ আদালতে ৫/৬ জন বিচারক আছেন মহিলা। দক্ষতার দিকেও তারা অনেক ভালো। এছাড়া আমাদের দেশে অনেক ভালো ভালো পদে নারীরা রয়েছেন। আমি বলছি, আমাদের শিক্ষানীতিতে গ্রাম আর শহরের চ্যালেঞ্জ ও নারী-পুরুষের চ্যালেঞ্জ থাকতে হবে। এটা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এবং বিদেশে শিক্ষার ব্যাপারেও আমাদের মেয়েদেরকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিতে হবে। এখন বিদেশে উচ্চ শিক্ষা বলতে আমরা কি বুঝি তা আমাদেরকে নির্ধারণ করতে হবে। বাজারে যদি কেরোসিন, সয়াবিন, বাটারওয়েল বা গাওয়া ঘি একদামে বিক্রি হয় তাহলে তো হবে না। অর্থাৎ বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদেরকে পাঠাতে হলে আগেই নির্ধারণ করতে হবে সে কোন দেশে, কোন মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কি ধরনের উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ করতে যাচ্ছে, তার জন্য কোনটা উপযোগী সেই বিষয়টি। বিদেশীরা আমাদের দেশের বাংলা সাহিত্য যদি জানতে চায়, ঐতিহ্য সম্পর্কে যদি জানতে চায়, বা আমাদের সমাজ সম্পর্কে জানতে চায় তবে বিদেশীরাও আমাদের দেশে এসে শিক্ষাগ্রহণ করবে, আমরা যদি সে পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারি। এরপরও আমাদের দেশ থেকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য কারা যাবে তা নির্ধারণ করা দরকার। এগুলো কিন্তু আমাদের শিক্ষানীতিতে স্পষ্ট করে উল্লেখ নেই। আর একটি জিনিস হচ্ছে আমাদের বাজেট এলোকেশনে বা নীতিতে নারী এবং নারীকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমি গত ১০ বছর শিক্ষকতা করতে গিয়ে দেখেছি যে আমাদের মেয়েরা এখন অনেক অগ্রগামী, অনেক প্রফেশনাল। তাই তারা যেন সামাজিক, পারিবারিক রাষ্ট্রীয়ভাবে সব দিক থেকে আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা পায় সে দিকটি নিশ্চিত হতে হবে। আর একটি দিক হলো-আমি মনে করিনা যে উচ্চ ডিগ্রীর ট্রেনিংয়ের জন্য আমাদের সিভিল সার্ভিসের কাউকে বিদেশে পাঠানো উচিত। আমাদের ডাক্তারী, ইঞ্জিনিয়ারিং, বিজ্ঞান ইত্যাদি ক্ষেত্রে অথবা সাহিত্য চর্চার জন্য, ভাষা চর্চার জন্য কিংবা দর্শন শাস্ত্র চর্চার জন্য যদি কেউ বিদেশে যেতে চায় সেটি আলাদা কথা।

একই সাথে আমাদের মনমানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। আইন দিয়ে হবে না। পরিশেষে গুরুত্বারোপ করতে চাই বিদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের ব্যাপারটিতে। কারণ মনে রাখা দরকার- ইউ,কে’র ডিগ্রী কিন্তু দুই ধরনের। একটি হলো ‘ইউনিভার্সিটি অব করাচী’ আরেকটি হলো যুক্তরাজ্যের নামকরা কোন ইউনিভার্সিটি। সুতরাং, সব ইউ,কে’র সার্টিফিকেট এক করে ফেললে কিন্তু হবে না। ইউ,কে’র মানেটি আগে নির্ধারণ করতে হবে তারপর মূল্যায়ন। আমরা প্রায়ই সেই ভুলটি করে বসি। নিজেকে এবং অপরকে উভয় ক্ষেত্রে মূল্যায়নের দিক থেকেই।

জু বা ই দা  গু ল শা ন  আ রা

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী

জাতীয় শিক্ষানীতি ও বিদেশে উচ্চশিক্ষা-আমি প্রাথমিকভাবে ভেবেছিলাম যে, সাধারণ শিক্ষার বিষয়ে আমাদের আলোচনাটা থাকবে এবং আমি হয়তো সেভাবেই কথাটা বলতে চাইবো আপনাদের কাছে। কারণ, আমি যা ভাবি তা আমি শেয়ার করতে চাই তাদের সাথে, যারা আমার মতো দেশকে ভালোবাসেন এবং শিক্ষা সম্পর্কে ভাবেন। আমার পূর্ববর্তী বক্তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি যে, আপনি অনেক আত্মনিন্দা করেছেন শিক্ষক জাতির প্রতি। আমি অনেক দুঃখ পেয়েছি, কারণ এখনো অনেক শিক্ষক রয়েছেন যারা সত্যিকার অর্থেই আন্তরিক। তারা অনেক সুযোগ পেয়েও বিদেশে যাননি। তাঁরা দেশে ছাত্র তৈরী করেছেন; তাঁরা দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। তাঁরা দু’একটা ভুল করতেও পারেন, ‘ঢাকার রাজধানী করাচী’ বলতেও পারেন কিন্তু তাদের সে ভুলকে আমরা ধরে রাখতে চাই না। আমরা চাই, আমাদের শিক্ষকদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা থাকুক। আমাদের ছেলেমেয়েরা যাতে শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করতে পারে, সে মনোভাব তাদের মধ্যে তৈরী করা আমাদের প্রত্যেকেরই একটা কর্তব্য। আমার যেটুকু মনে হচ্ছে যে, বিদেশে উচ্চশিক্ষা- আপনি চান বা না চান, আমি চাই বা না চাই ছেলে-মেয়েরা যাবেই। তারা যেতে চায়, উন্নত দেশগুলো তাদের ডাকছে। ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী- যাবেই তারা। কিন্তু আমরা এমন পরিবেশ তো তৈরী করতে পারি, যাতে বিদেশীরা মুগ্ধ হয়ে যায় যে, বাংলাদেশে এমন শিক্ষা পদ্ধতি রয়েছে, এমন শিক্ষক রয়েছেন, এমন শিক্ষা পরিচালনা পরিষদ রয়েছে- যাদের কাছে আমরাও শিখতে পারি। এই তো গতকাল আমি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম, সেখানে একটি চীনা ছাত্রী বাংলায় অনুবাদ করে একটি চীনা প্রেমের গান আমাদের শোনালো। বিদেশ থেকে তো ছাত্ররা আমাদের দেশে আসছে। আমাদের ছেলে-মেয়েরাও যাচ্ছে ঠিক আছে, তবে সেটা যেনো ভীতিকর পর্যায়ে চলে না যায়- সেদিকটা খেয়াল রাখতে হবে। আসলে বিদেশীরা আমাদের মেধাগুলোকে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। শুনতে খারাপ শোনালেও এটাই হচ্ছে কঠিন এবং নিষ্ঠুর সত্য। এই পচা ভলভলে কাদার দেশ; সেই দেশের ব্রেনগুলোকে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু আমার পুরো পরিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত, কাজেই আমি সবারই কথা কিছু কিছু জানতে পারি। ছেলে-মেয়েরা আসে এবং বলে যে, আপা জিপিএ-৫ পেয়েছি, চলে যাচ্ছি, কয়েক লাখ টাকা লাগবে, তবে আমি ফিরে এসে দেশকে সেবা দেবো। আমি মনে মনে বলি, তুমি তো বাবা আর ফিরবে না। কেউ গিয়ে বিদেশ থেকে টেলিফোনে জানায়, আপা আমি একটা গাড়ি কিনেছি। আমি তাকে প্রশ্ন করি, তুমি না বললে, দেশে ফিরে আসবে? উত্তরে সে বললো, ঋণ করে গাড়িটা কিনেছি, ঋণ শোধ না করে ফিরে আসি কি করে? অর্থাৎ সেই গাড়ির ঋণ, এরপর বাড়ির ঋণ, বিয়ের ঋণও হতে পারে, সুতরাং এই যে মোহ, এ মোহ আমরা কাটাতে পারিনি। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই কিন্তু আমরা এই মোহে নিমজ্জিত রয়েছি। অনেকেই অনেক কথা বলে যায়, শিক্ষা অর্জন শেষে দেশে ফিরে এসে দেশের জন্য কাজ করবো- দুঃখের সঙ্গে বলছি, আমি তা মানতে পারি না। যারা যায়; তারা পয়সা বানাতে যায়, যারা যায় তারা গুড লিভিং-এর জন্য যায়, যারা যায় তারা ভালো থাকার জন্য যায়। আর এই আমরা বলতে চেষ্টা করছি যে, আমাদের শিক্ষানীতিতে কি রাখবো, কেনো যাবে? তাদের খুশি; তারা স্বাধীন, তাদের জন্যই তো আমরা দেশটাকে স্বাধীন করেছি। তারা যাবে, বেড়াবে, থাকবে ব্যস। চলে আসবে, না হলে আসবে না। আমার কথা হচ্ছে, আমরা যেনো তাদের কাছে প্রত্যাশা না রাখি। তবে দু’একটা কথা আমি এখানে বলা খুবই জরুরী মনে করি। শিক্ষানীতিটা আসলে কি? আসলে কি আমাদের কোনো শিক্ষানীতি আছে? জাতীয় শিক্ষানীতি তো নেই আমাদের। আমার জীবনের ত্রিশ বছরের অধিককাল আমি ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়েছি, কিন্তু কই আমি তো কোনো শিক্ষানীতি পেলাম না। কোথায় সে শিক্ষানীতি, সে অলৌকিক শিক্ষানীতি? আমি সেই শিক্ষানীতি চাই, যা মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। কিন্তু সেই শিক্ষানীতি তেমন করে হয়নি। ঐ একটা করে আসে কিছুদিন চলে টলে তারপর আবার কোথায় চলে যায় সেটা সেই জানে। আমি যেটা চাইবো তা হলো, বিশ্বের যোগ্য সার্বজনীন কর্মসক্ষমতা যাতে শেখানো যায় তারই যোগ্য হওয়া উচিত আমাদের শিক্ষানীতি। তাতে আমার দেশকেও আমি কিছু দিতে পারবো বিদেশে গিয়েও কাজ করতে পারবো। মোট কথা, সত্যিকারের কর্মী হয়ে যেনো আমি বিদেশে গিয়েও কিছু করতে পারি, আমার দেশকেও যেনো কিছু দিতে পারি। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন আসবে যে, প্রত্যেকটা দেশের বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত আছে, বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যাবলী আছে, সেদিক থেকেও চিন্তা করে আমাদের শিক্ষানীতি কি হয়েছে? আমার তো মনে হয়, আমাদের প্রথম কর্তব্যই হচ্ছে জাতীয় শিক্ষানীতি গড়ে তোলার চেষ্টা করা। আমাদের এ নিয়ে তো রীতিমতো চিৎকার-চেঁচামেচি তোলা উচিৎ, আমাদের শিক্ষানীতি কই? আমাদের শিক্ষানীতি দেন।

প্রাইমারী লেবেলে কি হবে, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক লেবেলে কি হবে, ইউনিভার্সিটি লেবেলে কি হবে, বিজ্ঞান শিক্ষায় কি হবে? আমরা কি কখনো সেভাবে কাজ করতে পেরেছি? আমি তো কোথাও সেই শিক্ষানীতি পাইনি। প্রাইমারী লেবেলে টিচাররা আজ ছাত্রদের ইন্ডিয়ান বই পড়িয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে। এটা হলো তাদের শিক্ষানীতি। ওরা শেখাবেন যে, ঢাকার রাজধানী দিল্লী। তারা তাদের শিক্ষানীতি পরিচালনা করে যাচ্ছেন। একেকটা স্কুল, কলেজ খুলে আমাদের ছেলেমেয়েদের যার যা শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। আমার শিশু কি শিখলো তা হলে? জাতীয় শিক্ষানীতিতে আমার যেটা মনে হয় যে, জীবনের ছোট ছোট স্বাক্ষরতাই হচ্ছে প্রথম শর্ত। যেটা নিয়ে আমাদের প্রথম কাজ করা উচিত বলে আমি মনে করি, তা হচ্ছে স্বাক্ষর হওয়া। তবে স্বাক্ষর হওয়া মানে আমার নাম আজিমুদ্দিন মোল্লা-ব্যস এটুকুই তা নয়। যে স্বাক্ষরতা আমাকে জীবনের সমস্যাগুলোকে ফেস করতে শেখাবে, আমি বুঝতে পারবো যে, এটুকু শিখলে বা এইটুকু বললে আমি আমার জীবনটাকে চালিয়ে নিতে পারবো এবং ছেলেটাকে জীবনের কোথাও দাঁড় করিয়ে দিয়ে যেতে পারবো, তাকে আমি বলবো শিক্ষানীতির প্রথম শর্ত। স্বাক্ষরতার পরে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বৃহত্তর সুফল বয়ে আনে, আত্মসম্মানবোধ জেগে ওঠে, জেন্ডার ডিফারেন্টটা দূর হয়- এই বিষয়গুলোকে নিয়েই শিক্ষানীতি গড়ে তোলা উচিৎ। বয়স্ক শিক্ষানীতি- আমার ভালো লাগে। যখন দেখি, হারিকেনের আলোতে কোথাও কোথাও কৃষকেরা পড়াশোনা করছে। কোথাও কোথাও আমরা তো কাজ করছি, সফলও হচ্ছি, একেবারেই যে ব্যর্থ তা তো নয়। আমাদের বাস্তবতাই হচ্ছে আমাদের শিক্ষা, থিওরি নয়। আমাদের শিক্ষানীতি এমন হবে, আমরা দুনিয়াতে চলতে পারবো, যেকোনো কিছুর মোকাবেলা করতে পারবো। আমরা টেকনিক্যাল শিক্ষা নেব, বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা নেবো। এটাই তো আমাদের তৃণমূল পর্যায়ের আসল শিক্ষানীতি হওয়া উচিত।

মাহাবুবুল হাসান নীরু

আপা, আপনার এই কথার প্রেক্ষিতে আমার জিজ্ঞাসা হচ্ছে, আমরা এই যে শিক্ষানীতির কথা বলছি, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে আমাদেরকে বলা হয়েছে শিক্ষানীতির কথা, আপনি যে নারী-পুরুষ বৈষম্যের কথা বললেন, আপনি যে কারিগরী শিক্ষানীতির কথা বললেন, আমরা কিন্তু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের আমলে শিক্ষানীতির কথা শুনেছি, ভালো শিক্ষানীতি প্রণয়নের প্রতিশ্রুতির কথা শুনেছি, আদতে আমরা কি তা পেয়েছি? আসলে আমাদের সেই শিক্ষানীতি কে দেবে? কাদের মাধ্যমে আমরা পেতে পারি আমাদের কাঙিক্ষত সেই শিক্ষানীতি? আমার মনে হয়, এ বিষয়টির ওপর আমরা আলোকপাত করতে পারি।

জুবাইদা গুলশান আরা

ধন্যবাদ নীরু তোমাকে একটি সুন্দর বিষয় উত্থাপন করার জন্য। তুমি খুব একটা ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছো আমাকে। আমি মনে করি, বিভিন্ন পেশার লোকদের নিয়ে সরকার একটা টাস্কফোর্স তৈরী করতে পারে, যারা শিক্ষা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবছেন এবং নানাভাবে শিক্ষার সাথে জড়িত। তবে এটা নিয়ম রক্ষার কোনো টাস্কফোর্স হবে না, হবে সত্যিকারার্থে শিক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে একটা প্রকৃত শিক্ষানীতি প্রণয়নের টাস্কফোর্স। যারা গ্রামে যাবে, একেবারে মানুষের দ্বারে দ্বারে, তাদের সুবিধা অসুবিধার কথা শুনবে। সবকিছু মনিটর করবে। মনিটরিংটা খুব গুরুত্বের সাথে হতে হবে। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে আমি একটা ব্যাপার খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করেছি তা হলো, আমাদের দেশে স্কুল লেবেলের শিক্ষা পদ্ধতিটা একেবারে সীমাবদ্ধ। ছেলে মেয়েরা প্রবল চাপের মধ্যে লেখাপড়া করছে। আমি মনে করি, ছুটির সময় আমাদের দেশের শহরের ছেলেমেয়েদেরও ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ায় বেড়াতে না নিয়ে গিয়ে গ্রামে নিয়ে একটি মাস জীবনভিত্তিক শিক্ষা দিতে হবে। তারা নদী দেখবে, পুকুর দেখবে, সাঁতার কাটতে শিখবে, আনন্দে থাকবে। একটি মাস তারা প্রকৃতিভিত্তিক জীবনের সান্নিধ্যে থাকবে, যে টমেটো তারা খায়, সেটা কিভাবে ফলানো হয়, কারা কাজ করে এটা ফলায়, কিভাবে ফলায় সেটা দেখবে, শিখবে- আমি মনে করি আমাদের স্কুল লেবেলে এটার ভীষণ প্রয়োজন রয়েছে। আমরা কেন কড়া হতে পারবো না আমাদের নীতির বিষয়ে? আমার মনে হয় ভালো করার ইচ্ছে থাকলে, আর সকলের একত্রিত চিন্তা ও চেষ্ঠা থাকলে নিশ্চয়ই আমরাও পারবো।

shafikul-i[1]

প্র ফে স র  ড.  মোঃ  শ ফি কু ল  ই স লা ম

অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমি মনে করি নিচের ক্লাসে যারা শিক্ষা দেন তাদের শিক্ষাটাই আসল শিক্ষা। প্রাইমারীতে আমি যে শিক্ষা অর্জন করেছি গ্রাম থেকে, সেটিই আমার আসল শিক্ষা। সে সময় আমাদের শিক্ষকদের পণ্ডিত বলা হতো। শিক্ষক বলা হতো না। অত্যন্ত দুর্ভাগ্য আমার যে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করাকালীন আমার মনে পড়ে না যে কোন শিক্ষক আমাকে একটা উপদেশমূলক কথা বলেছেন। দুঃখিত আপনারা কিছু মনে করবেন না এ কথার জন্য। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু একটি জিনিস দেখেছি যে, কিভাবে ছাত্ররা রাজনীতি করে এবং শিক্ষকরাও সেই ধারায় চলেন বা উৎসাহ দেন। সে ইতিহাস আর বলতে চাই না। আমি সামরিক শাসনের মধ্যে পড়াশোনা করেছি সে সময়ের কথা আপনারাই ভালো জানেন। যা হোক, শিক্ষানীতিতে নিচের ক্লাসে থেকেই আনা উচিত-‘না’ কে এভয়েট করা। অর্থাৎ ‘নো নেগেটিভ’। যেমন, ‘অপরের নিন্দা করিও না’ এটি না বলে বাচ্চাদেরকে আমরা যদি শেখাতে পারি ‘অন্যের প্রশংসা করো’। আমার মনে হয় আমাদের ছোট বেলায় যদি আমাদেরকে এরকম কিছু শেখানো হতো আমরা হয়তো বর্তমানের চেয়ে আরও ভালো কিছু উপহার দিতে পারতাম। তবে এখন আমাদের এই প্র্যাকটিসটা শুরু করা দরকার যে ‘মিথ্যা কথা বলিও না’ এটি না বলে ‘সত্য কথা বলিও’ এই যে পজেটিভ সেন্স-এফারমেটিভ, এগুলি ছেলেমেয়েদের শেখানো উচিত।

এখন দেশেই অনেক উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে, আর সবাইকে দেশের বাইরে দৌড়াতে হচ্ছে না। দেশেই সে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে তুলনামূলক কম খরচে। এটি একটি ভালো দিক। তবে এখন প্রয়োজন দেশের সকল বিদ্যালয় এমনকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব জায়গায় একই কারিকুলাম অর্থাৎ জাতীয় কারিকুলাম করা যায় আণ্ডার গ্রাজুয়েট লেবেলে এবং এক্ষেত্রে যদি বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করা যায় যে, এভাবেই চলতে হবে। তবেই আমার মনে হয় দেশেই ভালো শিক্ষাদান সম্ভব এবং এর মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের বিদেশে যাওয়াও কমবে। দেশের মেধাবী সম্পদ বাঁচবে, বাঁচবে টাকা। আর বিদেশে যদি পাঠাতেই হয় তবে মেধার ভিত্তিতে পাঠানো উচিত। এ নীতি করতে গিয়ে খেয়াল রাখতে হবে যেন কেউ বঞ্চিত না হয়। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত অথচ সরকারী বৃত্তি নিয়ে এম,এস/পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনে তারাই অগ্রাধিকার পায় যারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত। আমরা যদি শিক্ষককে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে গন্য করি তবে অবশ্যই শিক্ষকদেরকে বিভিন্ন কর্মশালা অথবা বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। তবে শর্ত থাকবে যে তারা অবশ্যই দেশে ফিরে শিক্ষা ও গবেষণায় কর্মরত থাকবেন। শিক্ষানীতিতে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো পুনঃনির্ধারণ করে বাস্তব জীবনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারণ করা উচিত।

chinu[1]

হো মা য় রা  চি নু

ফার্ষ্ট এসিসটেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেড

আমি তিনটি স্কুলে আমার তিনটি বাচ্চাকে পড়াই। সব থেকে বেশি খারাপ লাগার কারণটি হলো বাচ্চাদের বসার ব্যাপারটা। মেয়েরা আলাদা, ছেলেরা আলাদা। এই যে জেন্ডার, এটা কেন হবে? বাচ্চারা শিক্ষাজীবনের শুরুতেই একটা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এটা কেন? তারা বন্ধুর মতো হবে। সবাই তো মানুষ, তাদেরকে আলাদা করা হবে কেন? মেয়েদেরকে খেলতে দেয়া হয় পুতুল দিয়ে ছেলেদেরকে ক্রিকেট-ব্যাডমিন্টন দিয়ে। খেলার জায়গাটাও আলাদা। ওর স্কুলে খেলার মাঠ নেই, ওর শরীরচর্চা হচ্ছে না। যে কম্পিউটার আছে তাতে মেয়েদেরকে শুধু পুতুল খেলাটাই খেলতে দেয়া হয়। কেন? তাকেও গাড়ী খেলতে দাও। এই যখন স্কুলগুলোর অবস্থা তখন আমি কিন্তু বাসায় তাকে আলাদা করে দেখছি স্কুল থেকে। সচেতন একজন অভিভাবক হিসেবে আমার বাসায় ছেলেমেয়ে কোন বিভেদ নেই। সমান অধিকার। এই সমান অধিকারের বিষয়টি স্কুলে বা সে যে জায়গাগুলোতে চলাফেরা করে বা বড় হলে চাকরী ক্ষেত্রে অথবা আমাদের প্রত্যেকটি জায়গাতে যদি মেয়েদের এই সমান অধিকার নিশ্চিন্ত হয় তবে তাদের মনটাও অনেক বড় হবে। তারা আমাদের সমাজকে আরো বেশি কিছু দিতে পারবে। আমার বাচ্চা বেলে মাটি, এঁটেল মাটি, দোঁ-আশ মাটি চেনে না। আমি ফুলের টব থেকে মাটি সংগ্রহ করে তাকে দেখাচ্ছি।

ভিকারুন্নিসা নুন স্কুলে বাচ্চারা ক্লাস ওয়ানে পরীক্ষা দিতে গেছে। তাকে এত কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছে যেন সে ক্লাস সিক্সে পড়ে। তার যে ম্যাথমেটিক্স আসে যে ইংরেজী আসে বা অন্যান্য যা যা আসে তা বোঝানো আমার জন্যও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এ বিষয়গুলো আমাদেরকে ভাবতে হবে। শিক্ষা নীতিতে এ সকল বিষয়ে কি কি হবে, তার একটা দিকনির্দেশনা থাকা উচিত। ছয় বছরের বাচ্চার জন্য তার উপযোগী শিক্ষা পদ্ধতি ও পরীক্ষা পদ্ধতি থাকা উচিত। তাকে যেন লেখাপড়া নিয়ে সবসময় আতঙ্কে থাকতে না হয়। স্কুল করছে, কোচিং করছে- তারপর বাড়ীতে এসেও পড়ার অধিক চাপ কমাতে হবে। তাই শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন দরকার। তাকে যোগ বিয়োগ খাতা কলমে না শিখিয়ে কাঠির মাধ্যমে শেখাতে হবে। খেলনা দিয়ে শেখাতে হবে। অর্থাৎ মেথডিক্যাল পদ্ধতিতে শেখাতে হবে। তাহলে সে শিখবে, আগ্রহ সহকারে পড়বে। কারণ, তখন সে পড়ার মধ্যেই মজা খুঁজে পাবে। সে পড়তে আগ্রহী হবে। যখন তাকে কাড়ি কাড়ি বই ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে তখন যে বেসিক জিনিসটি জানার পরিবর্তে মুখস্ত বিদ্যায় অভ্যস্ত হতে চাইছে। আর এভাবেই তারা পিছিয়ে পড়ছে। তাই প্রয়োজন এই শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন।

nasea[1]

আ বু  না সে র  খা ন

চেয়ারম্যন, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন

আমাদের বিশাল জনসংখ্যা। যেহারে জনসংখ্যা বাড়ছে তাতে আগামীতে এদেশে বসবাসের জন্য এতো মানুষকে জায়গা করে দেয়া সম্ভব হবে না। সুতরাং যারা বিদেশে যেতে চায় তাদেরকে উৎসাহিত করা উচিত। তারপরও গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কারণে দেশের প্রায় ওয়ান থার্ড থেকে হাফ জায়গা বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে যাবে। তবে একটা আশার দিক হলো, আমাদের বাবা-মায়েরা বিশেষ করে উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদেরকে পড়াশোনার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন। যেটি কখনও কখনও ছেলেমেয়েদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এটি কিন্তু পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায় না। সেজন্য আমার মনে হয় একটি পর্যায় পর্যন্ত ছেলেমেয়েদেরকে মানুষ হওয়ার জন্য শিক্ষা দিতে হবে। জ্ঞান অর্জনের আকর্ষণটা বাড়ানোর জন্য শিক্ষা দিতে হবে। তবে একটা পর্যায়ে বিদেশে যাওয়ার জন্য যেটি দরকার তা হলো, একটি কমিশন গঠন করা। আগামী ২০ বছর পরে ইণ্ডিয়া, চায়না বা ইউরোপ অথবা আমেরিকাতে কোন ধরনের ম্যান পাওয়ারের প্রয়োজন হতে পারে সেদিকটিতে লক্ষ্য রেখে কিন্তু আমাদের সাবজেক্টগুলো চুজ করতে হবে। এগুলো নিশ্চই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোর পক্ষে সম্ভব নয় বা তারা করবেও না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট বা এ ধরনের বিশ্ববিদ্যায়গুলোতে অগ্রীম ঐ বিষয়গুলো চালু করার দিকে নজর দিতে হবে। এছাড়া আমাদেরকে বিশেষ করে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার ব্যাপারে নজর দিতে হবে। এখানে খুব দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, বুয়েটের কোন টিচারকে আমি দেখিনি কোন ইণ্ডাস্ট্রিতে কোনদিন কাজ করতে। আমি বলছি না যে, তারা ভালো পড়ান না। কিন্তু প্র্যাকটিক্যাল অভিজ্ঞতা অন্য জিনিস। আমি অস্ট্রেলিয়াতে দেখেছি রাশিয়াতে দেখেছি একজন টিচার বিশেষ করে যারা প্রযুক্তির সাথে সম্পর্কযুক্ত, গায়ে অনেক ময়লা কাপড় নিয়ে হয়তো তিনি ক্লাসে আসছেন। মানে তিনি বাস্তবে কোন কলকারখানা বা এ জাতীয় কোথাও কাজ সেরে তবে ক্লাসে ফিরছেন অর্থাৎ বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকলে অন্যকে বা ছাত্রছাত্রীদেরকে জ্ঞানদান করাটাও কঠিন। তাই আমার মনে হয় বুয়েটের টিচারদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে এবং যারা টেকনিক্যাল ক্ষেত্রে শিক্ষাদান করে থাকেন সেসব শিক্ষকদেরকে বাস্তব অভিজ্ঞতার জায়গাটি অর্জন করার জন্য বাস্তব পরিস্থিতিতে কাজ করা দরকার। আর নরমাল বিএ, এমএ পাস যারা আছে তাদের ক্ষেত্রে কি করা যেতে পারে সেটি চিন্তা করতে হবে। কারণ তারা একটি মধ্যম অবস্থায় পড়ে আছে। একদিকে তারা যেমন নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে পারছে না অন্যদিকে সমাজের জন্যও তারা কিছু করতে পারছে না। একটা বিএ পাস ছেলে বা মেয়ে-না পারছে ছোট কিছু করতে না পারছে বড় কিছু করতে। সুতরাং, এটি থাকবে কিনা বা এক্ষেত্রে কি হবে তা নির্ধারণ করতে হবে। আর একটি বিষয় হলো স্পেশালাইজেশন। আমাদের দেশে স্পেশালাইজেশন খুব প্রয়োজন কিন্তু ইন্টিগ্রেশনটাও খুবই প্রয়োজন। একটু আগে আলোচনায় যেটি এসেছে যে, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোতে বাংলা, ফিলোসফি বা এ ধরনের সাবজেক্টগুলো পড়ানো হয় না। এটি কিন্তু ঠিক না। এগুলো সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্তর্ভুক্ত করা খুবই জরুরী। আমি একটা ছেলেকে মানুষ করার জন্য পড়াশোনা করাবো তাকে যদি সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সুন্দর পরিবেশ দিতে না পারি, সে যদি তার পছন্দমত সাবজেক্ট বেছে নিতে না পারে তবে তো হবে না। আমাদের ছেলে মেয়েকে তো কোন ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা বা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর কর্মকর্তা বানানো মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। মানুষ হতে হলে তাকে বেসিক যে সমস্ত সাবজেক্টগুলো, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য যা যা দরকার সেগুলো ভাবতে হবে এবং সঠিক পন্থা খুঁজে বের করতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো যে, আমাদের দেশের অনেক শিক্ষক বিদেশে আছেন তারা দেশে ফিরে আসতে চান, তাদের বিদেশে কাজ করার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাদেরকে যদি মোটামুটি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনা যায় তবে দেশ অনেক লাভবান হবে। এ বিষয়টি নিয়ে কিন্তু সরকারকে ভাবতে হবে। আমি আবারও বলছি আমাদের শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত মানুষকে মানুষ বানানোর জন্য, মানুষের সেবা করার জন্য, মানুষের দ্বারা সেবা তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের মাঝে পৌঁছে দেবার জন্য, বিশ্বের বুকে ভালো কাজের মাধ্যমে আমাদের দেশের মুখ উজ্জ্বল করার জন্য, সর্বোপরি জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর জন্য।

zamali[1]

এ, কে, এম না জ মু ল  হ ক  জা মা লী

সেক্রেটারী জেনারেল, ফেড-ক্যাব, ঢাকা

সীমাবদ্ধ সম্পদের মধ্য দিয়েই প্রণীত হয় আমাদের শিক্ষানীতি। প্রত্যেকটি সরকারের উদ্দেশ্য থাকে একটি সুন্দর ও যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার। সেভাবেই প্রণীত হয়েছিল স্বাধীনতার পর ডঃ কুদরত-ই-খুদা, মফিজ উদ্দিন, সামছুল হক, ডঃ বারী এবং মনিরুজ্জামান শিক্ষা কমিশন সুপারিশ। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আমাদের এই সুপারিশ কিছুটা পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে বিশ্ব দরবারে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত আসনে জায়গা করে দিতে পারলে আমাদের এই সোনার বাংলা সগৌরবে তার ভীত তৈরি করে নেবে। বাংলাদেশের প্রতিটি শহরেই রয়েছে বস্তি ও ছিন্নমূল শিশু-কিশোররা। অশিক্ষিত এই শিশুদের অনেকেই পরবর্তীতে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হিসেবে বেরিয়ে আসছে। এদের জন্য প্রাইমারী এডুকেশন প্রজেক্টে বস্তিভিত্তিক শিক্ষা প্রণয়নের ব্যবস্থা চালু করা উচিত। প্রাইমারী থেকে এসএসসি পর্যন্ত বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থার ফলে পিছিয়ে পড়ছে গ্রামের শিক্ষার্থীরা। এ প্রেক্ষিতে যথা শীঘ্রই একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

বর্তমানে দেখা যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের ভেতর অনেক হতাশা কাজ করে। তারা শিক্ষার পরিবেশ ও গবেষণামূলক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অনেকে হচ্ছে নেশায় আসক্ত, যোগ দিচ্ছে নোংরা রাজনীতিতে, জড়িয়ে পড়ছে সাইবার ক্রাইমে। এ সকল অভিশাপ থেকে তাদেরকে মুক্ত করার জন্য প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা ও সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার উপর জোর দেয়া প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজী শিক্ষাকে ও কম্পিউটারের ব্যবহারিক শিক্ষা প্রতিটি সেমিস্টারে বাধ্যতামূলক করা উচিত। বাইরের যে সকল দেশে পার্টটাইম জবের পাশাপাশি ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করতে চায় সেগুলো খুঁজে বের করে শিক্ষার্থীদের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসে স্টুডেন্ট কনসাল্টিং ফার্মগুলো। এসব শিক্ষার্থীদের বিদেশে যাওয়ার সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করে স্টুডেন্ট কনসাল্টিং ফার্ম। বিদেশে গিয়ে শিক্ষার্থীরা শুধু উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে না এরা পার্টটাইম চাকরি করে প্রতিবছর প্রায় ১০০ কোটি টাকা উপার্জন করে থাকে। এরাই লেখাপড়া শেষ করে প্রতি মাসে ১ থেকে ২ লাখ টাকার বেতনে বিদেশে চাকরি করছে। প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে নিজে এবং সচ্ছল করছে পরিবারকে।

বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহ এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা নিলে এবং যে সকল দেশের, দূতাবাস আমাদের দেশে নেই সেগুলো-আনার ভূমিকা গ্রহণ করলে পোশাক শিল্প খাত থেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসে সরকারের শত শত কোটি সাপোর্টের মাধ্যমে তার চেয়ে বেশি আসবে এই খাত থেকে।

numan[1]

নু মা ন   আ হ ম্ম দ   খা ন

নির্বাহী পরিচালক, আইইডি

আমাদের কতগুলো সমস্যার মধ্যে একটা সমস্যা জনসংখ্যা, একটা সমস্যা হচ্ছে দারিদ্রতা। আগামী বিশ্বে আমাদের এই বিশ্বায়নের যুগে আমি চাই আর না চাই আমাকে বিশ্ব নাগরিক হিসেবেই বিবেচিত হয়ে কমপিট করতে হবে বিশ্বনাগরিকদের সাথে। কাজেই আমাদের দেশের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে হলে এবং দেশকে দারিদ্রমুক্ত করতে হলে এদেশে এমন একটা শিক্ষানীতি দিতে হবে যে শিক্ষানীতি আমার ভীত এবং আমাদের দেশের জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করবে। আজকের গোল টেবিল বৈঠকের সঞ্চালক আগেও প্রশ্ন রেখেছেন, আমাদের দেশের শিক্ষানীতি কি হওয়া উচিত? আমি মনে করি এদেশের যে অধিক জনসংখ্যা তা, বাংলাদেশের এ ভূখণ্ডে ধারণ করার মতো নয়। আবার পাশাপাশি আগামী বিশ্ব যদি দক্ষিণ এশিয়ার হয়ে থাকে সেই সুযোগটিকেও মাথায় নিয়ে আমরা যদি এমন একটি দক্ষ জনসংখ্যা তৈরি করতে পারি তাহলে আমার দেশ এগিয়ে যাবে পাশাপাশি বিশ্বায়নের প্রতিযোগীতায়ও আমরা টিকে থাকতে পারবো। সেজন্যই আমি মনে করি, মৌলিক যে বিষয়টা, সেই প্রাথমিক শিক্ষার ওপর বিশেষ জোর দেয়া উচিত। যদি আমাদের ছেলে মেয়েরা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ভীতকে মজবুত করতে পারে তাহলে পরবর্তী সময়ে সে বিদেশে যাবে, না দেশেই শিক্ষা গ্রহণ করবে-তা সে নিজেই ঠিক করে নিতে পারবে। অর্থের বিষয়? আপনারাও জানেন আমরাও জানি যে, একজন মেধাসম্পন্ন ছাত্রের জন্য অর্থ সমস্যা হয় না। সে যে কোন ভাবে স্কলারশীপের মাধ্যমে হোক, লোন করেই হোক, সে যদি স্থির করেই যে সে বিদেশে যাবে তবে তার অসুবিধা হয় না। আমাদের মধ্যে কতগুলো ট্রেন্ড আছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার। সেগুলো হলো ইংলিশ মিডিয়াম, বাংলা মিডিয়াম, মাদ্রাসা শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষা, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ইত্যাদি। এগুলোকে একটা মেইন ষ্ট্রিমের মধ্যে নিয়ে আসা দরকার। যাতে করে মানুষ সৃজনশীল, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারে এবং বহুত্ববাদিতাও হতে পারে। যে কথা এসেছে, জেন্ডার সংবেদনশীল, পরিবেশবাদি, সমস্ত কিছু হতে পারে, একই সাথে সিভিক এডুকেশন যেটি পূর্বেই আলোচিত হয়েছে সেগুলো যাতে ধারণ করতে পারে। সেজন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষানীতিটাকে সাজানো উচিত। সঞ্চালক পূর্বেই আরেকটি প্রশ্ন রেখেছিলেন যে, আমাদের শিক্ষকদের কি হবে?

আমার মনে হয়, শিক্ষকদের মধ্যে মেধার আকর্ষণ গড়ার জন্য বেতন কাঠামো থেকে শুরু করে সেই মেধাকে যাতে আকর্ষণ করতে পারে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর যে ব্যবস্থাপনা এটিও আমরা সবাই জানি গ্রাম বা শহরাঞ্চল সবখানেই কি চিত্র। সেখানে কিন্তু শুধু সরকার নয়, যারা সমাজটাকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদেরও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। যাতে তারা আপামর জনগণের জন্য প্রয়োজন কোনটি সেটি খুঁজে বের করতে পারে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের জন্য উদ্যোগী হতে পারে। আর শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য, মেধা আকর্ষণ করার জন্য এবং শিক্ষা ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানোর জন্য সকলকে নিয়েই সুদূরপ্রসারী চিন্তা করে আমাদের এ জনসংখ্যাকে যাতে জনসম্পদে পরিণত করতে পারি, সে আলোকেই আমাদের শিক্ষানীতিটা হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

kasem[1]

অ ধ্যা প ক   এ ম.  এ  কা শে ম

অধ্যক্ষ, কলেজ অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজি, ঢাকা

আলোচনার প্রথমেই প্রশ্ন আসে আমাদের শিক্ষানীতিটা কারা করবে? আমার প্রস্তাব হচ্ছে-যারা শিক্ষা দান করছেন অর্থাৎ সেই শিক্ষক সমাজ তাদের দ্বারাই এই শিক্ষানীতিটা প্রণীত হওয়া উচিত এবং সেক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, কারীগরি শিক্ষা বা অন্যান্য যতরকম শিক্ষা আছে সবগুলো সেক্টর থেকেই প্রতিনিধি নিয়ে এই শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য আমার মনে হয় যে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। শিক্ষানীতির অন্যান্য অনুসঙ্গের মধ্যে একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে। তা হলো শিক্ষক কারা? সাধারণত যারা মেধাবী তারাই কিন্তু এই শিক্ষকতা পেশায় আসেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা যখন শুনেছিলাম যে যার নাই কোন গতি সে করে ওকালতি কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি যে কোথাও কোন চাকরি যে পাচ্ছে না সে তখন মাস্টারীতে এসে ঢুকছে। কারণ অন্য জায়গায় চাকরি নেয়ার যোগ্যতাটা তার নেই। তাহলে এই শিক্ষানীতির ভেতরে এমন কিছু থাকা উচিত যে কেউ চাইলেই সে শিক্ষকতা পেশায় আসতে পারবে না। তাকে এ পেশায় আসতে হলে কোন পরীক্ষা, এক্রিডিডেশন বা কোন রকম স্বীকৃতি থাকতে হবে তার যোগ্যতার। তা না হলে সে এই শিক্ষকতা পেশায় আসতে পারবে না। আবার একটা প্রশ্ন আসছে-এই মেধাবী লোকগুলো কেন শিক্ষকতা পেশায় আসবে? তাহলে মেধাবী লোকগুলোকে যদি আকর্ষণ করতে হয়, ধরে রাখতে হয় তবে তাদের জন্য আলাদা কোন বেনিফিটের ব্যবস্থা করতে হবে। যে একটি ছেলে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে সে যদি অন্য কোন চাকরীতে জয়েন করে আর সেখানে যদি তার ১০ হাজার টাকা বেতন হয় তবে সে শিক্ষকতায় আসলে ১৫ হাজার টাকা বেতন পাবে। তাহলে সে ডেফিনিটলি আসতে আকৃষ্ট হবে যে, ওখানেতো বেতন/সুযোগ-সুবিধা বেশি। পাশাপাশি সমাজসেবা এবং শিক্ষকের মর্যাদা-সবই আছে, অতএব আমার জন্য শিক্ষকতাই সব থেকে ভাল। সুতরাং, এ বিষয়টি আমার মনে হয় শিক্ষানীতিতে অন্তর্ভুক্ত থাকা প্রয়োজন। আমরা সবাই জানি এদেশে লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত যুব বেকার। আমি শুধু একটি বাস্তব উদাহরণ দিতে চাই-যেমন টেক্সটাইল একটা সেক্টর। আমরা বস্ত্র খাত বলি। এই খাতে সাড়ে চার হাজার বিদেশী আমাদের দেশে বর্তমান সময়ে চাকরি করছে। অথচ আমাদের লোকরা বেকার। তাহলে এই সাড়ে চার হাজার লোক কিভাবে আসলো, কেন আসলো? কারণ, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতো বসে থাকবে না। একটা লোক যখন ইন্ডাস্ট্রি করে, ৫০, ১০০, ২০০, ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সেতো সেটি বন্ধ রাখবে না। সে দুনিয়ার যেখানে যোগ্য লোক পাবে সেখান থেকেই নিয়ে এসে তাকে দিয়ে কাজ করাবে। এখন আমার দেশের লোক পারছে না। সুতরাং, আমাদের দেশে যে লেখাপড়াটি পরিচালিত হচ্ছে সেটি, যেখাতে এমপ্লয়মেন্টের প্রয়োজন আছে, ঐ দিকে কিন্তু আমাদের ম্যান পাওয়ার খুবই দুর্বল। এই যে প্রয়োজনীয় খাতে আমরা এদেশের দক্ষ জনশক্তি পাচ্ছি না কেন? কারণটা হচ্ছে, আমাদের দেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থাগুলো আছে সেখানে দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করার মতো সেই শিক্ষার পরিবেশ আমরা বজায় রাখতে পারছি না। শিক্ষার মান বজায় রাখতে পারছি না। আজকে যদি আমরা তাকাই যে এদেশের কয়টা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্ররা কিছু শিখে বের হচ্ছে? এ প্রশ্নটা যদি আমরা রাখি তাহলে আমারতো মনে হয় যে, যেখান থেকে মানসম্পন্ন শিক্ষা দেয়া হয়, এরকম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কোন পার্সেন্টেসে আসবে না। তাহলে আমরা যেখানে মানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে পারছি না সেখানে আমরা দক্ষ জনশক্তি কিভাবে সৃষ্টি করবো? সুতরাং, আমাদের শিক্ষানীতির ভেতরে এমন কিছু থাকার দরকার আছে যাতে করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যেন মানসম্পন্ন শিক্ষা গ্রহণ করে ছেলে মেয়েরা বের হতে পারে। আর বিদেশে উচ্চ শিক্ষার প্রসঙ্গে বলতে হয় যে, অবশ্যই বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য আমাদের দেশ থেকে যেতে হবে, যাওয়ার দরকার আছে। আমরা চাই বা না চাই মানুষ যাবেই এবং উচ্চশিক্ষা নিয়ে আসার পরে আমাদের যে অভিজ্ঞতা তাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি একটা লোক যে বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ফিরে এসেছে, তার স্কিল্ডনেসটা, তার আউটলুকটা, তার চিন্তা চেতনা অনেক কিছুতেই ভিন্নতা এসেছে। ডেফিনিটলি হি ইজ বেটার। সুতরাং বিদেশে উচ্চশিক্ষার বিষয়টি রাখতে হবে। এটি না রাখলে আমরা এমনিতেই তো পিছিয়ে আছি আরো পিছিয়ে যাবো। আমি মনে করি, বিদেশে উচ্চ শিক্ষার ব্যাপারে যোগ্য ব্যক্তির ক্ষেত্রে কোন সীমাবদ্ধতা থাকাতো উচিৎ নয় বরং তাদের আরো কিভাবে সহায়তা দেয়া যায় এই বিষয়গুলোও আমাদের শিক্ষানীতি বা শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় আনা দরকার।

ইমদাদুল হক মিলন

ধন্যবাদ। আমার একটি অভিমত আছে। আপনারা সকলেই অত্যন্ত জরুরী বক্তব্য রেখেছেন। আমাদের শিক্ষানীতি ও বিদেশে উচ্চ শিক্ষা প্রসঙ্গে। আমার ছেলেবেলায় একটি উপন্যাস পড়েছিলাম, এটা অনেকেরই মনে থাকার কথা। মনোজ বসু নামে একজন লেখক একটি উপন্যাস লিখেছিলেন ‘মানুষ গড়ার কারিগর।’ তিনি শিক্ষকদেরকে ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ বলেছিলেন এবং এরকম একটি প্রচলিত কথা আছেও আমাদের মধ্যে যে, আমরা শিক্ষকদেরকে’ মানুষ গড়ার কারিগর বলি। এই ‘কারিগর’ শব্দটি নিয়ে আমার একটি অভিমত আছে। কারিগর শব্দটি নিয়ে আমি অনেকদিন ভেবেছি। আমার মনে হয় আমরা শিক্ষকদেরকে কারিগর না বলে “মানুষ গড়ার শিল্পী” বলতে পারি। কারিগররা যা তৈরি করেন তার মধ্যে প্রাণের প্রতিষ্ঠাটা হয় না যদি শিক্ষকদেরকে আমরা ‘মানুষ গড়ার শিল্পী’ গড়ে তুলতে পারি তাহলে প্রাণের প্রতিষ্ঠা সেখানে হবে এবং আমার মনে হয় যে, শিল্পী শব্দটার মধ্য দিয়ে আমরা অনেক কিছু বোঝাতে পারবো যে তারা প্রকৃত অর্থেই আমাদের দেশের মানুষকে প্রাণের প্রতিষ্ঠাটা দেবেন, প্রকৃত আলোর পথটা দেখাবেন। এই আলোর পথ ধরে বাংলাদেশের মানুষ, বাঙালি জাতি এগিয়ে যাবে সামনের দিকে।

এবার ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবেন সভাপতি মাহাবুবুল হাসান নীরু।

মাহাবুবুল হাসান নীরু

আমরা দীর্ঘ সময় ধরে আজকের এই গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত গুণী মানুষদের গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য এবং আলোচ্য বিষয় সম্পর্কিত পরামর্শ শুনলাম। আমি মনে করি, এসব বক্তব্য ও পরামর্শের মধ্য দিয়ে যে দিকনির্দেশনা উঠে এসেছে, তা একটি প্রকৃত ও সমৃদ্ধ শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে বিশেষ সহায়ক হবে। আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আপনারা যাঁরা এই আয়োজনে উপস্থিত হয়েছেন, তাঁদের কাছে আমরা ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ। আশা করি, আগামী দিনগুলোতেও বিভিন্ন সময়ে আমরা আপনাদের কাছে পাবো। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করছি এই গোলটেবিল বৈঠক। শুভ রাত্রি।

……………………………………………………………………………

গোলটেবিল বৈঠক নিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত রিপোর্ট

শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকারি উদ্যোগের অভাব রয়েছে

।। ইত্তেফাক রিপোর্ট ।।

জাতীয় শিক্ষানীতি ও বিদেশে উচ্চ শিক্ষা শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেছেন, জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য কয়েকবার শিক্ষা কমিশন গঠন করা হলেও তাদের সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকারি কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশকে অন্য দেশের বিজ্ঞান চর্চা ও প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

২৬ মে ২০০৮, সোমবার গুলশানের স্টেক হাউজে দৈনিক ইত্তেফাকের এই নগরী ও বিএসবি ফাউন্ডেশন এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের সঞ্চালনায় বৈঠকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. জসিম উদ্দিন, বাংলাদেশ শিশু একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক জুবাইদা গুলশান আরা, ক্যাম্ব্রিয়ান কলেজের অধ্যক্ষ ড. করুনাময় গোস্বামী, কলেজ অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজীর অধ্যক্ষ অধ্যাপক এম এ কাশেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. একে মনোওয়ার উদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক ড. মো: শফিকুল ইসলাম, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, ফেড-ক্যাবের সেক্রেটারী জেনারেল একেএম নাজমুল হক জামালী, নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক ড. রোকেয়া কবীর, আইইডির নির্বাহী পরিচালক নুমান আহম্মদ খান, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ফাস্ট এসিসটেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট হুমায়রা চিনু প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিএসবি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান লায়ন এম কে বাশার এবং সভাপতিত্ব করেন এই নগরীর বিভাগীয় সম্পাদক মাহাবুবুল হাসান নীরু।

অধ্যাপক ড. জসিম উদ্দিন বলেন, সরকারি-বেসরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষক স্বল্পতা এবং ল্যাবরেটরি ও বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণের অপ্রতুলতার কারণে শিক্ষার মান উন্নত নয় বলেই অনেকই স্নাতক পর্যায়ে কলেজে ভর্তি হতে চায় না। দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ভর্তি হতে না পারলে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করে। এছাড়া দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলেও দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান এবং পরিবেশ উন্নত না হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষা গ্রহণের জন্য যায়। এদের বেশিরভাগই দেশে ফিরে আসতে আগ্রহী নয়। তিনি বলেন, উচ্চ শিক্ষার পর শিক্ষার্থীরা দেশে ফিরে আসলেও তাদের মেধা ও অভিজ্ঞতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর তেমন সুযোগ নেই।

তিনি আরো বলেন, অতীতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে যারাই উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে যেত তাদের বেশির ভাগই দেশে ফিরে আসত। এখন এ চিত্র ভিন্ন। এদের বেশির ভাগই বিদেশ থেকে ফেরত আসছে না। এভাবে মেধা পাচার হচ্ছে। শিক্ষা কমিশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য কয়েকবার শিক্ষা কমিশন গঠন করা হলেও কমিশনের প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারি কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। তিনি অভিযোগ করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে শিক্ষক ও গবেষণা কর্মীরা প্রয়োজনীয় গবেষণা করতে পারছে না।

জুবাইদা গুলশান আরা বলেন, অনেক শিক্ষক সুযোগ পেয়েও বিদেশে শিক্ষার জন্য যান না। তারা দেশে থেকেই শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিচ্ছেন। শিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার সমালোচনা করে তিনি বলেন, যারা বিদেশে যায় তারা শিক্ষার জন্য নয়, বিদেশে যায় টাকা আয়ের জন্য, ভাল ভাবে বেঁচে থাকার জন্য।

করুনাময় গোস্বামী শিক্ষক প্রশিক্ষণের সমালোচনা করে বলেন, দেশে শিক্ষক প্রশিক্ষণের নামে যা হচ্ছে তা ঠিক নয়। তিনি শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিষয়টি শিক্ষানীতিতে আলোচনা এবং কর্মমুখী শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ অর্থবহ হতে হবে। সমাজের সবাই যেন উচ্চ শিক্ষা অর্জন করার সুযোগ পায় এদিকে সরকারকে নজর দিতে হবে।

এম এ কাসেম বলেন, যে বিষয়ে কাজের সুযোগ আছে, শিক্ষার্থীরা সে বিষয়েই শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী। শিক্ষকদের দিয়েই জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা উচিত বলে তিনি মত দেন। তিনি বলেন, বিদেশে যাবার ক্ষেত্রে কোন বাধা নিষেধ থাকা উচিত নয়। প্রয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা উচিত।

একে মনোওয়ার উদ্দীন আহমেদ বলেন, মেধা-যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসাবে নিয়োগ পেয়েছে, তারাই এক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং পরবর্তীকালে শিক্ষা কমিশনের সদস্য হয়েছে। তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশের যাওয়ার পক্ষে মত দেন। তিনি বলেন, শিক্ষানীতি বিজ্ঞান ভিত্তিক হতে হবে এবং এ নীতিতে গ্রাম ও শহর, নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা থাকতে হবে। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে মেয়েদের অগ্রাধিকার দেয়া উচিত বলে তিনি মত দেন।

শফিকুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান দিতে হবে। তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করে বলেন, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা কম হওয়ায় শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের সুযোগ পাচ্ছে।

আবু নাসের খান বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য একটি কমিশন গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, সাধারণ বিএ, এম এ বিষয়গুলো রাখা ঠিক হবে না। তিনি কর্মমুখী শিক্ষার ওপর মত দেন।

নাজমুল হক জামালী বলেন, বছরে ১৫ হাজার শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের জন্য যাচ্ছে। তিনি বলেন, বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়। যেসব দেশের দূতাবাস ঢাকায় নেই এসব দেশের দূতাবাস ঢাকায় স্থাপনের জন্য সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

ড. রোকেয়া কবীর বলেন, শিক্ষা জাতির অধিকার এ বিষয়টি সামনে নিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার্থীদের দক্ষতা নির্ণয়ের মানদণ্ড নিরূপণ করার জন্য সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার আহবান জানান তিনি।

নুমান আহম্মদ খান প্রাথমিক শিক্ষার ওপর জোর দেয়ার দাবি জানান। লায়ন এম কে বাশার বলেন, দীর্ঘ ৩৫ বছর পর দেশে শিক্ষা নীতি ঘোষণা করা হয়নি। শিক্ষা নীতি বিষয়ে সরকার বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা নীতি গঠন করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বিদেশে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে কোন নিয়ম নীতি হয়নি।

হুমায়রা চিনু বয়স উপযোগী পাঠ্য বই ও শিক্ষা প্রদানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

ইমদাদুল হক মিলন বলেন, শিক্ষকদের মানুষ গড়ার শিল্পী হিসাবে তৈরি করতে হবে। তাদেরই আলোর পথ দেখাতে হবে। এই আলোর পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে

তিনি ছিলেন আমাদের সাহিত্য-নগরের যাদুকর বংশীবাদক -মাহাবুবুল হাসান নীরু, সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

বেঙ্গলি টাইমস রিপোর্ট

 

হুমায়ূন আহমেদ আমার দৃষ্টিতে ছিলেন, আমাদের সাহিত্য-নগরের যাদুকর বংশীবাদক। অদ্ভূত এক যাদুর বাঁশি নিয়ে এই অসাধারণ প্রতিভাধর মানুষটি পা রেখেছিলেন বাংলা সাহিত্যের আঙ্গিনায়। তিনি তাঁর সে বাঁশির অপ্রতিরোধ্য সুর-মূর্চ্ছণায় মোহাচ্ছন্ন করে চুম্বকের মতো আমৃত্যু টেনে ধরে রেখেছিলেন সুবিশাল পাঠক-গোষ্ঠি। একাধারে সৃষ্টি করেছেন নতুন নতুন পাঠক। আমাদের মতো দেশে বই লিখে কতোটা জনপ্রিয়তার শিখরে আরোহন করা যায়, হওয়া যায় কতো অর্থ-বিত্তের মালিক তার এক অনন্য-সাধারণ উদাহরণ স্থাপন করে গেছেন এই নন্দিত কথাশিল্পী। একই সাথে প্রশস্ত করে দিয়ে গেছেন বাংলা সাহিত্যের নবাগত ও অনাগত লেখকদের পথ। নাটক, চলচ্চিত্রেও এনে দিয়েছেন নতুন প্রাণ। মোট কথা যে মাধ্যমেই তিনি হাত রেখেছেন; সেখানেই ফলেছে সোনা। আর দিনে দিনে হুমায়ূন সম্পদে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশের গোলাঘর। হুমায়ূন আহমেদের সব সৃষ্টিই যে সমান মূল্যবান বা সমান গুরুত্ব বহন করে এমনটি নয়, কিন্তু তাঁর অধিকাংশ সৃষ্টিই বাংলা সাহিত্য, নাটক ও সিনেমায় অমূল্য সম্পদ হিসেবেই বিবেচিত হবে। তবে বড় দুঃখজনক ব্যাপারটি হচ্ছে, অকালে; অসময়ে তাঁর এই মহাপ্রয়াণ। মেনে নিতে অনেক কষ্ট হয়। অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেলো দেশ ও জাতির; যা পূরণ হবার নয়। এমন প্রতিভা যুগে যুগে জন্মান না; এমন আর এক হুমায়ূন আবার কতো যুগ পর বা কতো কাল গত করে বাংলায় জন্মাবে তা একমাত্র ভবীতব্যই বলতে পারেন। দীর্ঘ সময় সাপ্তাহিক রোববার ও পাক্ষিক ক্রীড়ালোকের মতো বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় দুটো পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে; অর্থাৎ পেশাগত জীবনের আঁকে বাঁকে অনেকবার তাঁর সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। ভালো লাগতো তাঁর সোজা-সাপ্টা কথা বলার সাবলীল অথচ বিশেষ ঢঙ্গটা। এভাবে সবাই বলতে পারে না, এর জন্যও একটা বিশেষ ক্ষমতার প্রয়োজন, আর সেটা তিনি রপ্ত করেছিলেন তাঁর অসামন্য প্রতিভা বিনিয়োগ করে। আমি তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।

মাহাবুবুল হাসান নীরুর ই-গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত ২ ডিসেম্বর মন্ট্রিয়লে বর্ণাঢ্য প্রকাশনা উৎসব

বেঙ্গলি টাইমস রিপোর্ট

 

মন্ট্রিয়ল থেকে হাবিবুর রহমান

কানাডাভিত্তিক অনলাইন প্রকাশনী ‘শৈলী’ স্বাতন্ত্র্যধর্মী গল্পকার ‘মাহাবুবুল হাসান নীরুর সেরা দশ গল্প’ ই-গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে গত ১৫ নভেম্বর। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর তা অনলাইন পাঠকদের মধ্যে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। নিজের প্রকাশিত গ্রন্থ সম্পর্কে বেঙ্গলি টাইমসের সাথে আলাপকালে নীরু বলেন, ‘এটাই আমার প্রথম ই-গ্রন্থ। আমার প্রকাশিত গল্পগুলো থেকে শৈলী বাছাই করে যে দশটি গল্প গ্রন্থটিতে স্থান দিয়েছে, সেগুলো পাঠকদের ভালো লাগবে। বিভিন্ন বয়সের পাঠকের কথা চিন্তায় রেখে শৈলী তারা যে ভীন্ন ভীন্ন স্বাদ ও মেজাজের গল্প নির্বাচন করেছে সেটা অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে। আমি মনে করি, প্রতিটি গল্প তার নিজস্বতা দিয়ে পাঠকদের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে।’ নীরু বলেন, ‘বিগত দিনে গল্পগুলো বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর তা যেমন পাঠকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিলো; আজ এই স্বর্ণালি প্রযুক্তির যুগে অনলাইন পাঠকদেরও তা ভালো লাগবে বলেই আমার বিশ্বাস।’

এদিকে আসছে ২রা নভেম্বর গ্রন্থটির একটি বর্ণাঢ্য প্রকাশনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে মন্ট্রিয়ল শহরের ৬৭৬৭, কোর্ট-দে-নেইজ লাইব্রেরী ভবনে। অনুষ্ঠানে গ্রন্থটির ওপর আলোচনায় অংশ নেবেন ড. ওয়াইজউদ্দিন আহমেদ-প্রফেসর, ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট, কনকর্ডিয়া ইউনিভার্সিটি। ড. মহিউদ্দিন তালুকদার-চাকুরিজীবি। ড. আবিদ বাহার-প্রফেসর, হিউম্যানিটিস ডিপার্টমেন্ট, ডসন কলেজ। ড. রেবেকা সুলতানা- প্রফেসর, ইংরেজি ডিপার্টমেন্ট, জন এবোর্ট কলেজ। ড. আমিন কবির-পোষ্ট ডক্টরাল রিসার্স ফেলো, ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি। সায়েদা শের-সাহিত্যানুরাগী এবং মনিকা রশিদ-শিল্পী ও সাহিত্যিক।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন ফোবানার ভাইস প্রেসিডেন্ট এজাজ আকতার তৌফিক ও শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখবেন A1 টিউটোরিয়ালের প্রেসিডেন্ট এবং সাপ্তাহিক বাংলামেইলের নির্বাহী সম্পাদক কাজী আলম বাবু। অনুষ্ঠনাটি উপস্থাপনা করবেন মন্ট্রিয়লের বিশিষ্ট উপস্থাপক ও কবি শামসাদ রানা। বর্ণাঢ্য এ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করছে মন্ট্রিয়লের অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘A1 টিউটোরিয়াল’। অনুষ্ঠানে মন্ট্রিয়লের বিশিষ্ট আবৃত্তিকারদের কন্ঠে দর্শক-স্রোতারা শুনবেন লেখকের পাঁচটি গল্প। অনুষ্ঠানের শেষে মন্ট্রিয়লস্থ বাংলাদেশী ও ভারতীয় শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করবেন।

গ্রন্থটিতে স্থান পাওয়া দশটি গল্প হচ্ছে, ১. অসময়, ২. চলো গ্রামে ফিরে যাই, ৩. অফিস পাড়ার সুন্দরী, ৪. প্রতিপক্ষ আগুন, ৫. হাজারকি, ৬. মেঘগুলো আর পালিয়ে যাবে না, ৭. টিকিট, ৮. আমার বিবির বাহারি শখ, ৯. দলান্তরিত, ১০. আদমজী নগরের অতশী।

‘সেরা দশ গল্প’ ই-গ্রন্থটিতে স্থান পাওয়া গল্পগুলো শৈলীর নিজস্ব বাছাই। চমকপ্রদ প্রচ্ছদ, দৃষ্টিনন্দন অলঙ্করণ, লেখা-রেখা সব মিলিয়ে গ্রন্থটি অনলাইন পাঠকদের জন্য একটি পরিপাটি উপস্থাপনই বটে। গ্রন্থটিতে পাঠকদের জন্য ‘একটি সেরা গল্প’ নির্বাচনের প্রক্রিয়াও রাখা হয়েছে। যে গল্পটির পক্ষে সর্বাধিক সংখ্যক পাঠকের রায় যাবে সেখান থেকে মন্ট্রিয়লের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির উপস্থিতিতে লটারির মাধ্যমে নির্বাচন করা হবে একজন বিজয়ীকে। এবং তাকে পুরস্কৃতও করা হবে। পুরস্কারের অর্থ দশ হাজার টাকা। অনলাইনে গ্রন্থটি পড়তে ক্লিক করুন,

http://shoily.com/sg,

অথবা

http://shoily.com/

গ্রন্থটি ডাউনলোড করতে ক্লিক করুন

Click to access sg.pdf

পিতার জন্য প্রার্থণা

নিবন্ধ

২১ নভেম্বর। আমার জীবনের বেদনাময় একটি দিন। ২০০০ সালের এ দিনটিতে আমার পিতা এম এ মোমেন পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন । চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। অকৃত্রিম আর সুন্দর মনের বিশাল হৃদয়ের একজন মানুষ ছিলেন তিনি। অন্তর জুড়ে বিস্তৃত ছিলো সীমাহীন উদারতা। তাঁর মহত্ব আর আদর্শকে তারাই কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন, যারা তাঁর সান্নিধ্যে গেছেন। নিরহঙ্কারী, বর্ণাঢ্য জীবনধারী এমন একজন বাবার সন্তান হিসেবে জন্মলাভ করে আমি গর্ববোধ করি। সুবিশাল হৃদয়ের এই অসাধারণ মানুষটির অপরিসীম স্নেহ-আদর আর ভালোবাসা ছিলো আমাদের জন্য। একটা সবল দেহের সুস্থ্য-সুন্দর মানুষ মাত্র পনরো-বিশ মিনিটের নোটিশে কী করে যে চলে গেলেন- সেটা আজও আমার কাছে একটা বিস্ময়। পঁয়ষট্টি বছরের দীর্ঘ জীবনে তাঁর একটিও শত্রু ছিলো না। সুদৃঢ় চরিত্রের অধিকারী একজন বাবার সন্তান হতে পারার অহঙ্কারটা যে কতো বড় সেটা আমরা তাঁর সন্তানরা সারা জীবন উপভোগ করেছি। আজও করি। আদমজী জুট মিলের প্রোডাকশন ম্যানেজার, পরে বাংলাদেশ ফেব্রিক কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার আব্বা যেখানেই গেছেন সেখানেই সকলের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার মানুষে পরিণত হয়েছেন। স্বীয় স্বার্থের উর্ধ্বে থেকে অপরের কল্যাণ সাধনে তিনি সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন। আব্বা ছিলেন আমার একজন বড় বন্ধু। পিতা আর সন্তানের মধ্যে তেমন কোনো দূরত্ব ছিলো না। তিনি ছিলেন আমার কর্ম জীবনের প্রধান উৎসাহদাতা। সরকারী চাকুরী জীবন শেষে মাত্র ক’টা দিন আফ্রিকার ইরিত্রিয়ার একটি জুট মিলে কাটানোর পর ফিরে এসে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরী নেন এবং মৃত্যুর সময় পর্যন্ত আমরা তাঁর সাথেই ছিলাম। আমার সাহিত্য ও সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেরণা ছিলেন তিনি। আমার বই-পুস্তক, প্রয়োজনীয় পত্র-পত্রিকা, রেফারেন্স বুক তাঁর কক্ষেই থাকতো। তিনি সব সময় এসবের দিকে বিশেষ নজর রাখতেন। আমার কোনো শুভ সংবাদ শুনে তিনি মাথায় হাত রেখে বলতেন, ‘তোমার জন্য আমি অনেক দোয়া করি বাবা’, আর কোনো সমস্যায় পড়লে দোয়া-কালাম পড়ে মাথায় ফু দিয়ে বলতেন, ‘চিন্তা কোরোনা চেংড়া, আল্লাহ আছেন।’ আমার সাথে কথা বলার সময় মাঝে মাঝে তিনি ‘চেংড়া’ শব্দটা ব্যবহার করতেন। এখন আমি সমস্যাগ্রস্ত হলে কেউ আমার মাথায় হাত রেখে বলেন না, ‘চিন্তা কোরোনা চেংড়া, আল্লাহ আছেন।’ এই পৃথিবীতে আজ সেই স্নেহময় হাতটার বড়ই অভাব বোধ করি। পত্রিকায় লেখা বেরিয়েছে, কিংবা বইমেলায় বই, তা নিয়ে ছুটে যেতাম তাঁর কাছে, তিনি দেখে খুশী হতেন। মনোযোগ সহকারে পড়তেন। আমাকে আশির্বাদ করতেন। পিতার উদার চিত্তের সেই আশির্বাদ বাণী আজ আর আমার পৃথিবীতে উচ্চারিত হয় না। আমাকে কেউ বলেন না, ‘চেষ্টা করো বাবা, আরো অনেক বড় হবে।’ এটা যে কতোটা কষ্টের সেটা বলে-কয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। সত্যি বলতে কি, তাঁর চলে যাবার সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়েছে আমার মাথার ওপরের ছায়া। মায়াভরা একটা ছায়া যে জীবনের জন্য কতোটা দরকার, কতোটা শক্তিবর্ধক সেটা তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই মর্মে মর্মে অনুভব করছি। গুণীজনরা বলেন, সন্তানের যা দোষ-গুণ সেটা অর্জিত হয় বাবা-মা’র কাছে থেকে, তাদের চরিত্র থেকে, তাদের সংসার থেকে। আব্বার কাছ থেকে আমি শিখেছি, কি করে মানুষকে ভালোবাসতে হয়, কি করে মানুষকে কাছে টানতে হয়, দূরের মানুষকে কি করে বুকে টেনে আনতে হয়। আব্বা বলতেন, ‘পরের জন্য তুমি থাকলে, তোমার জন্য আল্লাহ থাকবেন।’ আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে এমন মানুষ খুব কমই আছেন যারা আমাদের বাসায় এসে থাকেননি কিংবা খাননি। গরীব আত্মীয়-স্বজনদের যে তিনি কতোভাবে উপকার করেছেন সেটা হিসেব করে বলা যাবে না। বিভিন্ন সময় তিনি অন্যের জন্য করণীয় বিভিন্ন উপদেশ দিতেন। নানা কারণে হয়তো সব সময় পারি না; তবে আজও চেষ্টা করি আব্বার সে উপদেশ মেনে চলতে।

আমি আমার পিতার মতোই একজন ভা‌লো মানুষ হিসেবে, মানুষের ভালোবাসা নিয়েই যেনো এ পৃথিবী ছাড়তে পারি, আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে পরম করুণাময়ের কাছে সে প্রার্থণাসহ তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
২১ নভেম্বর, ২০১২
মন্ট্রিয়ল, কানাডা।

মন্ট্রিয়লে ঈদ-আনন্দ অনুষ্ঠান “উল্লাস”

বেঙ্গলি টাইমস রিপোর্ট

চমৎকার উৎসবমুখর পরিবেশে গত ৮ সেপ্টেম্বর মন্ট্রিয়লের কলেজ জ্যঁ দ্যোঁ ব্রেবফ মঞ্চে বাংলাদেশ সোসাইটি অব মন্ট্রিয়লের এক জমকালো ঈদ-আনন্দ অনুষ্ঠান “উল্লাস” অনুষ্ঠিত হয়। সাংবাদিক ও কথা-সাহিত্যিক মাহাবুবুল হাসান নীরুর পরিকল্পনায় অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানটিতে সঙ্গীত পরিবেশন করেন বাংলাদেশের এ সময়ের সেরা দুই সঙ্গীত শিল্পী বেবী নাজনীন, আরেফিন রুমি ও  তরুণ বাউল শিল্পী জুবায়ের। এছাড়াও ছিলো আকর্ষনীয় কিছু বিষয়-বৈচিত্রের উপস্থাপন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো, মাল্টি-কালচার ফ্যাশন-শো, নৃত্য, সরাসরি দর্শকদের অংশগ্রহণে গেম-শো, প্রারম্ভে চমৎকার এক নাট্যাংশ। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মন্ট্রিয়লের দর্শকরা প্রথমবারের মতো দেখলো একই মঞ্চে তিন উপস্থাপক, এরা হলেন, মাহাবুবুল হাসান নীরু, ক্যাপ্টেন ফরিদ ও জেসমিন ফরিদ। উপস্থাপন শৈলী ছিলো চমকপ্রদ। অনুষ্ঠানটির সূচনা ঘটে মাহাবুবুল হাসান নীরুর নাট্যাংশের উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে। এতে অংশ নেন মিয়া মাহমুদ আহমেদ ও নীনা মাহমুদ। এরপর নাটকীয় ঢঙ্গে উপস্থাপকত্রয়ের আবির্ভাব ঘটে মঞ্চে। মন্ট্রিয়লের মঞ্চে এ জাতীয় উপস্থাপনা এটাই প্রথম। উপস্থাপনার মাঝে একজন সমালোচক দর্শকের উপস্থিতি ছিলো একটি চমক। এ দর্শকের ভূমিকায় অভিনয় করেন এক সময়ের নাট্যশিল্পী মিসেস শাহনাজ পারভীন। অনুষ্ঠানের উপস্থাপনায় নতুনত্ব দর্শকদের বেশ আনন্দ দিয়েছে। তবে বার কয়েক সাউন্ড সিষ্টেমের বিঘ্ন ঘটায় উপস্থাপন-শৈলী অনেকটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। দু’টি পর্বে বিভক্ত অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে ছিলো নৃত্য, ফ্যাশন-শো, সরাসরি দর্শকদের অংশগ্রহণে গেম-শো ইত্যাদি। মন্ট্রিয়লের স্থানীয় নৃত্যশিল্পীদের পাশাপাশি অটোয়া থেকে আগত লিপি ও এনামের নাচ দর্শকদের নজর কাড়ে। দ্বিতীয় পর্ব মাতিয়ে তোলেন তিন জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী বেবী নাজনীন, আরেফিন রুমি ও জুবায়ের। অনুষ্ঠানের শেষ অংশে সঙ্গীত পরিবেশন করতে এসে মধ্যরাত পর্যন্ত ব্লাক-ডায়মন্ড বেবী নাজনীন মাতোয়ারা করে রাখেন পুরো অডিয়েন্সকে। আটটা ত্রিশ মিনিটে শুরু হয়ে টানা রাত দুটো পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলে, তখনও হলরুম ছিলো দর্শকে পরিপূর্ণ-যা মন্ট্রিয়লের বাঙ্গালী কমিউনিটি আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানে ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। এ দৃষ্টিকোন থেকে সোসাইটি অব মন্ট্রিয়লের এ আয়োজনের সার্থকতা শতভাগ বলতেই হবে।

অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে বাংলাদেশ সোসাইটি অব মন্ট্রিয়লে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য তিনজন বিশেষ ব্যাক্তিকে ক্রেষ্ট প্রদান করা হয়, এরা হলেন, এজাজ আকতার তৌফিক, ফয়সাল আহমেদ চৌধুরী ও লাবলু আকন। অনুষ্ঠান সম্পর্কে সংগঠনের মূল চালিকা শক্তি এজাজ আকতার তৌফিক বলেন, অত্যন্ত চমৎকার একটি অনুষ্ঠান আমরা মন্ট্রিয়লের দর্শকদের উপহার দিয়েছি।’ তিনি বলেন,’অনুষ্ঠানের একজন দর্শক মন্ট্রিয়ল প্রাইমারি স্কুল বোর্ডের কমিশনার মনিরুজ্জামন খোকনের মতে, এদিন এ অনুষ্ঠান ঘুমন্ত মন্ট্রিয়লকে জাগিয়ে তুলেছে।’

সুমি দে, মন্ট্রিয়ল থেকে

 

 

 

জন্ম নিলো এক নবজাতক

নিবন্ধ

মা হা বু বু ল  হা সা ন নী রু

পহেলা নভেম্বর, দু’হাজার বারো। কানাডার সংবাদপত্র জগতে ভূমিষ্ঠ হলো একটি শিশু। নবজাতকের নাম ‘বাংলামেইল’। একটি বাংলা পত্রিকা। আজকের পর হতে কানাডার বাঙ্গালী পাঠকদের কানে কানে পৌঁছাবে এই নবজাতকের আওয়াজ। দিনে দিনে শিশুটির বয়স বাড়বে; পাশাপাশি একে পাঠকরা চিনবে এবং জানবে; একই সাথে এর বৈশিষ্ট্য এবং চরিত্র বিচারের সুযোগ পাবে। ভালো লাগলে প্রেমে পড়ে যাবে আর ভালো না লাগলে দূরে সরে যাবে। এটাই স্বাভাবিক; এটাই বাস্তবতা।

কানাডায় বর্তমানে বেশ কয়েকটি বাংলা পত্রিকা সচল রয়েছে, যার অধিকাংশই প্রকাশিত হয়ে থাকে কানাডার প্রধান বাণিজ্য নগরী টরেন্টো থেকে। বাংলামেইলও প্রকাশ পাচ্ছে এই টরেন্টো থেকেই। মানুষ মাত্রই নতুনত্বের পূজারি। স্বভাবজাত কারণেই নতুন কিছুর কাছে তাদের প্রত্যাশা সব সময়ই বেশী থাকে, তারা চায় নতুনত্বের স্বাদ এবং আনন্দ। বাংলামেইলও এ থেকে নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম নয়। বাংলামেইলের কাছেও কানাডার পাঠকরা চাইবে এমন কিছু যা তাদের প্রত্যাশাকে পূর্ণ করবে।

জন্ম নেয়ার পর থেকে একটি পত্রিকা যতোই সামনের দিকে এগোতে থাকে ততোই তার দায়িত্ব বাড়তে থাকে। যতোই জনপ্রিয়তা অর্জিত হয় ততোই বাড়তে থাকে পাঠকের কাছে তার দায়বদ্ধতা। স্বভাবত কারণেই পত্রিকাটির কাছে পাঠকেরও প্রত্যাশা এবং চাহিদা বর্ধিত হতে থাকে, ফলে সে প্রত্যাশা এবং চাহিদাকে পূরণ করতে পত্রিকাটিকে প্রতিনিয়তই গ্রহণ করতে হয় নবমুখি নানা চ্যালেঞ্জ। যেসব পত্রিকা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে, তারাই সাফল্যের সিঁড়ি ভেঙ্গে ইতিহাস রচনার মধ্য দিয়ে দিনে দিনে পৌঁছে যায় সুউচ্চ শিখরে। সুদীর্ঘ সাংবাদিক জীবনের অভিঙ্গতা থেকে অন্তত এটা বলতে পারি যে, একটি পত্রিকাকে জনপ্রিয়তা পেতে হলে কিংবা প্রাপ্ত জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হলে নতুন সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নিশ্চয়ই পাঠকদের নতুন কিছু দিতে হবে।

সাপ্তাহিক রোববারের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে একবার কালজয়ী বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, সেকালের যুব শক্তির উথ্থান ও নারী জাগরণের উদ্যোক্তা ‘সওগাত’ সম্পাদক নাসিরউদ্দিনের একেবারে জীবনের শেষভাগে একটা সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলাম। সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে সেকালে অর্থাৎ ১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম প্রকাশিত হবার পর থেকে তাঁর সম্পাদিত ‘সওগাত’ পত্রকাটির ব্যাপক প্রচার এবং বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘সওগাত প্রকাশিত হবার পর থেকেই এর জনপ্রিয়তা হুহু করে বাড়ার পেছনে যে কারণটি ছিলো তা হলো, সে সময় আমরা পাঠকদের নতুন কিছু দিতে পেরেছিলাম। একটা সমাজে যখন একটা নতুন জিনিসের প্রচলন হয় তখন সেটার প্রতি লোকের আগ্রহ-আকর্ষণ থাকে প্রবল।’ আর প্রয়াত সম্পাদক নাসিরউদ্দিনের সে বক্তব্যের সূত্র ধরেই বলা যায়, নতুন বলেই বাংলামেইলের প্রতিও আজ পাঠকদের আগ্রহ-আকর্ষণ প্রবল। এই আগ্রহ-আকর্ষণকে ধরে রাখতে এবং তা আরো বাড়িয়ে তুলতে অবশ্যই পত্রিকাটিকে প্রতিনিয়তই পাঠকদের নতুন কিছু দিতে হবে। পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে যে, ‘সংবাদপত্রের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। সুস্থ রুচি, গণতান্ত্রিক চেতনা, অসাস্প্রদায়িক আদর্শ বিকাশের প্রধান একটা অবলম্বন হলো এই পত্রিকা’। যদ্দুর জানি, বাংলামেইল মূলতঃ একটি পাঁচমিশেলি পত্রিকা। আর স্বাভাবিকভাবেই এ জাতীয় পত্রিকার দায়-দায়িত্বও অনেক বেশী। এ জাতীয় পত্রিকাকে যেমন দেখতে হয় অনেক কিছু তেমনি শুনতে হয় অনেক কথা। রাজনৈতিক চালচিত্র, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের সাহিত্য-সংস্কৃতি-কৃষ্টি, ব্যক্তি ও সামাজিক জীবন প্রবাহ, ইতিহাস-ঐতিহ্যসহ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ওপর সার্বক্ষণিক চোখ রাখতে হয়। জীবন ঘনিষ্ঠ অর্থনীতি, খেলাধুলা, ঘর-গৃহস্থালি, এমনকি মহাশূণ্যের অপর রহস্য সবকিছুর সংবাদ, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তা নিজস্ব মেধা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার দ্বারা পাঠক চাহিদার প্রতি নজর রেখে ঘষে-মেজে উপস্থাপন করতে হয় পত্রিকার পাতায়। এ ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন, সুন্দর এবং সু-সম্পাদনার প্রশ্নটি অবশ্যই মুখ্য।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই প্রবাস জীবনে নানা প্রতিকুলতাকে মোকাবেলা করে একটি নতুন সংবাদপত্র প্রকাশ করে সেটিকে সচল রাখা অত্যন্ত দুরূহ কাজ; তবে আমি এটাও বিশ্বাস করি যে, প্রবল আত্মবিশ্বাসী ও প্রচন্ড পরিশ্রমী স্নেহভাজন সম্পাদক শহিদুল ইসলাম মিন্টুর সু-যোগ্য সম্পাদনায় সমস্ত প্রতিকুলতাকে মোকাবিলা করে বাংলামেইল তার বস্তনিষ্ঠ সংবাদ, চমৎকার অঙ্গসজ্জা, বিষয়বৈচিত্র ও দৃষ্টিনন্দন উপস্থাপনা দিয়ে খুব দ্রুত পাঠকদের মন জয় করতে সক্ষম হবে।

২৭ অক্টোবর, ২০১২, মন্ট্রিয়ল।

মন্ট্রিয়লে সাপ্তাহিক বাংলা মেইলের গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা, ‘বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন জরুরী’

 

২৫ নভেম্বর মন্ট্রিয়লে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো সাপ্তাহিক বাংলা মেইল আয়োজিত ‘প্রেক্ষাপট : কানাডা ও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা’ শীর্ষক সময়োপযোগি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গোলটেবিল বৈঠক। সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক মাহাবুবুল হাসান নীরুর সঞ্চালনায় বিষয়টির ওপর আলোচনায় অংশ নেন, ড. ওয়াইজউদ্দিন আহমেদ- প্রফেসর, ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট, কনকর্ডিয়া ইউনিভার্সিটি, ড. মহিউদ্দিন তালুকদার- সিনিয়র সায়েন্টিষ্ট, ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানী, ড. মাহতাব চৌধুরী- প্রফেসর, ফিনান্স ডিপার্টমেন্ট, ম্যাকগিল ইউনির্ভাসিটি, রেবেকা সুলতানা- প্রফেসর ইংরেজি ডিপার্টমেন্ট, জন এবোর্ট কলেজ, ড. আমিন কবির- পোষ্ট ডক্টরাল রিসার্স ফেলো, ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটি। অবিভাবক : শামস রুস্তম, সিনিয়র ডিরেক্টর, প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট এন্ড ম্যানুফ্যাচারিং, ল্যাবোফার্ম ইঙ্ক। শিক্ষার্থী : শাপলা বেগম, (লোকাল স্টুডেন্ট), একাউন্টিং ডিপার্টমেন্ট, কনকর্ডিয়া ইউনিভার্সিটি। ফারহানুল ইসলাম, (ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট) ব্যাচেলর অব কমার্স, জন মলসন স্কুল অব বিজনেস। গোলটেবিল বৈঠকের শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বাংলা মেইলের নির্বাহী সম্পাদক কাজী আলম বাবু। প্রতিবেদন : সাপ্তাহিক বাংলা মেইলের সৌজন্যে

 

মাহাবুবুল হাসান নীরু

শুভ সন্ধ্যা। সাপ্তাহিক বাংলা মেইল আয়োজিত এই চমৎকার, গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যময় গোলটবিল বৈঠকে আপনাদের সবাইকে শুভেচ্ছা। আজ এখানে আপনারা শিক্ষক যারা উপস্থিত আছেন, প্রায় সকলেই অনেকদিন যাবৎ কানাডায় আছেন। কেউ কেউ এখানেই শিক্ষা জীবন শেষ করে শুরু করেছেন শিক্ষকতা জীবন। কানাডার স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুদীর্ঘ সময় যাবৎ শিক্ষকতা করছেন। কেউ অতিবাহিত করছেন শিক্ষাজীবন। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অত্যন্ত অভিজ্ঞ এবং গুণী মানুষ আপনারা। নিজেদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে কানাডার মতো বিশ্বের এই শীর্ষ দেশটির শিক্ষা জগতে রেখে যাচ্ছেন বিশেষ অবদান। প্রবাসে এই কৃতিত্বের জন্য নিশ্চয়ই আপনারা বাঙ্গালীদের অহঙ্কার। বাংলাদেশ আপনাদের জন্য গর্ববোধ করে।

শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। আর যে জাতি তার মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না, সে জাতি কোনো ক্ষেত্রেই রাখতে পারে না সাফল্যের স্বাক্ষর। কানাডার মতো এই উন্নত দেশটিতে উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে আপনারা যেভাবে আপনাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন, বা এখানে ছাত্র-ছাত্রীরা যে পরিবেশে; যে নিয়ম-নীতির মধ্যে লেখাপড়া করছে সেটা নানা কারণেই বাংলাদেশে আজ অসম্ভব। আপনারা এদেশের শিক্ষার পরিবেশ-পরিস্থিতি, শিক্ষাব্যবস্থা ও পদ্ধতির পাশাপাশি নিশ্চয় বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের শিক্ষার পরিবেশ-পরিস্থিতি ও চালচিত্র সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন। ইন্টারনেটের এ যুগে সে জানা-শোনার পরিধিটাও ব্যাপক। অপ্রিয় হলেও নির্মম সত্য যে, আমাদের দেশের শিক্ষাক্ষেত্র আজ নানা সমস্যায় জর্জরিত। শিক্ষাবিনাশী দানবের কালো থাবায় ক্ষত-বিক্ষত! এ থেকে কি কোনো মুক্তির পথ নেই? কানাডার মতো একটি বিশ্বের সেরা ও সমৃদ্ধ দেশে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতার আলোকে, বিচার বিশ্লেষণে বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নয়ন-উত্তরণের স্বার্থে আপনাদের কিছু বুদ্ধি-পরামর্শ থাকবে বলে আমি আশা করছি।

কানাডা ও বাংলাদেশ, আকাশ-পাতাল ফারাক। কী শিক্ষা, কি রাজনীতি, কি অর্থনীতি সব ক্ষেত্রে। বাস্তবিক অর্থে এর কোনো তুলনামূলক বিচার চলে না। আর স্বাভাবিকভাবেই সে বিচারে আমরাও যাবো না। মূলত এখানে আমরা আলোচনা করবো দুই দেশের চলমান শিক্ষাব্যবস্থার চালচিত্র নিয়ে। আমি মনে করি, এ পর্যালোচনা থেকে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে আসবে যা আমাদের দেশের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হতে পারে; একই সাথে কানাডায় অবস্থানরত বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরাও নানাভাবে উপকৃত হতে পারেন। মূলত: সে উদ্দেশ্যেক সামনে রেখেই টরেন্টো থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বাংলা মেইল পত্রিকা আয়োজিত আজকের এই গোলটেবিল বৈঠক। বিষয়বস্তু হচ্ছে, ‘প্রেক্ষাপট : কানাডা ও বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা’। আমি প্রথমেই অনুরোধ করবো ড. আমিন কবিরকে বিষয়টির ওপর আলোচনা করার জন্য।

ড. আমিন কবির

শুরুতেই আমি আমার অতীত ছাত্র জীবনের ওপর আলোকপাত করবো। সে সময় আমি কি করেছি বাংলাদেশে আর এখানে এসে কি করছি, সে কথাই আগে বলবো। আমার মনে হয়, আমি সিরিয়াস টাইপের লেখাপড়া করেছি মেট্রিক পর্যন্ত। রেজাল্টও বেশ ভালো করেছি। ইন্টারমেডিয়েটে তেমন একটা ভালো রেজাল্ট করতে পারিনি, কারণ ছিলো বাড়ী এবং বাবা-মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া। এরপর ভর্তি হলাম ঢাকা ইউনির্ভাসিটিতে। আর এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে ভর্তি হওয়ার পরই একেবারে পাল্টে গেলাম। পড়াশোনা বা ক্লাস তেমন একটা করতাম না। আসলে সিষ্টেমটাই এমন ছিলো যে, পড়াশোনার দরকার পড়তো না। যখন পরীক্ষা একেবারে সামনে চলে আসতো; অর্থাৎ পরীক্ষার এক দেড় মাস আগে রিয়াল পড়াশোনা শুরু করতাম। তারপরও রেজাল্ট ভালোই করেছি, তবে ক্ষতি যেটা হয়েছে তা হলো আমার বেইসটা তৈরী হয়নি। মানে, সত্যিকারার্থে টার্গেট অরিয়েন্টেড যে পড়াশোনা সেটা আমার হয়নি। আর সেটা আমি বুঝতে পারলাম ইউএসএ-তে এসে পিএইচডি প্রোগ্রাম শুরু করার পর। তখন বেশ বুঝতে পারলাম, অন্যান্য ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টের চাইতে আমার বেসিকটা খুব খারাপ। উদাহরণ স্বরূপ, ইন্ডিয়ার কথাই বলবো, ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টদের লেবেলটা অনেকটা ভালো ছিলো, অন্তত আমার তুলনায়। আর ওদের সাথে আমার সে গ্যাপটা কাভার করতে প্রায় এক বছর লেগেছে। এ জন্য প্রচুর পড়াশোনাও করতে হয়েছে। যা হওয়া উচিত ছিলো না। ঢাকা ইউনির্ভাসিটিতে ঢোকার পরই আমাদের জানা উচিত, আসলে আমরা কি করতে যাচ্ছি; আর কি করা উচিত। যেহেতু আমাদের সে গোলটা থাকে না, কিংবা দেখতে পারি না আমাদের ফিউচার সেহেতু আমাদের অনেকটা পিছিয়ে থাকতে হয়। আমার চার বছরের কোর্স ছিলো, কিন্তু তা শেষ করতে সময় লেগেছে সাত বছর। আমি বলছি না, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা খুব খারাপ; কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, আমাদের দেশের শিক্ষার সিস্টেমটাই কেমন যেনো ওলোটপালট।

মাহাবুবুল হাসান নীরু

কেনো সিস্টেমের এই ওলোটপালট? স্পেসিফিক কোন্ ব্যাপারটিকে আপনি এর জন্য দায়ি করে থাকেন?

ড. আমিন কবীর

এর সঠিক উত্তর আমার জানা নেই, তবে এ প্রসঙ্গে আমার সামনে যে প্রশ্নটি প্রথমেই এসে দাঁড়ায় তা হচ্ছে, কেনো স্টুডেন্ট পলিটিক্স? এ সংক্রান্ত অনেক আলোচনা আমরা শুনেছি। অনেক তর্ক-বিতর্ক করে সারা জীবন পার করে দিয়ে দিয়েছি। আমার কাছে সব সময়ই মনে হয়েছে স্টেট এ্যাওয়ে, কাট দা পলেটিক্স, ওইটুকুই। আমার মতে, শিক্ষাঙ্গন থেকে যতোদিন না পলিটিক্স বের হবে ততোদিন এ থেকে মুক্তি মিলবে না। আমাদের দেশের মতো শিক্ষাঙ্গনে পলিটিক্স আমি কোথাও দেখিনি। অন্যদিকে বাংলাদেশে স্টুডেন্ট-টিচার রিলেসনশিপটাও তেমন একটা জোরালো নয়। ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে দূরত্বটা অনেক বেশী।

মাহাবুবুল হাসান নীরু

আপনি শিক্ষাঙ্গন থেকে ছাত্র রাজনীতি নির্মূলের কথা বলেছেন, কিন্তু অতীতে আমাদের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামসহ জাতীয় ক্রান্তিকালে ছাত্র-রাজনীতির ভূমিকাকে অস্বীকার করবেন কিভাবে?

ড. আমিন কবির

আমি মনে করি সেটা ছিলো সময়ের দাবি, আজ তার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আর তাছাড়া যখন জাতীয় কোনো ব্যাপার বা ইমার্জেন্সি আসবে তখন হৃদয়ের তাগিদ থেকে ছাত্ররা তাদের ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসবে। আমি মনে করি, এটা ছাত্র রাজনীতির জন্য নয়, ছাত্রদের উপলব্ধির কারণেই। সেটা জাস্ট কাম অটোমেটিক্যালি। এ জন্য ছাত্র রাজনীতির কোনো প্রয়োজন নেই।

শামস রুস্তম (টগর)

আমি ড. আমিন কবিরের সাথে পুরোপুরি নই, আংশিকভাবে একমত। স্টুডেন্ট পলিটিক্স ইজ আ নট এ ব্যাড থিঙ্ক ফর মি। আমার জীবনে স্টুডেন্ট পলিটিক্স বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আমি মনে করি, স্টুডেন্ট পলিটিক্স একটি ছাত্রকে তার কর্মজীবনের জন্য পরিপূর্ণভাবে গড়ে উঠতে ভূমিকা রাখে। এটা আমার নিজস্ব অনুভূতি। পলিটিক্স আমার ছাত্র জীবন এবং পেশাগত জীবনে অনেক কাজে লেগেছে। যেমন, আমার দূরদর্শিতা বেড়েছে, পাবলিক রিলেশন বেড়েছে, কোন পরিস্থিতিতে কি করতে হবে, লোকজনকে কিভাবে ম্যানেজ করতে হবে, কিভাবে টিমওয়ার্ক করতে হবে; যেটা এখানে এসে আমি দেখছি; তা আমি দেশে সরাসরি করে এসেছি এবং শিখে এসেছি। আমি ঔ সময়টাতে বুঝতে পারিনি যে, আমি কি করছি বা কি শিখছি কিন্তু আজ এদেশে এসে উপলব্দি করছি, টিমওয়ার্ক বা লিডারশিপ যে কথাই বলুন না কেনো, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারেই হোক আমার ভেতর সে জিনিসগুলো গড়ে উঠেছে। যে বিষয়গুলোকে আজ আমি এপ্রিসিয়েট করি। আসলে ছাত্র রাজনীতিকে কলুষিত করছেন জাতীয় রাজনৈতিক নেতারা। তাদের অশুভ প্রভাবের কারণেই ছাত্ররাজনীতি বিপথে যাচ্ছে। যা কখনোই কাম্য নয়। আমি মনে করি, স্টুডেন্ট পলিটিক্স অবশ্যই থাকা উচিত তবে তাতে জাতীয় রাজনীতির সাথে কোনো লিঙ্ক থাকা উচিত নয়। যেমন আমরা এখানে কিছুদিন আগে দেখেছি ছাত্ররা মুভমেন্ট করেছে, সেটার সাথে কিন্তু জাতীয় রাজনীতির কোনো সম্পর্ক ছিলো না, সেটা ছিলো একান্ত ছাত্রদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপার। অন্যদিকে বাংলাদেশে নিজস্ব স্বার্থে ছাত্ররাজনীতিকে ব্যাবহার করে থাকে রাজনৈতিক দলগুলো। যা দুঃখজনক। আমাদের সময়ও আমরা সে ব্যাপারটিই লক্ষ্য করেছি। পয়সা দিয়ে মিছিল করানো, হাঙ্গামা করানো, টিচারকে লাঞ্চিত করানো সবই দেখেছি। এটাই আসলে বড় সমস্যা। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিচার্স পলেটিক্স আরো ক্ষতিকর। লাল, নীল সাদা! আমার অনেক টিচার বন্ধু আছেন যাদের কথাবার্তা আমার ভীষণ খারাপ লাগে। এখনো টেলিফোনে কথা হলে তারা যে সব ভাষা ব্যাবহার করেন তা শুনলে দুঃখ লাগে। আর টিচাররাই যদি এমন ভাষায় কথা বলেন তবে স্টুডেন্টরা তাদের কাছে কি শিখতে পারে? আমি মনে করি, টিচারদের পলিটিক্সটাই বন্ধ করে দেয়া উচিত। আমি দেখেছি সুবিধাবাদী টিচারদের স্টুডেন্ট লিডারদের কাছে গিয়ে তদবির করতে।

মাহাবুবুল হাসান নীরু

শামস রুস্তম, আপনি যে সমস্যাগুলোর কথা বললেন, তার সাথে আমরা সকলেই কম-বেশী পরিচিত। আমরা চাচ্ছি কানাডার মতো একটি উন্নত দেশে বসবাস করে আপনারা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন বা করছেন তারই আলোকে সেইসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আপনাদের পরামর্শ, বা কী হতে পারে আমাদের করণীয়? আমি এবার অনুরোধ করবো ড. মহিউদ্দিন তালুকদারকে আজকের বিষয়ের ওপর আলোচনা করার জন্য।

ড. মহিউদ্দিন তালুকদার

আমি মেডিক্যাল সায়েন্সের ছাত্র। আমরা মনে করি, আগে রোগ নির্ণয়, তারপর চিকিৎসা। আমরা যদি সমস্যা সম্পর্কে না জানি তবে সমাধান করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। আমার পূর্ববর্তী দু’জন আলোচক আসল সমস্যাগুলোর কথা যেমন বলেছেন তেমনি সেখানে সমাধানেরও একটা ইঙ্গিত আছে। যেমন ড. আমিন কবির বলেছেন স্টুডেন্ট পলিটিক্সের কথা, দ্বিতীয় বক্তা এর একটু ক্লারিফাই করেছেন আরো সুন্দর করে। আমিও মনে করি, স্টুডেন্ট পলিটিক্স থাকতে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু এর সাথে যেনো জাতীয় রাজনীতি কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট না থাকে। অবশ্যই স্টুডেন্ট পলিটিক্স থাকবে, এই কিছুদিন আগে মন্ট্রিয়লে যে ঘটনাটি ঘটে গেলো সেটা আমরা দেখেছি। ছাত্ররা অবশ্যই তাদের নিজস্ব সমস্যার কথা বলবে। আন্দোলন করার দরকার হলে করবে। সরকারের সাথে আলোচনা করবে। বিষয় সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধির সাথে কথা বলবে। যেখানে তাদের সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু অন্য কোনো সমস্যা তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া বা নিজেরা অন্যের সমস্যার সাথে জড়িত হয়ে, অর্থাৎ ছাত্র বা ক্যাম্পাস সংশ্লিষ্ট স্বার্থ বহির্ভূত কোনো বিষয়ে ছাত্রদের জড়িয়ে ফেলা বা ছাত্রদের ব্যবহার করা কোনোভাবেই ঠিক নয়। জাতীয় রাজনীতির কোনো কোনো কর্মসূচি এমনকি হরতালকে কার্যকর করার জন্য স্টুডেন্ট পলেটিক্সকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটাকে আমি কোনোভাবেই সমর্থন করতে পারি না। আমি মনে করি, স্টুডেন্ট পলেটিক্স থাকা উচিত, তবে সেটা তাদের নিজস্ব সমস্যা সমাধানের জন্য; জাতীয় বা দলীয় রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার হবার জন্য নয়। আমি নিজেও এক সময় হলে ছিলাম। হলগুলো সমস্যার অন্ত নেই। হলে সিট পাওয়া, খাবার-দাবার, পরীক্ষা নেয়া বা দেয়া নিয়ে নানা সমস্যা আছে। সেসব সমস্যা নিয়ে ছাত্ররা আলাপ আলোচনা করবে, আন্দোলন করবে, এ জন্য তাদের একটা প্লাটফরমও থাকতে হবে। আমি আবারও বলবো, ছাত্র রাজনীতি থাকবে, তবে তাকে কোনো ভাবেই জাতীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত বা জিম্মি করা যাবে না।

মাহাবুবুল হাসান নীরু

আমরা মনে হয় মূল বিষয় থেকে আমরা একটু দূরে সরে যাচ্ছি। যদিও আজকের বাস্তবতায় বাংলাদেশের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট যে কোনো আলোচনায় অবধারিতভাবে ছাত্র রাজনীতির ব্যাপারটি এসে যায়। ছাত্র রাজনীতি একটা অংশ, তবে মূখ্য নয়, অন্তত এ বৈঠকে।

ড. মহিউদ্দিন তালুকদার

ধন্যবাদ। আমি মনে করি, কারিগরি বা ব্যবহারিক শিক্ষার অভাবটা বাংলাদেশে একটু বেশী। এটা আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মুখস্ত বিদ্যাটাই বেশী প্রাধান্য পেয়ে থাকে এখন পর্যন্ত। একেবারে গ্রামের ছেলেটিও সারাদিন গরুর রচনা মুখস্ত করে চোখ বন্ধ করে, অথচ বাড়িতেই চোখের সামনে গরু। বলা যায় গরুর সাথেই তার বসবাস, তারপরও চক্ষু বন্ধ করে হরলালের রচনা চেঁচিয়ে মুখস্ত করে যাচ্ছে, গরুর দুইটা চোখ আছে, চাইরটা পা আছে, একটা লেজ আছে! এই যে শিক্ষা ব্যবস্থা বা পদ্ধতি এটা কিন্তু কোনো দিনও তাকে শিক্ষিত হতে সহায়তা করবে না। এর ফলে সে একটা সার্টিফিকেট পেতে পারে কিন্তু প্রকৃত শিক্ষিত হয়ে উঠবে না। আমার মতে, ব্যবহারিক শিক্ষাকে যতো বেশী প্রাধান্য দেয়া হবে শিক্ষা ব্যবস্থা ততো বেশী উপকৃত হবে। মুখস্ত বিদ্যা নয়। আসলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্রদের ব্রেইনটাকে ব্যবহার করার ওপর জোর দেয়া অতীবও জরুরী। অবশ্য ইট ডাজ নট এক্সজিষ্ট। কেউ চাইলেও পারে না। এখন দেখেন লাইব্ররী ওয়ার্ক নেই, খেলাধুলা নেই, নেই এ জাতীয় কোনো সুযোগ-সুবিধা। বরং আছে ক্ষতিকর দিক। আজ টিচাররা পর্যন্ত রাজনীতির সাথে জড়িত! সবাই আছে যেনো যে যার ‘ধান্ধা’ নিয়ে। যদিও ‘ধান্ধা’ কথাটা শুনতে খুব খারাপ শোনায়, তারপরও এটাই বাস্তবতা। দুঃখজনক। এমনকি ছাত্র-ছাত্রীরাও জড়িয়ে যায় এর সাথে, না চাইলেও।

মাহাবুবুল হাসান নীরু

ড. মহিউদ্দিন, এই যে আপনি ক্ষতিকারক দিকগুলো তুলে ধরলেন, স্পেসিফিক বলবেন কি, এ থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে কি করে?

ড. মহিউদ্দিন

আমার প্রথম পরামর্শ হচ্ছে, জাতীয় রাজনীতি থেকে ছাত্র রাজনীতিকে আলাদা করতে হবে। দ্বিতীয় পরামর্শ হচ্ছে, এই নীল, সাদা, সবুজ কালার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমি তো মনে করি, শিক্ষকদের রাজনীতির কোনো প্রয়োজন নেই। আজ এই বৈঠকে যে শিক্ষকগণ উপস্থিত আছেন তারা তো এই কানাডায় দীর্ঘদিন যাবৎ শিক্ষকতা করছেন, তারা কি কোনোভাবে এ দেশের জাতীয় রাজনীতির সাথে জড়িত আছেন? দরকার নেই। এছাড়া আমি মনে করি শিক্ষাকে ঢাকাকেন্দ্রিক রূপ দেয়া ঠিক নয়, সারাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমপরিমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার। সবশেষে আবারো বলবো মুখস্ত নয়, ব্যবহারিক শিক্ষাকেই প্রধান্য দিতে হবে।

মাহাবুবুল হাসান নীরু

সেই পাকিস্তান আমল থেকেই আমরা একটি সুন্দর, সুস্থ শিক্ষানীতি দাবি করে আসছি। দেশ স্বাধীন হবার এতো বছর পরও সে দাবী অব্যাহত আছে। বরং দিন দিন জোরালো হচ্ছে। যে সরকারই ক্ষমতায় আসে তারাই প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু সেই সুন্দর, সুস্থ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষার্থীদের জন্য কল্যাণকর একটি সুগঠিত পরিমার্জিত গ্রহণযোগ্য শিক্ষানীতি আজও আমরা পাইনি। এবার আমি ড. ওয়াইজউদ্দিন আহমেদকে বলবো বিষয়টির ওপর আলোকপাত করার জন্য।

ড. ওয়াইজউদ্দিন আহমেদ

শুরু করার আগে আমিও এড়িয়ে যেতে পারছি না ছাত্র রাজনীতি ইস্যুটিকে। বাংলাদেশে সেই পাকিস্তান আমল থেকে ছাত্র রাজনীতি চলে আসছে এবং আজও বিদ্যমান। আগে যে রাজনীতি ছিলো সেটা ছিলো সুষ্ঠ। ভাষা আন্দোলনের যে কথা বলা হচ্ছে, সেটা ছিলো অপরিহার্য। দেশাত্মবোধ থেকে উদ্ভূত।

কানাডায় প্রতিটি স্কুল একটি ইউনিক। এখানেও পলিটিক্স আছে তবে সেটা সুষ্ঠ, সুন্দর। আমাদের দেশে পলিটিক্স লাইক ক্যান্সার। আগে লিডাররা শুধু পলেটিক্স করতো আর এখন সে পলিটিক্স ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। এখন গ্যাস বা মিটার রিডার বলেন, কে করে না পলেটিক্স? সরকার তো এই ক্ষতিকর রাজনীতি বন্ধ করার চেষ্টাই করছে না, বরং তারা নিজেরাও এটা করছে। এটা এতো সহজ নয় যে, বললাম আর স্টুডেন্ট পলেটিক্স বন্ধ হয়ে গেলো। সেকেন্ড ইস্যু আমি মনে করি, সমস্যাটা আমাদের গোড়াতেই। আজ আপনি যদি কাউকে বলেন, তোমার জীবনের লক্ষ্য কি? উত্তরে কেউ কি বলে যে, আমি স্কুল টিচার হবো? আর আমি যদি এখানে কম্পেয়ার করি, কারা এখানকার স্কুল টিচার? এখানে স্কুল টিচার হতে হলে অবশ্যই তার সেই মানের ডিগ্রী এবং ব্রাইট এডুকেশন থাকতে হবে। তা না হলে এখানে স্কুল টিচার হওয়া সম্ভব নয়, এমনকি ইউনির্ভাসিটি লেবেলেও। স্পেশালি এলিমেন্টারি টিচার ইউ হ্যাভ টু বি রিয়েলি চাইল্ড এডুকেটর, তা না হলে ইউ ক্যান নট বি। আমাদের দেশে কি হচ্ছে? আগে এখানকার কথা একটু বলি, যদিও আমি এখানকার স্কুল পর্যায়ে শিক্ষা নেইনি। ইন্টারমেডিয়েটের পরই চলে এসেছি। তবে দেখা এবং অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমরা কিভাবে পড়েছি, সিএটি-ক্যাট, সিএটি-ক্যাট বলতে বলতে আমরা শিখি আসলে সিএটি-ক্যাট। এখানকার পদ্ধতি ভীন্ন। একদিনের রিডিংয়ের পর তাকে আর সেটা পড়ানো হয় না। এখানে জানেন, গ্রেড সিক্স বা গ্রেড ফাইভ পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই। দি টিচার ডিসাইড ওকে হি ইজ ম্যাচিউর এনাফ টু মুভ টু দ্য নেক্সট গ্রেড অর নট। আর আমাদের দেশে কি করা হয়, আই অ্যাম জাস্ট কম্পেয়ার, কিন্ডার গার্ডেনের কথাই যদি বলি, দে হ্যাভ নো লাইফ! বিরাট বইয়ের ব্যাগ কাঁধে দে আর গোয়িং টু স্কুল! শুধু স্কুল নয়, স্কুল থেকে ফিরে দেখবেন থ্রি টিউটোরিয়ালস! এটা কি জীবন! কী শেখাবেন আপনি ঐ শিশুটিকে? আর এখানে ঠিক তার উল্টোটি। শিশুটির স্বাধীনতা, তার স্বভাবজাত প্রবৃত্তির দিকে নজর রেখেই এথানে শিক্ষা দেয়া হয়। আমাদের দেশে সেই শিশু বয়স থেকেই ছাত্রদের অনেক চাপের মুখে ফেলে দেয়া হয়, যে চাপটা এখানে নেই। ক্লাস সিক্স সেভেন থেকে শুরু হয় পরীক্ষা নেয়া। কাজেই আমাদের সমস্যাটা কিন্তু গোড়াতেই। সেখানে শিশুকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে মা-বাবাকেও রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। শিশুদের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যেনো বিসিএস কোয়েশ্চেন! এতো কঠিন কঠিন সব প্রশ্ন। আমার এক পরিচিত ফ্যামিলীর কথা জানি, একটা স্কুলে ক্লাস টু’র ভর্তি পরীক্ষার জন্য মা এবং মেয়ে দু’জনেই তিনমাস বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন মুখস্ত করেছে। মা বলছে, এখন আমি নিজেও বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবো। চিন্তা করে দেখুন ব্যাপারটা! এ দেশে থেকে যা অকল্পনীয়। প্রতি বছরই আমার বাংলাদেশে যাওয়া পড়ে শিক্ষা সংক্রান্ত কাজে। সেখানকার পরিবেশ, পরিস্থিতি, শিক্ষা দানের পদ্ধতি দেখে আমি বিস্মিত হই। আসলে আমাদের দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে রয়েছে অন্তহীন সমস্যা যা এই ক্ষুদ্র পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নয়, তবে আমি মনে করি একেবারে রুট লেবেল থেকেই যদি এর সংস্কার না করা হয় তবে কোনোভাবেই এসব সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়।

এবার পড়াশোনার সিষ্টেমের কথা বলছি, স্কুল বা ইউনির্ভাসিটি লেবেলে এই যে বছরের শেষে পরীক্ষা, ইটস রং। এখানে ঠিক তার উল্টো, একে তো সেমিষ্টার শর্ট, এখানে চার মাসে শেষ হয়ে যাবে কোর্স, চার মাসের মধ্যে দে উইল হ্যাভ টু কুইজেস, দুটো মিডটার্ম, হোমওয়ার্ক, ল্যাব, দে হ্যাভ নো টাইম। এসবের পর আর পলিটিক্সের সময় কোথায়? এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, ছাত্ররা তাদের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে অন্যসব ব্যাপারে তারা জড়াবে না। আর বাংলাদেশে টিচারদের রাজনীতি তো রয়েছেই। বুয়েট-এর কথাই ধরা যাক, আশিভাগ টিচারের ধান্ধাই হচ্ছে কিভাবে অর্থ উপার্জন করা যায়। ওকে, বুয়েট ইজ গুড, এন্ড দে আর ডান ইন্টারন্যাশনালি নোন, বিকজ দ্য কোয়ালিটি অফ স্টুডেন্ট, উইথ নট বিকজ দ্য টিচিং।

ড. মাহতাব চৌধুরী

কানাডার শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বের অন্যতম সেরা শিক্ষাব্যবস্থা। যে কারণে পৃথিবীর যে কোনো দেশ থেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ অন্যান্য পেশার মানুষগুলোকেও এদেশে এসে লেখাপড়া করে ডিগ্রীটা আপগ্রেড করতে হয়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার কথা যদি বলি, তবে প্রথমেই আমার চোখে ভাসে অন্য এক দৃশ্য। প্রথমত সেখানকার শিক্ষা পদ্ধতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের স্কিলটা তৈরী করা হয় না। জোর করে বাধ্য করা হয় তাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা ডাক্তারী পড়তে। এটা একেবারেই ভুল সিদ্ধান্ত। তাছাড়া এটা সত্যি কথা যে, স্কুল থেকে সব কিছু শেখানো সম্ভব না। তাই প্রয়োজন প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে ইনডিভিজুয়াল স্কিল তৈরী করা। আর এটা থাকলে ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেরাই নিজেদের প্রস্তুত করে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। যেটা এদেশে করা হয়। বাংলাদেশে মুখস্ত বিদ্যাটার কারণে গাণিতিক বিষয়ে অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীই পিছিয়ে। অথচ আমরা দেখছি, ভারতের শিক্ষার্থীরা এ ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে অনেক এগিয়ে। তবে সব থেকে বড় কথা হচ্ছে, এদেশে এলিমেন্টারি পর্যায় থেকেই শুধু পুঁথিগত বিষয় নয়; বিভিন্ন বিষয়ের ওপর পড়ানো হয়। বাংলাদেশে ঠিক তার উল্টো। যে কারণে কথা বলা বা লেখায় সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এদেশের হাইস্কুলেরও সমপর্যায়ে পড়ে না। আমি মনে করি, শিক্ষার ক্যারিকুলাম পরিবর্তন না হলে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা সব সময় পিছিয়েই থাকবে।

রেবেকা সুলতানা

আমি পলিটিক্সের দিকে যাবো না। আজকের বিষয়বস্তুর ওপরই সরাসরি প্রবেশ করবো। আমি নিজে স্টুডেন্ট ছিলাম চিটাগাং ইউভার্সিটির, অধ্যাপনাও করেছি সেখানে। তিন বছর পর আমি যখন আমেরিকা গেলাম পড়াশোনা করতে, তো সেখানে গিয়ে আমাকে যে সমস্যায় পড়তে হলো তা হচ্ছে, আমি সেখানে গিয়ে একটা পেপার লিখতে হয় কিভাবে সেটা জানতাম না, কেননা ওসব আমাদের শেখানো হয়নি। যাহোক, সেখানে থাকলাম, পড়াশোনা শেষ করলাম। এরপর আমি কিন্তু দেশে ফিরে গিয়েছিলাম। দেশে ফিরে গিয়ে চিটাগাং ইউনির্ভাসিটিতে জয়েন করে প্রাইভেট ইউনির্ভাসিটিতে পড়িয়েছি ছ’বছর। আমার অভিজ্ঞতা কিন্তু খুব একটা খারাপ ছিলো না। স্টুডেন্ট খারাপ ছিলো বিকজ ভালো ছাত্ররা সব সরকারী বিশ্ববিদ্যায়গুলোতে চলে যায়। কিন্তু আমাকে সেই ফ্রিডমটা দেয়া হয়েছিলো ডিজাইন করার জন্য কোর্স, আমি নিজে যা করে এসেছি ওভাবেই করিয়েছি। আমি মনে করি, সরকারী বিশ্ববিদ্যায়গুলোতেও সেভাবেই করা উচিত। তবে আমার যেটা অসুবিধা হয়েছিলো সেটা হলো, আমাদের তিন বছরে অনার্স করে, মাস্টার্স করে, আবার ওখানে অর্থাৎ আমেরিকা  মাস্টার্স করতে হলো। এটা যেনো করতে না হয়। প্রাইভেট ইউনির্ভাসিটিতে ওটা করতে হয় না কেননা ফোর ইয়ার সিষ্টেমটা থাকে। আমি দেশ ছেড়েছি ২০০৫ সালে। এখনকার কথা জানি না, তবে আমি যা মিস করেছি সেটাই বললাম। আমি মনে করি, যেহেতু ছাত্ররা বাইরে পড়তে আসবেই; সেহেতু ওদের ক্যারিকুলামটা সেইভাবেই পরিবর্তন করা উচিত, যাতে বাইরে এসে তাদের অসুবিধায় পড়তে না হয়।

মাহাবুবুল হাসান নীরু

রেবেকা সুলতানা, আপনি ক্যারিকুলাম পরিবর্তনের কথা বললেন; বিষয়টাকে আরো পরিস্কার করে বলবেন কি?

রেবেকা সুলতানা

যেমন দেশে ফিরে গিয়ে আমার ফ্রিডমটা আমাকে দেয়া হয়েছিলো। আমি আমার নিজের সিলেবাস বানিয়েছি, আমার একজাম, এমএলএ সিষ্টেমে পেপার লিখতে দিয়েছি, আমি কুইজেস করেছি, সব কিছুই আমি করেছি। একজন ছাত্রের এটা যদি আগে থেকেই জানা থাকে তবে সে এসব দেশে এসে বুঝতে পারবে, কখন তাদের কি করতে হবে, কোন পেপার কিভাবে বানাতে হবে। যেটা আমার ক্ষেত্রে হয়েছে, একটা ইউনির্ভাসিটির টিচার হওয়া সত্বেও আমি যা জানতাম না। যেহেতু আমাকে শেখানো হয়নি; আমাকে আগে করতে হয়নি। আমি মনে করি, এ বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে হ্যাঁ, যদ্দুর জানি প্রাইভেট ইউনির্ভাসিটিতে এসব আপটুডেট করা হচ্ছে। তবে তারা ভালো করতে পারছে না এই কারণে যে, তারা ভালো স্টুডেন্ট পাচ্ছে না। ভালো স্টুডেন্টরা তো সব সরকারী ইউনির্ভাসিটিতে যাচ্ছে। সরকারী বিশ্ববিদ্যলয়ে এসব আপটুডেট জরুরী বলে আমি মনে করি। তাদের ক্যারিকুলাম পরিবর্তন, সিলেবাস পরিবর্তন আই মিন আরো মর্ডানাইজ করা উচিত সিলেবাসটা। যতোটা জানি দেশে নর্থ-সাউথ, ইষ্ট-ওয়েষ্ট ইউনির্ভাসিটির সিলেবাসগুলো বেশ মর্ডার্ণ।

স্কুলের কথা কি বলবো। আমি ওখানে বা এখানে স্কুলে পড়াইনি। তবে আমার মেয়ে ওখানে স্কলাসটিকাতে পড়েছে। ও লেবেল, এ লেবেল-এ। ওখান থেকে ও লেবেল দিয়ে যখন সে এখানে এলো, স্কুলে ভর্তি করাবো টরেন্টোতে, এরা ও লেবেলস এর মানেই জানে না! এ লেবেলস কি? ইংলিশ মিডিয়াম ঠিক আছে, কিন্তু জাস্ট ও লেবেল নয়, আমেরিকান সিস্টেমটা যেমন আছে, আইবি সিস্টেমটা, একমাত্র স্কুল হচ্ছে আইএসডি এক্সেসিভলি এক্সপেনসিভ। আরো কিছু সিষ্টেম আনা দরকার যারা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়বে, তাদের জন্য। বাংলা মিডিয়ামের কথা আমি এখানে বলবো না। আমি নিজেও বাংলা মিডিয়ামে পড়েছি। তবে বাইরে আমাদের ছাত্রদের যেনো কোনো অসুবিধায় না পড়তে সেদিক বিবেচনা করে সিস্টেমের পরিবর্তনটাই মুখ্য বলে আমি মনে করি। এ ক্ষেত্রে সরকারী ইউনির্ভাসিটিগুলোকেই গুরুত্ব বেশী দিতে হবে। কেননা, সরকারী ইউনির্ভাসিটিগুলোতে সেই গতবাঁধা সিস্টেমেই আজও পড়ানো হচ্ছে।

পরিশেষে বলবো, আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গনের বৃহত্তর স্বার্থে টিচারদের এ্যাকাউন্টিবিলিটি থাকা উচিত।

শাপলা বেগম

লোকাল স্টুডেন্ট হিসেবে আমি প্রথমেই বলবো, আমাদের এখানে যে পদ্ধতি বা ব্যবস্থায় শিক্ষা প্রদান করা হয় তা থেকে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে। কেননা, আমি দেখছি, ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশ থেকে যেসব ছাত্র এদেশে পড়াশোনা করতে আসে বাংলাদেশের দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থা বা পদ্ধতির কারণেই এখানে তাদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়। ইংরেজী উচ্চারণ থেকে শুরু করে পেপার তৈরী সর্বক্ষেত্রেই বাংলাদেশ থেকে ভালো রেজাল্ট নিয়ে পড়তে আসা ছাত্রদেরও আমি বিপাকে পড়তে দেখেছি। এদেশের শিক্ষার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে অনেককে হিমশিম খেতে হয়। আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশী ছাত্রদের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো উচিত। কথা বলা ও লেখায় গোড়া তেকেই তাদের পারদর্শি করে তোলা উচিত।

 

ফারহানুল ইসলাম

আমি শাপলা বেগমের সাথে একমত। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের আরো শক্ত অবস্থান তৈরীর জন্য আমাদের চিরাচরিত শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন অপরিহার্য। এদেশে এসে আমি অনেক কিছুই শিখছি। এদেশের শিক্ষা পদ্ধতিতে আমি খুব সহজেই যেভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছি সেটা বাংলাদেশের চলমান শিক্ষা ব্যবস্থায় সম্ভব না।